পেট্রোপণ্যের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি, সঙ্গে নাছোড় বৃষ্টি এই দুইয়ে লক্ষ্মীপুজোতে নাস্তানাবুদ অবস্থা মধ্যবিত্ত বাঙালির। নির্ঘণ্ট অনুসারে আজ মঙ্গলবার এবং আগামীকাল বুধবার দু’দিনই পালিত হবে এবারের লক্ষ্মীপুজো। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে। এদিকে পুজোর আগেই আমজনতার নাভিশ্বাস বাড়িয়ে উৎসবের মরসুমে পুজোর বাজার আগুন। সবজি থেকে শুরু করে ফলের বাজার হাত ছোঁয়ালেই ছ্যাঁকা খাচ্ছেন আমজনতা, আগুন দাম ফুল এবং ঠাকুরও। লক্ষ্মীপুজোর আগেই এভাবে লাগামছাড়া মুল্যবৃদ্ধিতে রাতের ঘুম উড়ে যাওয়ার জো মধ্যবিত্ত বাঙালির। সবজী-ফলের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঠাকুরের দাম। গত বারের থেকে ছোট এবং প্রমাণ সাইজের ঠাকুরের দাম বেড়েছে। সঙ্গে করোনার রক্তচক্ষু, এসবের মধ্যেই চলছে বাঙালির লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন।
রজনীর মালা দেদার বিকোচ্ছে ১০০ থেকে ২০০ টাকাতে। পদ্ম এক পিস বিকোচ্ছে ২৫ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে। পুজোর জোগাড় করতে রীতিমতো বাজারে গিয়ে ছ্যাঁকা খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। লক্ষ্মীপুজোর পরেই কালীপুজো, ফি বছর উৎসবের মরশুমে বাজারে গিয়ে নাজেহাল হতে হয় সাধারণ মানুষকে। এবারেও তার ব্যতিক্রম নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতাদের অভিযোগ, সুযোগ বুঝে চড়া দাম হাঁকাচ্ছেন দোকানিরা। অন্যদিকে দোকানিদের কথায়, পেট্রোপণ্যের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির ফলেই বাজারে ফল-সবজির দাম আকাশছোঁয়া।
পেট্রোল-ডিজেল থেকে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার, ভোজ্য তেল দামের নিরিখে প্রতিযোগিতা রোজই অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উৎসবের মরশুমে বাজার করতে গিয়ে ছ্যাঁকা খাওয়ার জোগাড় ভোজনপ্রিয় বাঙালির। পেট্রোপণ্যের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি আর দফায় দফায় বৃষ্টির জেরে কার্যত হাত দেওয়া যাচ্ছে না কোনও সবজিতে। পুজোর সময় যে পেঁয়াজ ছিল, ৩৫-৩৭ টাকা প্রতি কেজি, লক্ষ্মীপুজো আসতেই টি-টোয়েন্টি স্টাইলে ব্যাটিং করে সেই পেঁয়াজ এখন হাফসেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। দুরন্ত ফর্মে মধ্যবিত্তের পকেটে জ্বালা ধরাতে পিছিয়ে নেই পটলও, ৬০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে পটলের দাম। অন্যান্য সবজিও মধ্যবিত্তের পকেটে জ্বালা ধরাতে পিছিয়ে নেই।
টমেটো ৮০ টাকা কেজি। সেই সঙ্গে ক্যাপসিকাম ১৮০ থেকে ২২০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিকোচ্ছে বাজারে। ধনেপাতা ৩০০ টাকার আশেপাশে প্রতি কেজি ঘোরাফেরা করছে। সজনে ডাঁটা বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে। বিনস ১৫০ টাকা কেজি। পালং শাক ১০০ টাকা কেজি। একটু ভাল ফুলকপি নিতে হলে এক পিসের জন্য গুনতে হবে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। করোনাকালে কাজ গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। রোজগার যে কত লোকের কমে গিয়েছে, তার হিসেব নেই। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও মূল্যবৃদ্ধির বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত। বাজারে ঢুকে নাভিশ্বাস ফেলছে সাধারণ মধ্যবিত্ত।
আরও পড়ুন: ১৯৪৭-এ পথ চলা শুরু, এবারও লক্ষ্মীপুজোয় প্রকাশের পথে হাতে লেখা সাহিত্য পত্রিকা
আবার এক পিস নারকেলের দাম ৫০ থেকে ৬০ যা কিনতে গিয়ে কাল ঘাম ছুটছে সকলের। ফল ও শাকসবজির দামও এই দিন বিক্রেতারা সুযোগ বুঝে হেঁকেছেন। ফলের মধ্যে, মর্তমান কলা ডজন প্রতি ৩০ টাকা থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে, আপেল ৯০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা কেজি। পেয়ারারও দাম ৩০-৬০ প্রতি কেজি, নাসপাতি ৪০-৫০ টাকা।
