মুরলীধর, বদলি হওয়া বিচারপতি

২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে বিচারপতি মুরলীধর ও বিচারপতি বিনোদ গোয়েল ১৯৮৪ সালের শিখ বিরোধী দাঙ্গায় কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমারকে মুক্তির নির্দেশ খারিজ করে দেয়।

২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে বিচারপতি মুরলীধর ও বিচারপতি বিনোদ গোয়েল ১৯৮৪ সালের শিখ বিরোধী দাঙ্গায় কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমারকে মুক্তির নির্দেশ খারিজ করে দেয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Justice Murlidhar, Delhi High Court

অলংকরণ- শুভজিৎ দে

বৃহস্পতিবার সকালে দিল্লি হাইকোর্টের ৩৮ নং ঘরের সামনে লাইন। আইনজীবীরা কিঞ্চিৎ উসখুস করছেন। সে সময়েই সম্পূর্ণ নিঃসংশয়ে, মুখে চিরকালীন স্মিত হাসি ঝুলিয়ে উপস্থিত হলেন বিচারপতি এস মুরলীধর।

Advertisment

মামলা ছিল পিভি কাপুর বনাম স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের, বিষয় ছিল জনবসতি এলাকায় বাণিজ্যিক সংস্থা চালানো নিয়ে জনস্বার্থ মামলা। এলাকাবাসীদের পক্ষে রায় দিলেন বিচারপতি। তারপর ৫৮ বছর বয়সী মুরলীধর নজর করলেন ঘরভর্তি উপস্থিতির দিকে। আইনজীবীদের উদ্দেশে বললেন, "দিল্লি হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে এটাই ছিল আমার শেষ বিচারবিভাগীয় কাজ।"

পুলওয়ামা হামলায় ২২ বছরের ধৃত যুবক তিনমাস ধরে পুলিশ হেফাজতে ছিল, দাবি পরিবারের

যাঁরা বিচারপতি মুরলীধরকে চেনেন, তাঁরা জানেন ১৪ বছরের বিচারপতি জীবন ও তার পূর্ববর্তী দীর্ঘ আইনজীবী জীবনে তাঁর কথার চেয়ে কাজ বেশি জোরালো থেকেছে।

Advertisment

গত সপ্তাহে দিল্লিকে যখন গ্রাস করেছে দাঙ্গা, তখন তাঁর কাজ ও কথা দুইই ছিল অন্যরকম- বিশেষ করে এমন একটা সময়ে, যখন একের পর এক প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব অস্বীকার করতে থেকেছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে বারোটার সময়ে নিজের বাড়িতে একটি ফোন পান মুরলীধর। সে ফোনে ছিল ত্রাস। এরপর তিনি নিউ মুস্তাফাবাদের এক হাসপাতালে দাঙ্গায় আহতদের নিয়ে যাবার জন্য রাস্তা সাফ করার উদ্যোগ নেন।

পরদিন এক শুনানির সময়ে বিচারপতি মুরলীধর দিল্লি পুলিশকে জিজ্ঞাসা করেন যারা হেট স্পিচ দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়নি কেন। পুলিশ ও ভারতের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা যখন বলেন, তাঁরা এরকম কিছু শোনেননি, তখন বিচারপতি প্রকাশ্য আদালতে সেই ভাষণ চালাবার ব্যবস্থা করেন।

সেদিন শেষ হবার আগেই আরেকটি ঘটনা ঘটে। সরকার মুরলীধরকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে, যার বিরুদ্ধে বিরোধীরা প্রতিবাদে সরব হন। দিল্লি হাইকোর্টের তৃতীয় শীর্ষ বিচারপতি এখন পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিচারপতি হবেন। দু সপ্তাহ আগে প্রথমবার যখন সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম এই বদলির সুপারিশ করে, তখনই দিল্লি হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন তার প্রতিবাদ করেছিল।

মুরলীধরের প্রসঙ্গ উঠলে বার ও বেঞ্চে তাঁর সহযোগীরা বেশ কিছু বিশেষণ দেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমানুভূতিশীল, ন্যায্য ও অটল।

