বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা বা কলেজিয়াম নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বন্দ্বের মাত্রা একধাপ চড়ল। কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার বিভাগীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু মঙ্গলবার অভিযোগ করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের আচরণ গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ, তিনজন আইনজীবীকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল কলেজিয়াম। কিন্তু, মোদী সরকার তা মানেনি। আর, সরকারের সেই আপত্তি ফাঁস করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। যা অত্যন্ত গুরুতর উদ্বেগের বিষয় বলেই মনে করছেন কিরেন রিজিজু।
এর পরই সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বিচারপতি নিয়োগের জন্য কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরন রিজিজুর সাম্প্রতিক মন্তব্য’র তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রাক্তন বিচারপতি রোহিনটন এফ নরিম্যান শুক্রবার বলেন, স্বাধীন বিচার বিভাগের মধ্যে সরকারি হস্তক্ষেপের পরিণতি হবে ভয়াবহ। বিচার ব্যবস্থায় নাক গলানো দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার সামিল। তিনি আরও বলেন, বিচারপই নিয়োগে কলেজিয়ামের সুপারিশ করা নাম স্থগিত রাখা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর।
বিচারক নিয়োগে অংশ নিতে চায় সরকার, প্রধান বিচারপতিকে লেখা চিঠিতে সেকথা আগেই স্পষ্ট করেছেন আইনমন্ত্রী কিরণ রিজ্জু। রবিবার হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির মতামতকে তুলে ধরে ফের কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী। কী বলেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি? তিনি বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট নিজেই বিচারক নিয়োগের সিদ্ধান্তে অংশ নিয়ে সংবিধানকে “উপেক্ষা” করেছে। রিজিজু দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারক বিচারপতি আর এস সোধি (অব.) এর একটি সাক্ষাত্কারের ভিডিও শেয়ার করেছেন, বলেছেন যে এটি “ভয়েস অফ জাস্টিস” এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একই রকম ” দৃষ্টিভঙ্গি” নিয়ে চলেন।
বিচারক নিয়োগ নিয়ে সরকার ও কলেজিয়াম ব্যবস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এর মধ্যেই সামনে এসেছে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরন রিজ্জুর একাধিক মন্তব্য। বিচারক নিয়োগে কলেজিয়াম পদ্ধতিতে সরকারি প্রতিনিধিত্ব চেয়ে ইতিমধ্যেই প্রধান বিচারপতিকে একটি চিঠিও দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু সপ্তাহখানেক আগেই বলেন, কলেজিয়ামের সুপারিশ করা নাম সরকারকে অন্ধভাবে অনুমোদন করতে বাধ্য নয়। সেই সঙ্গে তিনি কলেজিয়াম সিস্টেমকে গণতন্ত্রের পরিপন্থী বলেও উল্লেখ করেন।
বিচারক নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্র ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। সূত্রের খবর, দিন কয়েক আগেই কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরন রিজিজু প্রধানবিচারপতিকে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামে সরকারের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিচারক নিয়োগের সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সরকারের প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী। SC কলেজিয়ামে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং হাইকোর্ট কলেজিয়ামে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে এই চিঠিতে। চিঠিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রুমা পালের বিবৃতিও উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে তিনি কলেজিয়াম ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, রিজিজু সম্প্রতি বারবার কলেজিয়াম ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন, এটিকে “অস্বচ্ছ”, “সংবিধানের পরিপন্থী” বলে অভিহিত করেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম নিয়ে প্রশ্ন-অভিযোগ রয়েছে বহু দিন আগে থেকেই। অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামে নিয়োগ ও বদলি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুরু করে প্রাক্তন বিচারপতিরা কলেজিয়াম ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের সকলেরই দাবি, দীর্ঘদিনের পুরনো এই কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিদায় নেওয়া উচিত এবার। কলেজিয়াম ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতেই ২০১৫ সালে মোদী সরকার বড় পদক্ষেপ নেয়। সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টগুলির বিচারপতিদের নিয়োগে কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে জাতীয় বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন বা এনজেএসি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। সংসদে ও ১৬টি রাজ্যের বিধানসভাতেও এই বিল পাশ করানো হয়।
আরও পড়ুন: < আগামী মাসেই ভারতে আসছে ডজন খানেক চিতা, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে চুক্তি ভারতের >
মাস খানেক আগেই কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী বিচারক নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতিকে “অস্বচ্ছ” বলে উল্লেখ করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, তিনি সম্প্রতি বলেছেন যে কলেজিয়াম সিস্টেম, যা একটি প্রশাসনিক কাজ “বিচারকদের অত্যন্ত ব্যস্ত রাখছে” এবং বিচারক হিসাবে তাদের দায়িত্বকে প্রভাবিত করছে। প্রাক্তন বিচারপতির সাক্ষাত্কারের ভিডিও শেয়ার করে ফের কলেজিয়াম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী রিজিজু। তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানকে হাইজ্যাক করেছে’। আসলে, কলেজিয়াম প্রক্রিয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং সরকারের মধ্যে মতপার্থক্য অব্যাহত।
কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী কিরন রিজিজু প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়কে চিঠি লিখে সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামে সরকারী প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন, কেন? আইনমন্ত্রীর মতে, কলেজিয়াম ব্যবস্থা ২৫ বছরের পুরনো। কলেজিয়াম ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার জন্যই তাঁর এই সুপারিশ। রিজিজু আরও বলেছেন যে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের হাইকোর্ট কলেজিয়ামের সিস্টেমের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ ।
কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী বারবার কলেজিয়াম ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি উপরাষ্ট্রপতি ধনখড় কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগে সুপ্রিম কোর্ট ও কেন্দ্রের সংঘাতল নিয়ে মুখ খুলেছেন। সংসদে আইন পাশ হওয়ার পর কেন সেটিকে সুপ্রিম কোর্ট ‘অসাংবিধানিক’ঘোষণা করা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
কলেজিয়াম সিস্টেমে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বহুদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদীর সরকার সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়াম ব্যবস্থায় বদল আনেন। কলেজিয়াম পদ্ধতির বিকল্প জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (এনজেএসি) গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এব্যাপারে ইতিমধ্যে সংসদে বিল পাশ হয়েছে। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। সুপ্রিম কোর্টের তরফে এনজেএসি-কে ‘অসাংবিধানিক’বলে উল্লেখ করে কলেজিয়াম পদ্ধতি বহাল রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়, যা নিয়ে আইনমন্ত্রীর পাশাপাশি সরব হয়েছেন উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়ও।