খেলোয়ার হওয়ার স্বপ্ন আজ বুলেটবিদ্ধ। বাঁ পায়ের হাটু এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গিয়েছে গুলি। বিছানায় যন্ত্রনায় কাতরেছে কদিন ধরে। অবশেষে চিকিৎসার জন্য ট্রেনে চড়ে রওনা দিয়েছে দক্ষিণ ভারত। দাড়িভিটের বছর পনেরোর বিপ্লবকে খেলোয়ার হিসাবে যে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। তার ইচ্ছে, মাঠজুড়ে ফুটবলটা খেলে যাওয়ার। একইসঙ্গে সে একজন সম্ভাবনাময় অ্যাথলিটও।
২০ সেপ্টেম্বর ইসলামপুরের দাড়িভিট স্কুলে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই প্রাক্তন ছাত্রের মৃত্যু হয়। ওই একই সময় স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র বিপ্লব সরকারের হাঁটুতেও লাগে গুলি। কোনও চিকিৎসা ছাড়াই এতদিন ব্যথার ওষুধ খেয়ে দিন কেটেছে। শুধু হাঁটুতে ব্যান্ডেজ। বিপ্লবের কাকা মনোতোষ সরকার জানান, "কোনওরকমে ৫০,০০০ টাকা যোগাড় করে ট্রেনে উঠছি। যেভাবে হোক, চিকিৎসা তো করাতেই হবে। এভাবে দিনের পর দিন বাড়িতে ফেলে রাখা যায় না।"
আরও পড়ুন: দেহ লোপাটের আশঙ্কায় তীর-ধনুকের পাহারায় দাড়িভিট গ্রামের জোড়া কবর
বিপ্লব জেলা অ্যাথলেটিকসে বেশ কয়েকটি বিভাগে ভাল ফল করেছে। স্কুলের ফুটবল দলের নিয়মিত সদস্য। বিছানায় শুয়ে কি বলছে বিপ্লব? তার কথায়, "ফুটবলের যে কোনও পজিশনে খেলতে পারি। ফুটবল খেলা আমার কাছে নেশা। আমার ইচ্ছে বড় ফুটবলার হওয়ার। তবে লঙ জাম্প, ক্রিকেটও প্রিয়। কিন্তু ফুটবল আমার সব কিছু। জানি না, যেভাবে হাঁটুতে গুলি লেগেছে, তাতে ভবিষ্যতে কীভাবে মাঠে নামব। অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। আর বলুন, দিনরাত এভাবে শুয়ে থাকতে কারও ভাল লাগে?" বিপ্লবের চেহারাই বাতলে দিচ্ছে, মানসিকভাবে তাকে কী বিপ্লবটাই না করতে হচ্ছে। এও এক অসাধ্য সাধনের লড়াই।
বিপ্লবের পাশে তার মা সরস্বতী সরকার উদাসভাবে ছেলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁর আদরের বিপ্লবের এভাবে বিছানায় পড়ে থাকা কোনভাবেই মানতে পারছেন না। তবে বিপ্লবকে যে হারতে দেবেন না, তাঁর কথাতে স্পষ্ট। সবরস্বতী দেবীর বক্তব্য, "ভবিষ্যতে কী হবে কে জানে। এখন ব্যথার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে।"
মায়ের সঙ্গে বিপ্লব। ছবি: জয়প্রকাশ দাশ
বিপ্লবের বাবা গোবিন্দ সরকারের গলায় হতাশার সুর। তিনি বলেন, "সম্বল বলতে মাত্র এক বিঘে জমি। কি ভাবে ছেলের চিকিৎসা করব তা ভাবলেই আঁতকে উঠছি। কোনওরকমে রোজের কাজ করে সংসার চালাই। তার ওপর ছেলে গুলি খেলো স্কুলে পড়তে গিয়ে। শিলিগুড়ির ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, এখানে ওই হাঁটুর চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। তাই যেভাবে হোক দক্ষিণ ভারত নিয়ে যাব। খরচ হবে প্রায় ৬-৭ লক্ষ টাকা। জানি না কী করব।"
কী হয়েছিল সেদিন? গোবিন্দবাবু বলেন, "হঠাৎ স্কুলের দিক থেকে গুলি-বোমার শব্দ শুনতে পেলাম। শুনতে পেয়েই ছুটে গেলাম স্কুলে। দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় ছেলে পড়ে রয়েছে। পিক-আপ ভ্যানে করে রওনা হই শিলিগুড়ির দিকে। পথে গোলাপাড়ায় একদল দুষ্কৃতী আমাদের ব্যাপক মারধর করে। তারপর কোনওভাবে শিলিগুড়ি নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা বলেন গুলি লেগেছ হাঁটুতে। তবে এখানে চিকিৎসা হবে না।"
শেষমেষ বিপ্লবকে নিয়ে শুক্রবার মনোতোষ ও তাঁর এক বন্ধু চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্কল্প, যেভাবে হোক তার হাঁটুর চিকিৎসা করাতেই হবে। তা নাহলে কলকাতার ময়দানে কীভাবে ফুটবল খেলবেন দাড়িভিটের বিপ্লব?