ভারতিত রেলের তিনটি নন-টেকনিক্যাল এবং পাঁচটি টেকনিক্যাল পরিষেবাকে সংযুক্ত করে শুধুমাত্র একটি ভারতীয় রেল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস (IRMS) গঠন করার প্রস্তাবে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন রেলের নন-টেকনিক্যাল আধিকারিকরা। তাঁদের পরিকল্পনা, সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাঁরা চিঠির বন্যায় ভাসিয়ে দেবেন প্রধানমন্ত্রী, ক্যাবিনেট সচিব, রেলমন্ত্রী, রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং রেলের কর্মচারী ও প্রশিক্ষণ বিভাগকে।
সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংযুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিন ঘণ্টার ভিডিও কনফারেন্স করেও ট্র্যাফিক, পারসোনেল, এবং অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মীদের আশঙ্কা নিরসন করতে বা আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেন নি রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সিআরবি)। উল্টে আরও বেড়েছে তাঁদের ক্ষোভ।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের আধিকারিকদের দাবি, ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে হাজার দশেক একই বয়ান লেখা পোস্টকার্ড পাঠানো হয়ে গিয়েছে। বয়ানে বলা হয়েছে, এই সংযুক্তিকরণ একটি "একতরফা" সিদ্ধান্ত, যেখানে নন-টেকনিক্যাল রেল আধিকারিকদের যথাযথ প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেওয়া হয় নি, যদিও এই আধিকারিকরা সিভিল সার্ভিসের মাধ্যমেই নিযুক্ত হয়ে থাকেন। আরও বলা হয়েছে, সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব বহাল থাকলে সরকার যেন এই আধিকারিকদের নিজেদের সার্ভিস পরিবর্তন করার সুযোগ দেয়।
আরও পড়ুন: রেল নিয়ে বড় সিদ্ধান্ত মোদী সরকারের, ছাঁটা হল বোর্ডের বহর
ভিডিও কনফারেন্সে উপস্থিত থাকা এক আধিকারিকের কথায়, "সিআরবি কীভাবে বলতে পারেন যে ট্র্যাফিক অফিসাররা কোনও কাজ করেন না? বা (রেলের) কোনোরকম সম্পত্তির দেখাশোনা বা সৃষ্টি করেন না? যে তাঁরা কোনও দুর্ঘটনাস্থল বা পরিদর্শনে যান না বা ফুটপ্লেট করেন না? অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট এবং হতাশাজনক।"
বৃহস্পতিবারই এই আটটি পরিষেবার সংযুক্তিকরণ ঘোষণা করে রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল এই সিদ্ধান্তকে "সর্বসম্মত" বলে বর্ণনা করেন, যা কিনা ৭ এবং ৮ ডিসেম্বর 'পরিবর্তন সংগোষ্ঠী' অনুষ্ঠানে দু-দিন ব্যাপী আলোচনার পরিণাম। আলোচনার মূল বিষয় ছিল, রেলে "বিভাগীয় বিভাজনের" অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ।
কিন্তু আধিকারিকদের একাংশের বক্তব্য, আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ১২টি দলের প্রতিটির নেতৃত্বে ছিলেন একজন করে জেনারেল ম্যানেজার, যাঁরা প্রত্যেকেই ইন্ডিয়ান এঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের (IES) কর্মী, ফলে ট্র্যাফিক, অ্যাকাউন্টস এবং পারসোনেল বিভাগের প্রতিনিধি-সংখ্যা ছিল নামমাত্র। অথচ এই বিভাগগুলি ভারতীয় রেলের ব্যবস্থাপক এবং প্রশাসনিক মেরুদণ্ড। ওই আধিকারিকরা আরও দাবি করেছেন যে দু-দিনের বৈঠকের কোনও মিনিটস (minutes) প্রকাশ করা হয় নি।
