Advertisment

'চরম আতঙ্ক' অপরাধীদের মুক্তির পরই প্রাণে বাঁচতে বিলকিসের গ্রাম রাধিকপুর ছাড়ছেন মুসলিমরা

শয়ে শয়ে সংখ্যালঘু ভয়ে বাড়ি ছাড়া, জানা নেই পুলিশের। দাবি রাধিকপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর ডিজি ভোহানিয়ার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Muslim families flee randhikpur village take shelter in relief colony

ত্রাণ শিবিরের সামনে রাধিকপুর থেকে আসা মুসলিমদের ভিড়। ছবি- ভূপেন্দ্র রানা

গ্রামে ফিরেছেন বিলকিস গণধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের ৭ সদস্যকে খুনের অপরাধীরা। অতঙ্কে কাঁপছে দাহোড় জেলার রাধিকপুর গ্রামের সংখ্যালঘুরা। প্রাণে বাঁচতে ভিটে ছেড়ে তাই পালাচ্ছেন সেখানকার মুসলিমরা। গন্তব্য, ওই জেলারই দেবগড় বাড়িয়া তালুকের রাহি-মাবাদ ত্রাণ শিবির। এখানে থাকলেই তবু নিরাপদে বাঁচা সম্ভব বলে মনে করছেন অধিকাংশ ঘর-ছাড়া সংখ্যালঘু মানুষগুলো। কীভাবে গণধর্ষণ ও খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা জেলমুক্ত হতে পারে তা ভেবেই এখনও বিস্মিত ত্রাণ শিবিরে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মানুষগুলো।

Advertisment

২০০২ সালে সাম্প্রদায়িক হিংসায় জ্বলে উঠেছিল গুজরাতে। নিশানা করা হয়েছিল সংখ্যালঘুদের। গোধরা পরবর্তী সময়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বাবিলকিস বানোকে গণধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের ৭ সদস্যকে হত্যার নারকীয় ঘটনা ঘটে। তারপর প্রবল লড়াই। ২০০৮ সালের ২১ জানুয়ারি ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে মুম্বইয়ের আদালত। ১ জনের মৃত্যু হলে বাকি ১১ জনের হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ।সুপ্রিম রায়ে দোষীসাব্যস্ত ১১ জন অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ২০১৭ সালের মে মাসে বম্বে হাইকোর্ট ১১ জন ধর্ষকের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখে। ২০১৭ সালের মে মাসে বম্বে হাই কোর্ট ১১ জন ধর্ষকের যাবজ্জীবন সাজাই বহাল রাখেছিল। বিলকিসকেও ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের জন্য গুজরাট সরকারকে নির্দেশ দেয়। এরপর গত ১৫ অগাস্ট গোধরা সাব-জেলের উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদনে ছেড়ে দেওয়া হয় ওই ১১ অপরাধীকে। এদের বেশিরভাগের বাড়িই রাধিকপুর গ্রামে। জেলে থেকে সাদরে এদের গ্রামে বরণ করা হয়।

আর তাতেই সিদুঁরে মেঘ দেখছেন রাধিকাপুরের সংখ্যালঘুরা। সোমবার, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধি পৌঁছে গিয়েছিল রাহি-মাবাদ ত্রাণ শিবিরে। দিনভর সেখানে টেম্পো, রিকশা বোঝাই মালপত্র। সবগুলিই এসেছে রাধুকপুর থেকে। গ্রামের আতঙ্কগ্রস্তরা বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে কোনওমতে আপাতত টাঁই নিচ্ছেন এই ত্রাণ শিবিরে। রাধিকপুর থেকে ত্রাণ শিবিরে আসা একজন বললেন, 'দোষীদের মুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

২০ বছর আগের নারকীয় ওই ঘটনার সময় রাধিকপুরে সুলতানার বয়স ছিল মাত্র ৪ বছর। এখন সে ২৪ বছরের। গ্রাম ছেড়ে মা, বোনের সঙ্গে ত্রাণ শিবিরে উঠেছে সুলতানা। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রসকে সুলতানা বলেছেন, 'গত সপ্তাহ থেকে মুসলিমরা আতঙ্কে রয়েছেন। সরাসরি কোনও হুমকি নেই, কিন্তু যেভাবে গ্রামে অপরাধীদের স্বাগত জানানো হল এবং গ্রামে যে আনন্দের অনুভূতি, তাতে আমরা ওইখানে থাকতে নিরাপদ বোধ করছি না। ফলে উদ্বিগ্নহয়ে ত্রাণ শিবিরেই উঠতে হল। যখন ওরা প্যারোলে বেরিয়ে আসত তখন এতটা ভয়ের ছিল না, কারণ জানতাম যে শেষ পর্যন্ত ওদের ঠিকানা জেল। কিন্তু এখন ওরা মুক্ত, আর সেটাই ভয়ের।'

