শালিনী নায়ার
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর দেওয়া একটা তথ্য। ২০১৬ সালে দেশে শিশুধর্ষণের ঘটনায় পকসো আইন ও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা অনুসারে আদালতে মোট মামলার সংখ্যা ছিল ৬৪,১৩৮টি। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ১৮৬৯ টি মামলায়। অর্থাৎ ৩ শতাংশেরও কম ক্ষেত্রে অপরাধ সাব্যস্ত হয়েছে। আরও একটা তথ্য। ওই একই বছরে, অর্থাৎ ২০১৬ সালে, নারী ও শিশু ধর্ষণের মোট ৩৬৬৫৭ টি ঘটনার মধ্য়ে, ৩৪৬৫০টি ক্ষেত্রে, অর্থাৎ ৯৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তি ধর্ষিতার পরিচিত। এসব ক্ষেত্রে অপরাধী হয় পরিবারের ঘনিষ্ঠ, নয়ত প্রতিবেশী, অথবা অন্য কোনও পরিচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাস্তব পরিস্থিতি যখন এইরকমই, তখন শিশুকন্যা ধর্ষণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কিত প্রস্তাবিত আইন আনার আগে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার মনে করেন, ‘‘এরকম একটা আইন পাশ হলে যৌন নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে মুখ খোলার পরিমাণই কমে যাবে, যেহেতু পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউই বহু ক্ষেত্রে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। এর ফলে অপরাধ গোপন করার সম্ভাবনা বাড়বে, যাতে অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাবে এবং নিগৃহীতা আরও অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে।’’ গ্রোভার মনে করেন, তদন্ত প্রক্রিয়া আরও শক্তপোক্ত করা প্রয়োজন, প্রয়োজন আদালতে এবং আদালতের বাইরে যথাযথ পরিবেশ তৈরি করে, এবং সর্বোপরি শাস্তিদানের অনুপাত বৃদ্ধি। এগুলে না হলে এ ধরনের কড়া আইন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন, ১২ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুকে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! সায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার
পকসো আইন অনুসারে এক বছরের মধ্যে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার কথা। ২০১৬ সালের শেষে দেখা যাচ্ছে, ৮৯ শতাংশ মামলাতেই বিচার স্থগিত রয়েছে। অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার হার এত কম হওয়ার ঘটনা একটা জিনিস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যে শাস্তির পরিমাণ বেড়ে মৃত্যুদণ্ড হলেই অপরাধ কমবে, এমনটা নাও হতে পারে, কারণ আগে অপরাধ সাব্যস্ত হতে হবে, শাস্তিদান প্রক্রিয়া আসবে তার পরে।
২০১২ সালের গণধর্ষণের ঘটনার কথা উল্লেখ করে বৃন্দা গ্রোভার মনে করিয়ে দিয়েছেন, তারপরেও কিন্তু এধরনের অপরাধের ঘটনা কমেনি। চাঁছাছোলা ভাষায় তিনি বলেছেন, ‘‘সমালোচনা ভোঁতা করার জন্য এ ধরনের গিমিকের আশ্রয় নিচ্ছে সরকার।’’
১২ বছরের নিচের শিশুকন্যা ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টির অনুমোদনের জন্য পকসো আইনের ৪২ নং ধারা এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারায় সংশোধনের পাশাপাশি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ও ৩০৯ ধারাতেও বদল আনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সে প্রস্তাবে বলা হয়েছে ধর্ষণের ঘটনায় ২ মাসের মধ্যে পুলিশি তদন্ত ও বিচার সম্পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু ২০১৩ সালেই এ সম্পর্কিত সংশোধনী আনা হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল সমস্ত ধরনের ধর্ষণের ক্ষেত্রেই বিচারপ্রক্রিয়া ২ মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে, এবং শিশুধর্ষণের ঘটনায় ৩ মাসের মধ্যে পুলিশি তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে।
বৃন্দা গ্রোভার বলছেন, আইন সংশোধন ততদিনই অর্থহীন থাকবে, যতদিন পুলিশি তদন্তের মানোন্নতি না ঘটে, এবং ‘‘বিচারকরা শিশুর উপর ঘটা যৌন নিগ্রহ অথবা লিঙ্গসংক্রান্ত অপরাধ বিষয়ে যথাযথ ভাবে প্রশিক্ষিত না হন।’’
২০১২ সালের দিল্লি গণধর্ষণ মামলার পর গঠিত বিচারপতি ভার্মা কমিশনের দেওয়া রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ডাদেশ হবে একটা পশ্চাদগামী পদক্ষেপ। ওই প্যানেলের বক্তব্য ছিল, মারাত্মক অপরাধের ঘটনায় কড়া শাস্তির বিধান থাকলে অপরাধের পরিমাণ কমে, এটা একটা মিথ মাত্র।
আরও পড়ুন, ফের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ, এবার ঘটনাস্থল মধ্যপ্রদেশ
যদিও ২০১২ সালে দেশজোড়া যে হৈচৈ শুরু হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ইউপিএ সরকার আইন সংশোধনীতে কয়েকটি ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আনে।
সংশোধনী আইন অনুসারেই ২০১৪ সালে মুম্বই শক্তি মিলস গণধর্ষণের ঘটনায় ৩ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।
মজলিস লিগ্যাল সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত আইনজীবী পারসিস সিদ্ধা, শক্তি মিলস গণধর্ষণের ঘটনায় নিগৃহীতার পক্ষে দাঁড়ালেও মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। তাঁর মতে, এ ধরনের আইন কার্যকর হলে নিগৃহীতার উপরে চাপ বাড়বে, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা নির্যাতিতার পরিচিতই হয়ে থাকে। এর পর নির্যাতিতা মুখ খুলতে চাইবে না বলে করেন তিনি।
বিচারকের সংখ্যা যেহেতু বাড়ছে না তার ফলে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের প্রস্তাবেও খুব একটা উপকার হবে না বলেই সিদ্ধা মনে করছেন। একই সঙ্গে এ ধরনের অপরাধের ঘটনাকে যথাযথভাবে পরিচালনা করার ক্ষমতাসম্পন্ন আইনজীবীর সংখ্যাও অপ্রতুল বলেই মনে করেন তিনি।
দিল্লির ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটি প্রকাশিত ‘ডেথ পেনাল্টি ইন্ডিয়া রিপোর্টঃ ২০১৬’ তে দেখানো হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ আদালত যেসব ধর্ষণের ঘটনায় নির্যাতিতের মৃত্যু হয়নি, তেমন অপরাধের ক্ষেত্রে, তা নাবালিকার সঙ্গে সংঘটিত হলেও, মৃত্যুদণ্ডের বিধান অসাংবিধানিক বলে বর্ণনা করেছে।
ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটি মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ৩৭৩ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখিয়েছে, এদের মধ্যে ৭৪ শতাংশই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। ২৩ শতাংশ কোনওদিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। আর প্রাথমিক পড়াশুনো শেষ করেছে ৯.৬ শতাংশ।
আরও পড়ুন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট, বিচারব্যবস্থার পক্ষে কালো দিনঃ নরিম্যান