Advertisment

সোশ্যাল মিডিয়া ও 'মি টু' অভিযোগ; কোথায় দাঁড়িয়ে সমাজ, কী বলছে আইন?

"একটা লোকের তিল তিল করে গড়ে তোলা ভাবমূর্তি যখন ধ্বসে যায়, তার চেয়ে বেশি শাস্তি আর কিছু হতেই পারে না," সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় এক বাংলা ব্যান্ড প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে ফেসবুকে মুখ খোলা এক তরুণী তেমনটাই মত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

বাংলা সোশ্যাল মিডিয়া বিগত কয়েক দিন ধরেই একের পর এক 'মি টু' অভিযোগ নিয়ে সরগরম। নাট্য ব্যক্তিত্ব সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠা দিয়েই শুরুটা হয়েছিল। এর পর সমাজের নানা ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরপর যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগকারী আইনি লড়াই-এর পথে না হেঁটে সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযুক্তকে চিহ্নিত করতে চাইছেন। ফলস্বরূপ সোশ্যাল মিডিয়ায় দু'ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এক, থানায় অভিযোগ হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দোষী ধরে নিয়ে তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করা হচ্ছে। দুই, 'এত মহিলা থাকতে এঁকেই যৌন হেনস্থা কেন?' ধরনের প্রশ্ন উঠছে।

Advertisment

"একটা লোকের তিল তিল করে গড়ে তোলা ভাবমূর্তি যখন ধ্বসে যায়, তার চেয়ে বেশি শাস্তি আর কিছু হতেই পারে না," সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেঙ্গালুরু নিবাসী এক বাংলা ব্যান্ড প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে ফেসবুকে মুখ খোলা এক তরুণী কিন্তু তেমনটাই জানিয়েছিলেন। একই সুরে কথা বলেছেন অনেক অভিযোগকারীই।

আরও পড়ুন, পরপর যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ, ভাবমূর্তি ভেঙে পড়ছে ব্যান্ড প্রতিষ্ঠাতার

ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় 'অভিযুক্ত' এক ব্যক্তি ফেসবুকেই ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা চাওয়ার পোস্টটি অবশ্য একাধিক বার মুছে ফেলা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। আবার কখনও কখনও ফিরেও আসছে সেই ব্যক্তির ওয়ালে। আরেক ব্যক্তি ফেসবুকে পোস্ট করে জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগের প্রতিবাদে তিনি আদালতে যাবেন। এ ধরনের সাম্প্রতিক এক ঘটনায় এক বাচিক শিল্পীর বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনে পরে সেই পোস্ট তুলে নেন এক মহিলা। কিন্তু ততক্ষণে সেই পোস্টের কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। একাধিক সংবাদ মাধ্যমেও বিষয়টি আলোচিত হয়ে গিয়েছে।

এ বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের সঙ্গে। অরুণাভবাবু এই প্রসঙ্গে জানালেন, "থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। স্থানীয় থানায় সাইবার সেল রয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, অভিযোগকারীর সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া বয়ান এবং পুলিশকে দেওয়া বয়ান কিন্তু মিলতে হবে। আর ঘটনার গুরুত্ব বিচার করে পুলিশ বেশ তাড়াতাড়ি ব্যবস্থাও নেয়। কিন্তু অভিযোগকারীর অভিযোগ ছাড়া পুলিশ যৌন হেনস্থার অভিযোগ সংক্রান্ত স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করতে পারে না। অভিযোগকারীকে এফআইআর করে জানাতে হবে যে তাঁকে যৌন হেনস্থা করা হয়েছে। থানায় অভিযোগ দায়ের না করলে কিন্তু 'অভিযুক্ত' বলা যায় না, আর অভিযুক্ত হওয়ার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় অপমানিত হওয়ার বিরুদ্ধে যে কোনও ব্যক্তি প্রতিবাদ করতে পারেন।"

আরও পড়ুন: ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ, ধৃত নাট্যকার সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়

মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষক ঝুমা বসাক ঘটনাটিকে দেখছেন একটু অন্যরকম ভাবে। তিনি বললেন, "এ ধরণের ঘটনা একটু জটিল। এত সহজে 'ভাল', 'খারাপ' বলা যায় না। শুধু যৌন হেনস্থার কথা বলছি না, যে কোনও ঘটনাতেই বলছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট করার ব্যক্তিস্বাধীনতা আমাদের সবারই আছে। তবে এ ক্ষেত্রে একটু দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে। প্রপার গ্রাউন্ড না থাকলে প্রথমে এক ধরনের পোস্ট দিয়ে তুলে নেওয়াটা উচিৎ না একেবারেই। কারণ ঘটনার সঙ্গে অন্য একজন মানুষ জড়িয়ে। আরও পাঁচজন মানুষও সেটা পড়ছেন।"

অবশ্য পাল্টা যুক্তিও দিয়েছেন ঝুমা। তাঁর কথায়, "তবে আমি বলব, আমরা কেন ধরেই নিচ্ছি পোস্ট তুলে নেওয়া মানেই ঘটনা ভিত্তিহীন? আমরা অভিযোগকারীকে একটা ভরসা কেন দিতে পারছি না? আমরা জানি অভিযোগকারী মূলত এফআইআর করতে ভয় পান, কারণ সেক্ষেত্রে সমস্ত ঝামেলা তাঁর ওপর দিয়েই যায়। আমাদের চারপাশের অবস্থাটা অভিযোগকারীকে ভরসা দিতে পারছে না, যে আইন তাঁর পক্ষেও থাকতে পারে। বরং প্রথম থেকেই তাঁকে বোঝানো হচ্ছে, আইনি লড়াই লড়তে গেলে অনেক বাধা আসবে তাঁর সামনে।"

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে তিনি আরও বললেন, "যৌন হেনস্থা অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং গভীর একটি ব্যাপার। এরকম আচরণ সমাজে প্রভাবশালী কারোর কাছ থেকে এলে তা উচ্চারণ করতেও অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তবে যাঁরা এই আচরণ সামনে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমার অনুরোধ, দায়িত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত নিন। আর সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়াও এখানে খুব সহজে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আমাদের সমাজে, বিশেষ করে অধিকাংশ মেয়ের জীবনে, যৌন হেনস্থার ঘটনা একাধিকবার ঘটে, পারিবারিক জীবনে, পেশাগত জীবনে। একই ধরনের কোনও ঘটনার কথা জানতে পেরে মানুষের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া অপরিণত হওয়া অস্বাভাবিক নয়, একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়ে নিজের ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন অনেকেই।"

'সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল'। বহু ব্যবহারের ফলে এই শব্দবন্ধ ইদানীং আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এ সম্পর্কে ঝুমার অভিমত, "অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই কাউকে 'অভিযুক্ত' তকমা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার আপত্তি আছে। এখানেই একটা লাগাম দরকার। একটু দায়িত্ব নিতে হবে দু'পক্ষকেই। যেখানে আমার একটা পোস্টকে কেন্দ্র করে এত মানুষের এত যুগের একটা প্রতিবাদের ভাষা উঠে আসছে, সেখানে একবার এগিয়ে পিছিয়ে আসাটা বন্ধ করতে হবে। এটা হালকা বিষয় নয়।"

Facebook Social Media
Advertisment