বর্তমানে রেলের আটটি পরিষেবার মধ্যে অ্যাকাউন্টস, পারসোনেল, এবং ট্র্যাফিক আধিকারিকদের নিয়োগ করা হয় ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (UPSC) মাধ্যমে, যে পরীক্ষায় 'নন-টেকনিক্যাল' এবং হিউম্যানিটিজ শাখার পরীক্ষার্থীরাও বসতে পারেন। ইলেক্ট্রিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, স্টোরস, মেক্যানিক্যাল, এবং সিগনালিং ও টেলিকম বিভাগের আধিকারিকরা আসেন IES থেকে।
ভারতীয় রেলের ২৭ জন জেনারেল ম্যানেজারের মধ্যে স্রেফ তিনজন নিযুক্ত হয়েছেন UPSC-র মাধ্যমে, যার সদস্য সংখ্যা ২,৫০০। এই প্রেক্ষিতে আধিকারিকদের বক্তব্য, অন্য কোনও সিভিল সার্ভিসে যাতে তাঁরা নিযুক্ত হতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা উচিত।
আরও পড়ুন: বাড়তে চলেছে ট্রেনের যাত্রী ভাড়া, ইঙ্গিত রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানের
এক উচ্চপদস্থ রেলকর্তা জানিয়েছেন, "বিবেক দেবরায় কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে সকলেই সমশ্রেণীভুক্ত না হলে স্রেফ একটি পরিষেবা কার্যকর হবে না। সুপারিশ ছিল দুটি পরিষেবার - একটি টেকনিক্যাল এবং অন্যটি নন-টেকনিক্যাল, যেটা করা উচিত।"
তাঁদের চিঠিতে আধিকারিকরা যুক্তি দিয়েছেন যে UPSC থেকে যেসব প্রার্থীদের বাছা হয়, তাঁদের মধ্যে প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষতা থাকে, এবং "...টেকনিক্যাল ও নন-টেকনিক্যাল পরিষেবার সংযুক্তিকরণের ফলে খর্ব হবে ব্যবস্থাপকের পদ, যার কাজ হলো জনগণের অর্থ জনগণের স্বার্থে ব্যয় করার পথ খুঁজে বের করা।"
এছাড়াও, UPSC-র মাধ্যমে নিযুক্ত আধিকারিকদের গড় বয়স হয় ২৭, যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে যাঁরা চাকরিতে ঢোকেন, তাঁদের গড় বয়স হয় ২৩-২৪ বছর।
আরেক আধিকারিকের প্রশ্ন, "যেখানে পরীক্ষার এবং কাজের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা, সেখানে দুটি পরিষেবাকে কীভাবে এক স্তরে নিয়ে আসা যেতে পারে? এর ফলে যেসব তরুণ অফিসার সদ্য চাকরিতে ঢুকেছেন, তাঁদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাঁরা গোটা রেল ব্যবস্থা চালাতে একই রকম পরিশ্রম করবেন, অথচ প্রোমোশনের সুযোগ কম পাবেন, কার্যত নিশ্চল হয়ে পড়বেন।"
তাঁদের বয়ানে আধিকারিকরা আরও জানিয়েছেন যে সংযুক্ত IRMS গঠন করলে তা প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী, কারণ UPSC-র মাধ্যমে নিযুক্ত হওয়ার সময় চাকরির শর্তাবলীর মধ্যে এটি ছিল না। রেল বোর্ডের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক বলেন, "একবার এই আটটি পরিষেবার পরিচালনা সংক্রান্ত সার্ভিস রুলজ গঠিত হয়ে গেলে সেগুলি পরিবর্তনের সময় একজন অফিসারের চাকরির ভবিষ্যতের ক্ষতি করা যাবে না। আমরা দেখব কীভাবে সবদিক রক্ষা করা যায়।" পারসোনেল বিভাগে রয়েছেন স্রেফ ২৫০ সরাসরি ডিরেক্ট অফিসার, যাঁরা UPSC-তে দ্বিতীয় বাছাই সার্ভিসে বদলির প্রস্তাব দেওয়ার কথা ভাবছেন সরকারকে।
এই আধিকারিকদের দাবি, রেলমন্ত্রী, পারসোনেল এবং প্রশিক্ষণ বিভাগের সচিব, ক্যাবিনেট সচিব এবং রেলের সমস্ত সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের বিষয়ে বৈঠক করতে হবে।