আমি দায়িত্বে থাকলে বিজেপি নেতাদের গ্রেফতার করতাম, বিস্ফোরক দিল্লির প্রাক্তন পুলিশ প্রধান

নিজের পেশে শুরু করেছিলেন কোম্পানি সেক্রেটারি হিসেবে। ১৯৮৪ সালে তিনি আইনজীবী হন। তিন বছর পর প্র্যাকটিস চেন্নাই থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে আসেন। এর পর তিনি কাজ করবেন প্রবাদপ্রতিম আইনজীবী জি রামস্বামীর অধীনে, যিনি পরে ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল হবেন। সেখানে কাজ করবার সময়েই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত অনুরাগী তথা আইনের গবেষক উমা রমানাথনের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর, যিনি পরে মুরলীধরের স্ত্রী হবেন।

আইনজীবী হিসেবে মুরলীধর মূলত নাগরিক অধিকারের মামলা লড়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের কর্মীদের হয়ে মামলা ও ভোপালের গ্যাস পীড়িতদের হয়ে মামলা।

১৯৯১ সালে বিচারপতি মুরলীধরকে নির্বাচন কমিশন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড হিসেবে নিয়োগ করে। সে সময়ে কমিশনের শীর্ষে ছিলেন টি এন শেষণ। তাদের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে এ কথা ধরে নিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার আরও দুজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে। শেষণ সরকারকে আদালতে টেনে নিয়ে যান এবং মুরলীধরকে নিজের আইনজীবী নিযুক্ত করেন। রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত এড়াতে শেষণের আইনজীবী হিসেবে কাজ করার জন্য মুরলীধর আগে নির্বাচন কমিশনের পদ ছেড়ে দেন। মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখার পর, নির্বাচন কমিশন ফের তাঁকে নিযুক্ত করে।

মুরলীধরের সঙ্গেই পেশা শুরু করেছিলেন এমন একজন বর্ষীয়ান আইনজীবীর কথায়, "অনেক বড় আইনজীবী ওই মামলায় কাজ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ননী পালকিওয়ালাও (শেষণের আইনজীবী)। কিন্তু মুরলীধরের সামান্য কাজও ছিল সকলের চেয়ে আলাদা। ওঁর সততাই হল উনি। এটা এমন একটা পেশা যাতে সারাক্ষণ নজরদারি চলতে থাকে, কিন্তু কেউ ওঁর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলতে পারবে না।"

বিচারপতি মুরলীধর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেরও আইনজীবী ছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের লিগাল এইড কমিটির কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার পর তিনি ২০০২ সাল থেকে চার বছরের জন্য আইন কমিশনের আংশিক সময়ের সদস্য হিসাবে কাজ করেন। তাঁর থিসিস Law, Poverty and Legal Aid: Access to Criminal Justice ২০০৪ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। দু বছর পর, ৪৫ বছর বয়সে মুরলীধার দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন।

হাইকোর্টের কলেজিয়ামে তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন তৎকালীন দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু। এক প্রাক্তন বিচারকের কথায়, "বিচারপতি কাটজুর জহুরির চোখ ছিল। তখন সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের শীর্ষে থাকা দেশের প্রধান বিচারপতি ওয়াই কে সবরাওয়ালও দিল্লি হাইকোর্টের হওয়াতেও মুরলীধরের পক্ষে যায়।"

হাইকোর্টে মুরলীধর বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় যুক্ত থেকেছেন। ২০০৯ সালে বিচারপতি এপি শাহের যে বেঞ্চ সমকামিতাকে অপরাধ নয় বলে রায় দিয়েছিল, সে বেঞ্চেও ছিলেন তিনি।