সুলতানা ও তাঁর মা দিনমজুর। সুলতানার মায়ের ২০২২ সালে চার বছর বয়সী সুলতানাকে নিয়ে রধিকপুর গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণার কথা স্মরণ করছিলেন। তিনি বলেন, 'ভয়ঙ্করের ছবিগুলো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। যদিও আমরা ভাগ্যবান ছিলাম যে তখন পালাতে পেরেছিলাম, কিন্তু আমরাঅপরাধীদের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছি না। বিলকিস গত দুই দশক ধরে যে ধরনের সাহস দেখিয়েছে তা আমাদের কারোরই নেই। এখানে আসার সময়ও কেশরপুরার কাছে আমরা শাসক দলের একটি বিশাল মিছিলের মুখোমুখি হয়েছিলাম এবং খুবই ভয় পেয়েছিলাম। আমি আমার মেয়েকে শক্ত করে ধরে ছিলাম।'

আরও পড়ুন- নূপুরের কায়দায় নবীর অবমাননা, জনতার বিক্ষোভের জেরে গ্রেফতার বিজেপি বিধায়

এই ত্রাণ শিবিরে ঘুরে গিয়েছেন বিলকিস বানো-ও। তাঁর স্বামী ইয়াকুব রসুল প্যাটেলের কথায়, 'লড়াই করার প্রস্তুতি নিচ্ছিন। এতদূর আসতে পেরেছি যখন তখন হাল ছাড়ব না। আমরা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ও আইনজীবীদের পরামর্শ চেয়েছি এবং আপিলের বিষয়ে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত হবে।'

রাধিকপুর থেকে ত্রাণ শিবিরে আসা বিলকিসের মামাতো ভাই, কান্নাভাজে গলায় বলেন, 'আমার বোন, পিসি এবং অন্যদের সঙ্গে অপরাধীরা যা করেছে তা সত্ত্বেও তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওরা গ্রামে এবং বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটাই ভয়ের। বাড়ি ছেড়ে স্ত্রী এবং শিশুকে নিয়ে ত্রাণ কলোনীতে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। কারণ আমি প্রষশানের উপর ভরসা হারিয়েছি।'

রন্ধিকপুরের আরেক বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক, যিনি বিলকিস বানো মামলায় সাক্ষীদের পক্ষে পিটিশন করছেন, তিনি বলছিলেন যে, '২০০৪ সালে গ্রামের ৭৪টি পরিবার ত্রাণ কলোনিতে আশ্রয় নিয়েছিল। এখনকার ছেলে, মেয়েদের বেশিরভাগই শিবিরে জন্মেছে। অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর অনেকেই রাধিকপুরে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু ১১ অপরাধীর ছাড়া পাওয়ার পর ফের তারা শিবিরে এসেছে। দাঙ্গা ও পরবর্তী হিংসার ছবি এখনও আমাদের মনে দগদগে।'

ইতিমধ্যেই দাহোড়ের মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা জেলা কালেক্টরের কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। সেখানে আর্জি দোষীদের কারামুক্ত করার রাজ্য সরকারি সিদ্ধান্ত যেন পুনর্বিবেচনা করা হয়। স্মারখলিপিতে লেখা রয়েছে, 'সরকারি পদক্ষেপ বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি এবং সম্মানকে ক্ষুন্ন করেছে। বিচারে বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে হবে।' সরকারি পদক্ষেপের প্রতিবাদে একটি সমাবেশ করারও অনুমতি চাওয়া হয়েছে প্রশানের কাছে।

মুসলিমদের এই আতঙ্ক নিয়ে কী মত জেলমুক্ত অপরাধীদের পরিবারের? দোষী রাধেশ্যাম শাহর ভাই আশীস জানান, তাঁর দাদা বাইরে ট্যুরে চলে গিয়েছেন। বলেন, 'মুক্তির পর থেকে, আমার দাদা সহ ১১ জন, গ্রামের কোনও মানুষের কোনও কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। শান্তিপূর্ণভাবে গ্রামে বাস করছেন। যদি কেই মুক্তিপ্রাপ্তদের থেকে ভয় পান তবে তিনি প্রশানের কাছে সহায়তা চাইতেই পারেন।' আরেক অপরাধী শৈলেশ ভাট এবং তাঁর ভাই মিতেশের পরিবারের সদস্যও একই দাবি করেছেন।

রাধিকপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর ডিজি ভোহানিয়া বলেছেন, '১৫ অগাস্ট যে ১১ দোষী গ্রামে ফিরে আসার পর থেকে আইনশৃঙ্খলাজনিত কোনও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। পুলিশ এক সপ্তাহ ধরে গ্রামে ব্যাপক টহল দিচ্ছে।' এই পুলিশ কর্তার দাবি, ফের হিংসার আশঙ্কায় মুসলিম পরিবারগুলি গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়টি প্রশাসন বা পুলিশ জানে না।

Bilkis Bano gujrat Muslim
Advertisment