অন্যান্য ফলের দামও আর পাঁচটা দিনের চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল এই দিন। দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া, হাওড়া, হুগলি থেকে সবজি আসে কলকাতার বাজারে। জেলাগুলিতে সবজি চাষের ক্ষতি হওয়ায় দাম আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বেড়েছে জ্বালানির দাম। লিটার প্রতি ৩৪ পয়সা বেড়েছে পেট্রলের দাম। কলকাতায় পেট্রলের দাম ১০৬ টাকা ১০ পয়সা। লিটার প্রতি ৩৫ পয়সা মূল্যবৃদ্ধি ডিজেলের। কলকাতায় ডিজেলের দাম ৯৭ টাকা ৩৩ পয়সা। বাজারের এই মুল্যবৃদ্ধির জন্য জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকেই কার্যত দুষছেন ব্যবসায়ীরা। লক্ষ্মী আরাধনার আয়োজন করতে গিয়ে কার্যত গলদঘর্ম অবস্থা মধ্যবিত্ত বাঙালির।
এ দিন কলকাতার বিভিন্ন বাজারে মাঝারি সাইজের লক্ষ্মীপ্রতিমা ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। একটু ছোট সাইজের লক্ষ্মীপ্রতিমার দাম ৯০ টাকা থেকে ১৫০ টাকার মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে। একটু বড় সাইজের লক্ষ্মীপ্রতিমা ৪০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এদিন বাজারে লক্ষ্মীর বড় সরার দাম ছিল ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। লক্ষ্মীর ছোট সরার দাম ৬০ থেকে ৯০ টাকার আশেপাশে।
করোনা কালে গত বছর সেভাবে ব্যবসা হয়নি প্রতিমা বিক্রেতাদের। এবারের ধনদেবী মুখ তুলে তাকাবেন এই আশায় ঠাকুর তুলেছিলেন প্রতিমা বিক্রেতা পলাশ পাল, তার কথায়, ‘গত বছর করোনা আবহে সেভাবে ব্যাবসা হয়নি, এবারে বাড়তি মুনাফা লাভের আশায় প্রায় ২৫০ মতো ঠাকুর তুলেছিলাম বিক্রির জন্য, কিন্তু বৃষ্টির জন্য ক্রেতারা আসতে সমস্যায় পড়ছেন, এভাবে চলতে থাকলে এবছরেও লাভের মুখ আর দেখা হবে না। একই সমস্যার মুখে পড়েছেন ক্রেতারাও।
আরও পড়ুন: লক্ষ্মীপুজোর আগে ৭০০ ছুঁইছুঁই রাজ্যের দৈনিক করোনা সংক্রমণ! শীর্ষে সেই কলকাতা
সকালে বৃষ্টির কারণে সেভাবে বেরোতে পারেননি অনেকেই, ভেবেছিলেন বিকেলের দিকে বৃষ্টি একটু কমলে পুজোর বাজার সেরে নেবেন, কিন্তু বিকেল থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি তাদের সেই আশাতে জল ঢেলে দিয়েছে। উপায় না দেখে ছাতা মাথায় করেই এবারের পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছেন ক্রেতারা। তবে এবারের পুজোর সূচী দু’দিন হওয়ায় বিক্রেতারা শেষ মুহূর্তের ভিড়ের অপেক্ষায় কিছুটা আশাবাদী। এদিকে হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী রাজ্যে আজ ও আগামীকাল বৃষ্টির সম্ভবনা রয়েছে।
কয়েক বছর যাবৎ লক্ষ্মীপুজোর সময়ে বহু পরিবারের লোকজনই বাড়িতে তৈরি করার বিভিন্ন অসুবিধে থাকায় বাজার থেকে নারকেল ও তিলের নাড়ু, মুড়ি ও খইয়ের মোয়ার প্যাকেট কেনেন। দাম বেশি হলেও সে সবের বিক্রি অনেকটাই বেড়েছে। ফলে, দাম চড়েছে প্যাকেটবন্দি নাড়ু, মোয়ারও। এক পিস নারকেল নাড়ু বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৮ টাকার দামে।
রজনী থেকে শুরু করে গেঁদার মালা বিকোচ্ছে চড়া দামেই। বাজারে মাঝারি সাইজের রজনীগন্ধা মালা বিকোচ্ছে ৬০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে, একটু বড় মালা ১৫০ টাকা। প্রমাণ সাইজের জোড়া গাঁদাফুলের মালা ২৫ থেকে ৩০ টাকা। একপিস মাঝারি মানের পদ্মের দাম ২৫ টাকা। ভাল পদ্ম বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা প্রতি পিস। ফুল বিক্রেতা স্বপন দাসের কথায়, "এখন টানা পুজোর মরশুম চলছে এমনিতেই বাজার চড়ে থাকে,আর লক্ষ্মী পুজো বলে কথা একটু বাজার না উঠলে উপায় নেই"৷
এদিন সন্ধ্যায় শিয়ালদহে লক্ষ্মীপুজোর বাজার করছিলেন নিউ ব্যারাকপুরের অনিতা মাঝি, তাঁর কথায়, ‘কলকাতায় তুলনায় দাম একটু সস্তা থাকে তাই কলকাতাতে পুজোর কেনাকাটি করতে আসা, তবে এবারের বাজার দর গতবারের থেকেও তুলনায় বেশি’। তিনি আরও বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি ও তার পর দীর্ঘ লকডাউন। এ সবের জেরে আর্থিক টানাটানি চলছে বহু পরিবারে। তার উপর সদ্য সমাপ্ত হয়েছে দুর্গাপুজো। এসবের মধ্যে ধন-সম্পদের দেবীর পুজোয় অর্থ সংকটই বড় সমস্যা’। তবে এসবের মধ্যেও পুজোর আয়োজন চলছে জোরকদমেই। উৎসব শেষে রাজ্যে ফের ঊর্ধ্বমুখী করোনা গ্রাফ। বৃষ্টি মাথায় করেই সেসবের তোয়াক্কা না করেই বাজারে ভিড়ের মধ্যে মাস্ক ছাড়াই চলছে দেদার বিকিকিনি। ধনদেবীর আরাধনায় কোনও খামতি রাখতে নারাজ উৎসব প্রিয় বাঙালি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন