দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের অসম্পূর্ণ টীকাকরণ নিয়ে ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছে রাষ্ট্রসংঘ। এদিকে করোনা আবহে শিশুদের টীকাকরণ বন্ধ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। কলকাতার বিশিষ্ট শিশু রোগ বিশেষজ্ঞদের এক বড় অংশ এই টীকাকরণ বন্ধ হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শিশুদের ক্ষেত্রে দেড় মাসের টীকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
রাষ্ট্রসংঘের আয়ত্তাধীন ইউনাইটেড নেশনস চিলড্রেনস ফান্ড (ইউনিসেফ) বিশ্ব জুড়ে কোভিড-১৯ লকডাউনের জেরে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে এই টীকাকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর ফলে ঘোর বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে রাষ্ট্রসংঘ মনে করছে। এই শিশুদের ৪৫ লক্ষের বাস ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে এরাজ্য়ে সরকারি স্তরেও শিশুদের টীকা বন্ধ রয়েছে। গ্রামীণ স্তরে গর্ভবতী মায়েদের টিটেনাস দেওয়াও আপাতত বন্ধ বলে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন- কলকাতাতেই আবিষ্কারের পথে করোনার ওষুধ, বিশ্বকে আশার আলো দেখাচ্ছেন বাঙালি গবেষকরা
বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ এই টীকাকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় উদ্বিগ্ন। ডাঃ ঘোষ বলেন, "যখন কোনও জিনিস দেওয়া হয়, তখন তার তো কিছু উপকারিতা থাকে। তা না নিলে তার অপকারিকতাও থাকে। শিশুদের আর্লি ভ্য়াকসিন নেওয়া খুব জরুরি। ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হুপিং কাশি, আরও দুটি হেপাটাইটিস-বি ও এইচ ওয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক দেওয়া হয় ৬ মাসের মাথায়। ইঞ্জেকশন না দিলে হেপাটাইটিস-বি হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু হাওয়ার মাধ্যমে যে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে, সেগুলো নিয়ে চিন্তা আছে। হুপিং কাশি খুব অল্প বয়সে হয়। যেহেতু মায়ের থেকে কোনও প্রোটেকশন সন্তান পায় না। তাই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।"
তাঁর ব্যাখ্যা, "ধরুন একটা বাচ্চা করোনাভাইরাসের অ্যাসিম্পটোম্যাটিক ক্যারিয়ার। তার শরীরে এইচ ওয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা হুপিং কাশির জীবাণু ঢুকে গেল। তখন দুটো মিলিয়ে বড় সমস্যা হবে। অন্তত পক্ষে রেসপেরিটরি ভ্যাকসিন যেগুলি, যেমন হুপিং কফ, তারপর ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া। রাজ্য সরকার নিউমোনিয়া ভ্যাকসিনটা দেয় না। তারপরে এমএমআর, যার মধ্যে মিজলস (হাম) আছে। এই সময় মিজলস হলে খুব অসুবিধা হবে। ফ্লু ভ্যাকসিন সরকার দেয় না। কিন্তু অনেকে প্রাইভেটে নেয়। ফ্লু আর করোনা একসঙ্গে হলেও খুব অসুবিধা হবে।"
করোনা পরিস্থিতিতে রাজ্য়ের প্রায় সর্বত্র টীকাকরণ কর্মসূচি বন্ধ রাখতে হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, কিছু ক্ষেত্রে টীকা দেওয়া নিয়ে উদ্য়োগ নেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে তারা খুব সতর্ক। টীকা না দেওয়া নিয়ে বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ এস আর বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্পষ্ট বক্তব্য, "আমাদের কিছু করবার নেই। কিছু বলবার নেই। এটুকু বলতে পারি, এটা বন্ধ করা উচিত নয়।" তবে বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রিয়ঙ্কর পাল মনে করেন, "এখন বাড়িতে থাকার ফলে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাচ্চা ও বাবা-মায়েরা বাড়িতেই আছেন। বাইরে থেকে ইনফেকশন না নিয়ে এলে সমস্যা নেই। একটু দেরি হলে বিশাল সমস্যা হবে না। তবে তিন-চার মাস দেরি হলে অসুবিধা হতে পারে।"
আরও পড়ুন- করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে পারে হেপাটাইটিস সি-এর প্রতিষেধক
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সন্তান জন্মানোর ৬ সপ্তাহ পর পেন্টাভ্য়ালেন্ট ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। এই ভ্যাকসিনে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হেমোফিলিস ইনফ্লুয়েঞ্জা, হুপিং কাশি, হেপাটাইটিস-বি প্রতিরোধ করে। এছাড়া একইসঙ্গে পোলিও প্রতিষেধক ওপিভি ও আইপিভি দেওয়া হয়। খাওয়ানো হয় রোটা ভাইরাসের প্রতিষেধক। এরপর ১০ সপ্তাহ, তারপর ১৪ সপ্তাহে ফের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ৯ মাসে দেওয়া হয় মিজলস ও রুবেলার প্রতিষেধক এমআর, জেই জাপানী এনকেফালাইটাইসের জন্য়। এর সেকেন্ড ডোজ দেওয়া হয় ১৬ থেকে ২৪ মাসে। ডিপিটি ও ওপিভি। এইসময় ভিটামিন-এ তেলও খাওয়ানো হয়। তারপর ফের দেড় বছরে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয় ট্রিপল অ্যান্টিজেন। এভাবেই এরপর আরও টীকাকরণ রয়েছে।
স্বাস্থ্যকর্মীরাও চাইছেন, শিশুদের টীকাকরণ কর্মসূচি চালু করতে। তবে প্রয়োজনীয় সতর্কতা বিধি ও পর্যাপ্ত পরিকাঠামো চাইছেন তাঁরা। ওয়েষ্ট বেঙ্গল এএনএমআর অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফ রিভাইজড এমপ্লয়ীজ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদিকা রেখা সাউ বলেন, "আমরাও চাইছি টীকারকরণ কর্মসূচি চালু হোক। তবে পরিকাঠামোগত ভাবে ভ্যাকসিনেশনের একটা সমস্যা আছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির ঘরগুলি ছোট ছোট। শিশুদের প্রতিষেধক দেওয়ার পর আধঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সেই সব কথাও ভাবতে হবে। তাছাড়া করোনা আতঙ্ক তো রয়েছেই। শিশুর সঙ্গে বাড়ির লোকও আসবেন। সর্বত্র কোভিড-১৯ পরীক্ষা হয়েছে এমনও নয়। অনেক ব্লকে বুধবার টীকার কথা বলা হয়েছে। আমরা যথেষ্ট পরিমানে পিপিই ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের যোগান দিতে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে দাবি জানিয়েছি। পরিকাঠামোর সমস্যার কথাও বলেছি।" যদিও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা এ নিয়ে কোনও কোনও মন্তব্য করেন নি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন