সম্প্রতি রাফাল চুক্তি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই চুক্তি সংক্রান্ত কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রিপোর্ট "পরীক্ষা করে দেখেছে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি (পিএসি)" এবং "রিপোর্টের একটি সম্পাদিত রূপ সংসদের সামনে পেশ করা হয়, যা সর্বসমক্ষে (পাবলিক ডোমেইনে) রয়েছে"।
মুশকিলের শুরু সেখান থেকেই। এই চুক্তি নিয়ে আদৌ কোনও সিএজি রিপোর্টই নেই, কাজেই পিএসি-র পরীক্ষা করে দেখারও কিছু নেই। সেইমতো একটি আবেদনে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের শীর্ষ আদালতকে বলেছে, এই অনুচ্ছেদটি যেন সংশোধন করে নেওয়া হয়। কেন্দ্র কোর্টকে আরও জানায়, সীল করা খামে সরকারের পক্ষ থেকে কোর্টের কাছে যে কাগজ জমা দেওয়া হয়, তাতে রিপোর্ট পরীক্ষা করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য ছিল মাত্র। এও বলা ছিল যে সিএজি-র রিপোর্ট পিএসি পরীক্ষা করার পর "সম্পাদিত আকারে তা সংসদের সামনে এবং জনসমক্ষে রাখা হয়"।
আরও পড়ুন: প্রতিরোধ নয়, বরং আক্রমণাত্মক হোন, রাফালে বিতর্কে কর্মীদের বার্তা বিজেপি-র
এই "সম্পাদিত আকার" নিয়েই প্রশ্ন তুললেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত সিএজি আধিকারিক। বক্তব্যের সারমর্ম - সিএজি রিপোর্ট একটাই হয়। সম্পাদিত আবার কী? এমন কোনও সম্পাদিত রিপোর্ট জনসমক্ষে কখনো প্রকাশ করা হয়েছে বলে তাঁদের জানা নেই।
"সিএজি রিপোর্ট সম্পাদনা করার কোনও সংস্থানই নেই। উদাহরণও নেই। না এর কোনও আইনি বৈধতা আছে, না সংবিধানে কোথাও বলা আছে," ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন লোকসভার প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক পিডিটি আচার্য্য।
"আমি এক্ষেত্রে কখনও সম্পাদিত কথাটাই শুনি নি। একটাই রিপোর্ট হয়, যা অডিটররা যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে তৈরি করেন, এবং যা ডেপুটি সিএজি ও সিএজি স্বয়ং অনুমোদন করেন। একবার সংসদের কাছে পেশ করা হয়ে গেলে এটি পাবলিক ডকুমেন্ট হয়ে যায়," বলছেন প্রাক্তন ডেপুটি সিএজি ডাঃ বিপি মাথুর।
আরও পড়ুন: রাফালে চুক্তির দাম নিয়ে এবার কেন্দ্রকে হলফনামা পেশের নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের
পিআরএস লেজিসলেটিভ রিসার্চ সংস্থার চক্ষু রায় বলেন, "সংবিধানে বলা আছে যে সিএজি-র সমস্ত রিপোর্ট সংসদে পেশ করা হবে। লোকসভার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নিয়মাবলিতে স্পষ্ট করা আছে যে সংসদের সামনে রাখা প্রতিটি কাগজ বা নথি সর্বজনীন হিসেবেই গণ্য হবে।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লোকসভার আর এক প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, "আজ পর্যন্ত কোনোদিন কোনো সম্পাদনা হয় নি। এই শব্দটাই এই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নতুন। হয়তো ভবিষ্যতে সম্পাদিত রিপোর্ট বেরোবে।"
এই প্রসঙ্গেই আচার্য্য আরও জানালেন, "যে কোনো সিএজি রিপোর্ট সংসদে পেশ হওয়ার পর পিএসি-র কাছে যায়। অর্থমন্ত্রী সেটি সংসদের উভয় কক্ষের সামনে রাখেন। পিএসি-কে সাহায্য করে সিএজি। বস্তুত, সিএজি-কে পিএসি পরিকাঠামোর অংশ বলা যেতে পারে।"
লোকসভার প্রাক্তন অতিরিক্ত সম্পাদক দেবেন্দ্র সিং, যিনি পিএসি আধিকারিক হিসেবে ১১ বছর কাটিয়েছেন, বলছেন পিএসি যে কোনো রিপোর্ট পরীক্ষা করে সিএজি-র সাহায্যে। "যে সব অনুুচ্ছেদে সরকারি ব্যাখ্যার প্রয়োজন, সেগুলি বেছে নেওয়া হয়, এবং বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তলব করা হয়। সিএজি-র মন্তব্যের ভিত্তিতে পিএসি-র রিপোর্ট সংসদে পেশ করা হয়। গোটা প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং সার্বিক।"
আরও পড়ুন: মোদী-ই দাম ঠিক করেছিলেন রাফালের, কংগ্রেসের পাশাপাশি একই অভিযোগ সিপিআই(এম)-এর
মাথুরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, "একটি প্রাথমিক গোপনীয় সিএজি রিপোর্ট সরকারকে দেখানো হয়, এবং সরকারের জবাব চূড়ান্ত রিপোর্টের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একাধিক চূড়ান্ত রিপোর্ট এমন হয়, যাতে কোনো দেশের নাম বা কোনো বিশেষ অস্ত্রের ধরন বা তার পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার স্বার্থে সংসদের কাছে পাঠানোর আগে রিপোর্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়।"
আবারও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাম্প্রতিককালে অবসরপ্রাপ্ত এক সিএজি এই ব্যাখ্যাকে সমর্থন করছেন। "যা কিছু গোপন রাখার, তা রিপোর্ট প্রকাশ করার আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়। যদি পিএসি এই গোপন অংশগুলি দেখতে চায়, সেগুলি তাদের কাছে প্রকাশ করা হয়, কিন্তু সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে।"
আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টে রাফাল রায় সংশোধনের আবেদন কেন্দ্রের
কোন কোন তথ্য গোপন রাখা হবে, তা কেন্দ্র এবং সিএজি-র মধ্যে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রাথমিক রিপোর্ট পেশের আগে। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ওই সিএজি বলেন, "হয় গোপন রাখার কথা সরকার বলবেন, নাহয় সিএজি নিজেই ঠিক করবেন। উদাহরণ স্বরূপ, সরকার জানিয়েছিলেন যে সেনাবাহিনীর এয়ার ডিফেন্স সংক্রান্ত তথ্য যেন ফাঁস না করা হয়। প্রতিবছর এই ধরনের দু-তিনটি রিপোর্ট থাকে, যাতে কিছু তথ্য গোপন রাখা হয়।"
তাঁর আরও বক্তব্য, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার স্বার্থে একমাত্র ব্যতিক্রম এই যে সে সংক্রান্ত বেশিরভাগ রিপোর্টই সিএজি নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে না, যদিও সেগুলির হার্ড কপি সংসদে পেশ করা হয়।