২০১০ সালে বিচারপতি মুরলীধর রায় দেন প্রধান বিচারপতির দফতরও তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় থাকবে। বিচারপতিদের সম্পত্তির হিসেব নিয়ে এক আরটিআই কর্মীর করা মামলাতেও তাঁর পক্ষে রায় দেন তিনি। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের তরফে প্রধান বিচারপতি কে জি বালাকৃষ্ণণ প্রশাসনিক অবস্থান থেকে হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিজের বিচারবিভাগীয় অবস্থানের কাছে চ্যালেঞ্জ করেন। পরে বিচারপতি বালাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে আয়ের সঙ্গে সংগতিহীন সম্পত্তির অভিযোগ ওঠে। হাইকোর্টের রায়ের ৯ বছর পর গত নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি মুরলীধরের রায়কেই স্বীকার করে নিয়েছে।

২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে বিচারপতি মুরলীধর ও বিচারপতি বিনোদ গোয়েল ১৯৮৪ সালের শিখ বিরোধী দাঙ্গায় কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমারকে মুক্তির নির্দেশ খারিজ করে দেয়। তিনি বলেন নিম্ন আদালতে ভ্রান্তিবশত প্রমাণের মূল্য দেওয়া হয়নি এবং দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় চরম সমর্থন জোগানোর অভিযোগ করেন।

ওই মাসেই বিচারপতি মুরলীধর পুনে পুলিশের কাজে ফাঁকফোকর দেখিয়ে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেফতার হওয়া সমাজকর্মী গৌতম নওলাখার ট্রানজিট রিম্যান্ড বাতিল করে দেন। সম্প্রতি সে মামলা এনআইএ-র কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে।

২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে বিচারপতি মুরলীধর ও গোয়েলের বেঞ্চ আরেকটি নিম্ন আদালতের রায় খারিজ করে দিয়ে ১৯৮৭-র হাশিমপুরা গণহত্যা মামলায় ৪২জন মুসলিমকে খুন করবার জন্য ১৬ জন প্রাক্তন পুলিশকর্মীকে শাস্তি দেয়।

বিচারপতি মুরলীধর বিচারক পদে থাকা কালীন, তাঁকে "লর্ডশিপ" বা "মিলর্ড" বলে সম্বোধন করতে আইনজীবীদের নিষেধ করে দেন এবং নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের তাঁর জন্য চেয়ার টেনে ধরার রীতিও প্রত্যাখ্যান করেন।

দিল্লি হাইকোর্টে বিচারপতি মুরলীধরকে শেষদিন দেখতে গিয়েছিলেন এক আইনজীবী। তাঁর কথায়, "ওঁর পক্ষে মানুষ হিসেবে বলুন বা বিচারপতি হিসেবে, দুর্নীতি করা সম্ভবই নয়।"

কোনও নেতিবাচক বিষয়ই কি নেই! হেসে ফেললেন এক আইনজীবী, যিনি প্রায়ই বিভিন্ন মামলায় বিচারপতি মুরলীধরের এজলাশে হাজির হতেন। "হ্যাঁ। আমি যদি কোনও দুষ্টু লোকের হয়ে মামলা লড়ি আর ওঁর কোর্টে যেতে হয়, তাহলে আমি ওঁকে খুবই অপছন্দ করব। যদি উনি ভাবেন আপনি ঠিক নন, বিশেষ করে সামাজিক ইস্যুতে, তাহলে যতই সওয়াল করুন লাভ নেই, উনি আপনার বিরুদ্ধেই রায় দেবেন।"

ঘটনাচক্রে বুধবার দিল্লির হিংসার মামলা মুরলীধরের আদালতে উঠেছিল তার কারণ প্রধান বিচারপতি ডি এন প্যাটেল ও দ্বিতীয় বরিষ্ঠ বিচারপতি জি এস সিস্তানি ছুটিতে ছিলেন।

তবে বিচারপতি মুরলীধরের শেষ কথা এখনও সম্ভবত শোনা বাকি- এখন থেকে ২০২৩ সালে তাঁর অবসর পর্যন্ত। যদি না সুপ্রিম কোর্ট তাঁর পদমর্যাাদা বৃদ্ধি না করে।