স্বামীর বিরুদ্ধে রাজ্য মহিলা কমিশনের কাছে মামলা করলেন স্ত্রী। এ আর এমন কী, হামেশাই হচ্ছে। কিন্তু ত্রিপুরার এই গৃহবধূর অভিযোগ এমনই অভিনব, যে এক লাফে খবরের শিরোনামে চলে এসেছেন তিনি। কী ব্যাপার? না, মামলার মূল কারণ হলো, ওই মহিলার স্বামী সারা বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছেন, মায় শোওয়ার ঘরে পর্যন্ত! তাঁর স্বামী অবশ্য জানিয়েছেন, 'আত্মরক্ষার স্বার্থে' ওই ক্যামেরা বসিয়েছেন তিনি।
পশ্চিম ত্রিপুরা জেলায় প্রতাপগড় এলাকার সাধুটিলা গ্রামের ঘটনা। অভিযোগকারীনী রত্না পোদ্দার (৩৮) তিন বছর আগে বিয়ে করেন ৪৭ বছর বয়সী রামনগরের বাসিন্দা চন্দনকান্তি ধরকে। বিয়ের আগে কোনোরকম সমস্যা হয়নি, পণও চাওয়া হয়নি। কিন্তু রত্না দেবীর দাবি, বিয়ের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পণের জন্য জোরজার করতে থাকেন তাঁর স্বামী।
"বিয়ের সময় উনি বা ওঁর পরিবার কোনও পণ দাবি করেন নি, কিন্তু বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির লোক পণের জন্য আমার ওপর অত্যাচার করতে থাকেন। আমার শাশুড়ি, দেওর, এমনকি পাড়ার লোক পর্যন্ত আমাকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে হেনস্থা করেন," ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান রত্না দেবী। তিনি আরও বলেন, তাঁর পরিবারের তরফে জমি বেচে তাঁর স্বামীকে দু'লক্ষ টাকা দেওয়া হয়, কিন্তু তাতেও থামে নি অত্যাচার। এছাড়াও তিনি সন্দেহ করেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে এক আত্মীয়ের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘জাতীয়’ অস্তিত্বের সংকটে তৃণমূল-সহ আরও দুই দল, কড়া নোটিস নির্বাচন কমিশনের
এসবের প্রতিবাদ করলে তাঁকে কড়া তিরস্কার করা হয় বলে অভিযোগ। অবশেষে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চার-কামরার বাড়িতে পাঁচটি সিসিটিভি ক্যামেরা বসান রত্না দেবীর স্বামী, যার ফলে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে তাঁর বলে জানিয়েছেন তিনি। ডিসেম্বর মাসে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান রত্না দেবী। তখন থেকে মায়ের কাছেই আছেন তিনি।
"সব জায়গায় ক্যামেরা - মেইন দরজায়, বারান্দায়, আমার শাশুড়ির ঘরে, আমাদের শোওয়ার ঘরে, এবং আরও একটা ঘরে। ক্যামেরার মনিটর আমার শাশুড়ির ঘরে রাখা। আমার ব্যক্তিগত জীবনে খুব বেশিরকমের হস্তক্ষেপ এটা। একজন মহিলা হিসেবে আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত রেকর্ড হচ্ছে, এমনকি ব্যক্তিগত মুহূর্তও, এটা অত্যন্ত অপমানজনক," বলেন রত্না দেবী।
তাঁর দাবি, একাধিক অনুরোধ-উপরোধেও কাজ না হওয়ায় ২ জুলাই তিনি চন্দনকান্তি ধরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান ত্রিপুরা কমিশন ফর উইমেন-এর কাছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগের তালিকায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ছিল গার্হস্থ্য হিংসা, পণের দাবিতে অত্যাচার, এবং পরকীয়া। বুধবার এই মামলার প্রথম শুনানির দিন তালিকায় যোগ হয় সিসিটিভি বসানোর বিষয়টিও।
আরও পড়ুন: বাবরি মামলার রায় ৯ মাসের মধ্যে
কমিশনের চেয়ারপার্সন বর্ণালী গোস্বামী বলেন, "এটি একটি বিরল এবং গুরুতর অপরাধ। একজন মহিলা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ঘরে অষ্টপ্রহর পাহারায় কীভাবে থাকতে পারেন? আমরা দুই তরফেরই বয়ান বুধবার শুনেছি, এবং তাঁদের দেড় মাস সময় দেওয়া হয়েছে বিষয়টি আরেকবার বিবেচনা করে দেখার জন্য। ইতিমধ্যে চন্দনকান্তি ধরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তিনি যেন তাঁর স্ত্রীর খোরপোশ বাবদ প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা করে দেন।"
চন্দনের বয়ান অবশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর বক্তব্য, "আমি নির্দোষ। না আমি কোনও পণ নিয়েছি, না আমার সঙ্গে কারোর অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। এই বিষয়ে আলোচনা করাও আমার পক্ষে অপমানজনক, কিন্তু এই গোটা ঘটনাটাই ঘটানো হয়েছে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে, কারণ বাড়ি ছাড়ার আগে আমার স্ত্রী আমাদের জেল খাটানোর হুমকি দিয়ে যান।" চন্দন আরও জানিয়েছেন যে তাঁর স্ত্রী সন্দেহ বাতিকে ভোগেন, এবং তাঁর, তাঁর মায়ের এবং অন্যান্য আত্মীয়ের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করে এসেছেন। তাঁর দাবি, তিনি সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছেন শুধুমাত্র "আত্মরক্ষার স্বার্থে", নিজের বক্তব্যের প্রমাণ রাখতে, এবং কোনোরকম "বিবেকহীন" অভিযোগ এড়াতে।
আরও পড়ুন: চিটফান্ড মামলায় আর্থিক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত মনসুর খান গ্রেফতার
কিন্তু শোওয়ার ঘরে ক্যামেরা বসানো কি একটু বাড়াবাড়ি মনে হয় নি? চন্দনের জবাব, তিনি গত বছর থেকেই আলাদা খাটে শুচ্ছেন, এবং ক্যামেরা তাঁর বিছানাটুকু ছাড়া আর কোনও কিছুর ওপরেই ফোকাস করত না। তাঁর কথায়, "আমি আত্মরক্ষার খাতিরে ক্যামেরা বসিয়েছি। আমার আর কিছু বলার নেই।"
প্রসঙ্গত, ভারতে ব্যক্তিগত স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর বিরুদ্ধে কোনও আইন নেই, বা তার জন্য কোনও অনুমতিরও প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যৌনতামূলক কার্যকলাপের উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ ক্যামেরা বসালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৪ 'সি' ধারা অনুযায়ী প্রথম অপরাধের জন্য এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত জেল, এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য সাত বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা হতে পারে। ব্যাক্তিগত জায়গা, যেমন শৌচালয় বা শোওয়ার ঘরে ক্যামেরা বসানোর ক্ষেত্রেও নানারকম আইনি বিধিনিষেধ রয়েছে।