বয়ঃসন্ধিকালে 'ভুল'কে অনেক সময় ক্ষমাযোগ্য অপরাধ হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু সেই ভুল যদি প্রাণের বিনিময়ে হয় তাহলে? শনিবার মালদার কালিয়াচকের ঘটনায় ১৯ বছরের আসিফ মহম্মদের কর্মকাণ্ড শিহরণ জাগানোর মতোই। আর সেখানেই উঠে আসছে বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের স্বাভাবিক থেকে 'অস্বাভাবিক' মনস্ক হয়ে ওঠার নেপথ্যে কিছু কারণ। শৈশবের সমস্যা যখন ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করে কিশোর মনকে 'অস্বাভাবিকতার' সূত্রপাত হয় সেখানেই। চারাগাছের শিকড়ে যদি জমতে থাকে ঘৃণা, হিংস্রতা, ক্ষোভ, জেদের মতো বিষয়গুলি, তখন ডালপালা মেলে বেড়ে ওঠা কিশোরমনে জন্ম নেয় অসংবেদনশীলতা। আর সেখান থেকেই অন্ধকার জগতে প্রবেশ এবং ঘটিয়ে ফেলা কিছু নারকীয় ঘটনা।
মালিদার কালিয়াচকের গুরুটোলা গ্রামে মা, বাবা, বোন ও দিদাকে যেভাবে 'খুন' করেছেন উনিশের আসিফ, সেই একের পর এক তথ্য হাতে আসার পর জেলা পুলিশের কর্তারা রীতিমত চমকে উঠেছেন। এতো পোড় খাওয়া 'অপরাধ মানসিকতা'কেও হার মানায়। স্থানীয় সূত্রে খবর, মাধ্যমিকে 'স্টার' পাওয়া আসিফ এলাকার কৃতি ছাত্রই ছিলেন। কিন্তু এরপর হঠাৎই বদলে যাওয়া। পড়াশুনো ছেড়ে একা একাই থাকতে ভালবাসতেন। সেই একাকীত্বের মুহুর্তরাই কি মানসিকভাবে গ্রাস করেছিল আসিফ মহম্মদকে? কেন এমন হয়?
আরও পড়ুন, কালিয়াচকে নারকীয় হত্যালীলার নেপথ্যে কি মমি তৈরির গবেষণা?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (Psychiatrist) ওম প্রকাশ সিং বলেন, "ওঁর মানসিক গঠনে একটা অস্বাভাবিকত্ব নিশ্চয়ই রয়েছে। কিছু অসুবিধাও রয়েছে। ছেলেটি ডার্ক ওয়েবে থাকত শুনেছি। যেখানে নানা রকমের প্রলোভিত উপাদান রয়েছে। অনলাইনে খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যার নিয়ম কানুন সেখানে দেখানো হয়। সেখান থেকেই প্রভাবিত হয়েছে। এছাড়াও এই বয়সে কোনও বাধা নিতে মন একেবারেই চায় না। মা-বাবা কিংবা পরিবারের থেকে ইন্টারনেট সম্পর্কিত বাধা পেলে রাগ, ক্ষোভ, জেদ তৈরি হতে শুরু করে। এই বয়সের সময়কালে দেখা যাচ্ছে সংবেদনশীলতা কমে যাচ্ছে। নিষ্ঠুরতা বাড়ছে। বাবা-মাকে মারছে এটা খুবই দেখা যাচ্ছে প্রাত্যহিক জীবনে। লকডাউনে ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার জন্য সেই সমস্ত ঘটনা বেড়েছে। এখন মূলত মোবাইল কিংবা এই জাতীয় ইলেকট্রনিক গ্যাজেট না পেলে ছেলেমেয়েরা হিংস্র হয়ে উঠছে। খুব বেশি মাত্রাতেই হচ্ছে। কিন্তু মালদার এই ঘটনা অনেকটাই অস্বাভাবিক, ব্যতিক্রমীও বলব। শৈশব স্বাভাবিক না হলে এই সমস্যা চলে আসে বয়ঃসন্ধিকালে।"
নিজের পরিবারকে নিজের হাতে শেষ করা তাও 'নারকীয়' ভাবে, বছর উনিশের আসিফের পক্ষে এও সম্ভব? স্নায়ু ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ অর্ঘ্য দত্ত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, "ছোটবেলা থেকে যদি হিংসার ঘটনা দেখে কিংবা সেই ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে শিশুরা সেক্ষেত্রে ধীরে ধীরে তাঁরা সংবেদনশীলতা (ইংরেজি পরিভাষায় যাকে এমপ্যাথি বলা হয়) হারাতে থাকে। মা-বাবার মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক না থাকা, বাবা মাকে মারধর করছেন, কিংবা তাঁদের কথাবার্তায় অসামঞ্জস্যতা, কটূ ব্যবহার, এসব দেখতে থাকলে শিশুদের মধ্যেও হিংস্রভাব চলে আসে। এর ফলে তাঁদের মধ্য থেকে সংবেদনশীলতা চলে যেতে থাকে। তাই পরবর্তীতে সে যখন হিংস্র কোনও ঘটনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে, তখন খারাপ লাগাটা তাঁদের আর থাকে না।"
আরও পড়ুন, পানীয়ে মাদক মিশিয়ে খুন, ঘরেই সুড়ঙ্গ, কালিয়াচক খুনে প্রকাশ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য
এক্ষেত্রে অপরাধপ্রবণতা আগে থেকেই ছিল আসিফের ক্ষেত্রে এমনটাই মনে করছেন চিকিৎসক অর্ঘ্য দত্ত। তিনি বলেন, "এমন কিছু কাজ করছিলেন হয়তো টাকার দরকার ছিল বাড়ি থেকে দেওয়া হচ্ছিল না বা মারধর করা হয়েছিল। অনেক সম্ভাবনা থাকতে পারে। এক্ষেত্রে কনডাক্ট ডিসঅর্ডার (Conduct disorder) ও থাকতে পারে। শৈশবের এই রোগটি পরবর্তীতে অ্যান্টিসোশাল পার্সোনালিটিতে বদলে যায়। এছাড়াও আর্থ সামাজিক দিকও থাকতে পারে। কিংবা মাদকযোগও থাকে অনেক সময়, যার জেরে এমন অস্বাভাবিক মানসকিতার জন্ম হয়।"
আসিফ মহম্মদের 'ভুল' কাজের এই ঘটনা ভাবিয়ে তুলছে নানা মহলকে। শিশু কিংবা কিশোর মনকে কেন বারবার গ্রাস করছে হিংসা? ইন্টারনেটের জালে জড়িয়েই কি অজান্তে 'ভুলের' শিকার হচ্ছে শৈশব? কালিয়াচকের নারকীয়তা থেকে উঠে আসছে এমনই কিছু প্রশ্ন!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন