নাভিদ ইকবাল
নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগের কথা, একটা বিয়ের নেমন্তন্নে যাওয়ার জন্য তাকে নতুন পোশাক কিনে দেওয়া হয়েছিল। এই পোশাকের সঙ্গে ঠিক কী জুতো পরবে সে নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিল না তার। বাড়ির সামনে থেকে তার দেহ উদ্ধার করা হল। আর এর কিছুদিনের মধ্যে সেই ৮ বছরের শিশুকন্যার নতুন জামা বিলিয়ে দিলেন তাঁর মা। নিহত শিশুকন্যার জন্য রাস্তায় মেয়েকে নিয়ে মিছিল বেরোলে গলায় কান্না আটকে যায়। আর তাই ওর প্রায় সব জামাকাপড়ই বিলিয়ে দিয়েছি। কিছু ট্রাঙ্কে তোলা আছে। কার্গিল যাওয়ার পথে উধমপুরের কাছে মানওয়ালে একটি সেতুর নীচে বসে একথাগুলো বললেন কাঠুয়ার সন্তানহারা মা।
৮ বছরের শিশুকন্যার বাকি পোশাক যে ট্রাঙ্কে রাখা , তসে ট্রাঙ্ক রয়েছে তাঁদের কাঠুয়ার গ্রামের ঘরে। প্রতিবছরের মতো এবারও গরমের সময়ে কাঠুয়ার বাড়ি ছেড়ে ওঁরা অন্যত্র গেছেন। জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়ের কাছে কৃষ্ণাপুরে রয়েছেন ওই শিশুকন্যার মা। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন দুই ভাই, এক বোন। আর এক ছেলেও। আর রয়েছে তাঁদের ৪০টি ঘোড়া।
সপ্তাহ দুয়েক আগে নিহত শিশুকন্যার বাবা অন্যত্র রওনা দিয়েছেন। বর্তমানে সানাসার এলাকার কাছে রয়েছেন ৮ বছরের তিনি। চল্লিশ বছর বয়সের তুলনায় অনেকটাই বেশি কুঁচকে গেছে তাঁর মুখ, কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর চোখ ভরে উঠছে, কার্গিলের কথা মনে পড়ছে তাঁর, যে কার্গিলকে বড্ড ভালোবাসত তাঁর মেয়েটা। এসব কথার সময়েই মাথার উপর দিয়ে একটা ট্রেন চলে যায়, ‘‘কোনও এমন একটা জায়গা যদি থাকে, যেটা ও ছেড়ে থাকতে পারত না, তাহল এই ঘাসজমি। এই জায়গাগুলোতেই ওর ঘোড়াগুলো যেন খুশি দৌড়ে বেড়াতে পারত। আট বছরের মেয়েটা যে ঘোড়াটাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসত, সেই ‘সুন্দর’-এর দিকে আঙুল তুলে দেখান চল্লিশের মহিলা, বলেন, ‘‘সবচেয়ে ছোট ঘোড়াটায় চড়তে পারত ও’’, এ কথা বলার সময়ে তাঁর মুখে একবারের জন্য ফুটে উঠেছিল একচিলতে হাসি।
আরও পড়ুন - কাঠুয়া কন্যা ও ফেসবুক প্রবণতা
ওকে যে দত্তক নেওয়া হয়েছিল, সে কথা কোনওদিন জানতে দেননি, বলছিলেন তিনি। তিন সন্তান বাস দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর, কাঠুয়াকন্যার বাবার বোনের কাছ থেকে বাচ্চাটাকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। অন্য দুই ছেলের জন্য এখন বড় চিন্তা হয় ওঁদের, একজন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে, অন্যজন ক্লাস সিক্সে। দুই ছেলের একজন স্কুলের ক্লাসের জন্য ওখানেই রয়ে গেছে, কিন্তু সে আর কাঠুয়ায় রাতে থাকে না, জায়গাটাকে আর নিরাপদ ভাবেন না ওঁরা। বড্ড দুষ্টু ছিল বলে কচি মেয়েটাকে স্কুলে পাঠাননি ওঁরা, ভেবেছিলেন আরেকটু বোধবুদ্ধি হলে তবে পাঠাবেন।
শিশুটি তো জানতাই না কাকে হিন্দু বলে, মুসলমানই বা কে! খেদ সন্তপ্ত বাবার। চার্জশিটে লেখা আছে, দেবস্থানের ভেতরে সাতদিন ধরে বন্দি রেখে বহুবার ধর্ষণ করা হয়েছিল তাকে, খেতে দেওয়া হয়নি, ওষুধ দিয়ে বেহুঁশ করে রাখা হয়েছিল। আর তারপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। ওর মা যা দেখেছেন, শুধু সেটুকুই বলতে পারেন, ‘‘ওর পুরো শরীর ঝলসে যাওয়ার মতো বাদামি হয়ে গিয়েছিল। আমি ওর ভাঙা পাঁজরগুলো টের পাচ্ছিলাম, আর মাথার যে জায়গাটায় পাথর মেরেছিল, সে জায়গার রক্তের দাগ আমি কোনওদিন ভুলব না।’’
ধর্ষণ শব্দটা উচ্চারণ করতে ওর মায়ের চোখে জল চলে আসে, ‘‘এত ছোট বাচ্চার সঙ্গে কী করে করতে পারল ওরা?’’
নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগের কয়েকটা স্মৃতি মনে পড়ে যায়, রান্নাঘরে ময়দা নিয়ে খেলছিল মেয়েটা, ওর দাদা সে ফোটো তোলে, যে ফোটো আজ ছেয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আরও পড়ুন - কাঠুয়া ও উন্নাওয়ের ঘটনায় সরব নেটিজেনরা
এক মেয়েকে হারিয়ে, এই মেয়েকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। নতুন করে পুরনো যন্ত্রণা ফিরে এসেছে তাঁর। ‘‘আগের বারের মেয়ে হারানোর কষ্ট ও ভুলিয়ে দিয়েছিল, ... আমি আর কখনও কোনও মেয়েকে মানুষ করতে পারব না, আমি মেয়েদের নিরাপদে রাখতে পারি না।’’
কবরের নিচে একা শুয়ে থাকা মেয়েটা ওঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। উনি বলছিলেন, ‘‘আমাদের কবরখানায় ওকে গোর দিতে দেওয়া হয়নি, লাশ বুকে নিয়ে ৭ কিলোমিটার পথ পেরোতে হয়েছিল। ওরা ভয় দেখিয়েছে যে আমাদের ঘর জ্বালিয়ে দেবে, যাতে আমরা আর কোনওদিন ওখানে না ফিরতে পারি। আশাকরি আমার মেয়ের কবরটা ওরা জ্বালিয়ে দেবে না।’’