সবার চোখ তখন টিভির দিকে। দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্তান পার্কের সেই ক্যাফেতে তখন ভিড় জমিয়েছেন ওঁরা। যেন পরীক্ষার ফল বেরনোর অপেক্ষা। পাশ করব তো? সেই ধুকপুকুনি চলছিল তখন ওঁদের। তবে আত্মবিশ্বাস ছিল, যে জিতবই। কিছুক্ষণ পরই টিভির পর্দায় ব্রেকিং নিউজে যখন ফ্ল্যাশ করল, ‘সমকামিতা অপরাধ নয়, ঐতিহাসিক রায় সুপ্রিম কোর্টের’, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস শুরু হল ওই একরত্তি ক্যাফেতে। কেউ হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। কেউ একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন। কেউবা তাঁর সেই প্রিয় মানুষটির গালে ঠোঁট ঠেকালেন। আর এভাবেই স্মরণীয় হয়ে রইল শহরের ওই ক্যাফের সেলিব্রেশনের মুহূর্ত।
সমকামিতা নিয়ে যুগান্তকারী রায় জানার পর যখন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল শহরের ওই ক্যাফে, তখন তিনি নিজের সঙ্গেই একান্তে সময় কাটাচ্ছিলেন। রায় শোনামাত্রই বলে ফেললেন, "খুব খুশি হয়েছি। এতদিন ধরে অপেক্ষা করেছিলাম কবে এই রায় শুনব।" তিনি মানে মেঘ সায়ন্তন ঘোষ, যিনি এই মুহূর্তে টক অফ দ্য টাউন। সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার সঙ্গে শেয়ার করলেন তাঁর মনের কথা।
অবশেষে অপেক্ষার অবসান হল, তাই তো?
মেঘ: হ্যাঁ, তা তো বটেই। রায় শুনে খুব আনন্দ পেয়েছি। তবে এটা শুধুমাত্র আমার নিজের আনন্দ নয়। গোটা এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের জয়। তার থেকেও বড় কথা এটা আমাদের দেশের জয়।
লড়াইটা তো খুব কঠিন ছিল...
মেঘ: হুম, (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) কঠিন তো ছিলই। যখন আমি রূপান্তরকামী হইনি, তখন আমি নিজেকে সমকামী হিসেবেই রিপ্রেজেন্ট করেছি। পরে বিশদে জানলাম সবকিছু। আমাদের সময়ে এসব নিয়ে সমাজের কাছে কোনও গ্রহণযোগ্যতাই ছিল না। অনেক টিটকিরি সহ্য করতে হয়েছে। ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম, তখন সবাই 'হোমো' বলে ডাকত, খুব খারাপ লাগত। একটা সময়ে অনেকে আমায় দেখে হাসাহাসি করতেন, বিদ্রুপ করতেন। আমার মনে হয়, যাঁরা এসব করতেন, তাঁদের হয়তো এই রায় শুনে বোধোদয় হবে। তবে এটা ভেবে ভাল লাগছে যে আগামী প্রজন্মের জন্য লড়াইটা অনেক সহজ হয়ে গেল। আমরা যা কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, ওদের হয়তো আর সেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে না।
সমকামীদের বাবা-মা, পরিজনদের আড়ষ্টতা কাটবে কি?
মেঘ: সুপ্রিম কোর্ট জনতার পক্ষে রায় দিয়েছেন, যেটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আমার মনে হয়, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েরাও আরও সহজ হবেন। আড়ষ্টতা তৈরি হয় সমাজের মানসিকতার জন্যই। যেহেতু আইনি জায়গা তৈরি হচ্ছে, ফলে, ধীরে ধীরে আমার মনে হয় তাঁদের মানসিকতা বদলাবে।
সুপ্রিম রায় নিয়ে মুখ খুললেন মেঘ সায়ন্তন ঘোষhttps://t.co/3LbSQV0H4Y#Section377 #SupremeCourt #377Verdict #Sec377 #LGBT pic.twitter.com/2MsjH6gIz8
— IE Bangla (@ieBangla) September 6, 2018
রায় শুনে আপনার বাবা-মা কী বললেন?
মেঘ: সেভাবে বিশেষ কিছু জানায়নি। তবে এখন বাবা-মা আরও বেশি আমায় নিয়ে গর্ববোধ করছেন।
লোকে বলে, সমকামী সম্পর্কে কোনও কমিটমেন্ট থাকে না। আজকের রায়ের পর কি এই অপবাদ ঘুচবে?
মেঘ: দেখো কমিটমেন্ট ব্যাপারটা ব্যক্তি মানুষের উপর নির্ভর করে। একটা ছেলে-মেয়ের সম্পর্কেই আজকাল কতটা কমিটমেন্ট থাকে? বাইসেক্সুয়াল যাঁরা, তাঁরা মনে করতেই পারেন যে এই সম্পর্কের কোনও ভবিষ্যত নেই। আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, বাইসেক্সুয়াল পুরুষদের মানসিকতাই হল, গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব। মেয়েদের না পেয়েই সমকামীদের কাছে আসেন এঁরা। তাই এদেঁর মানসিকতাই থাকে সম্পর্ক থেকে বেরোনোর। অনেক সময় সামাজিক বা পারিবারিক ভয়ে সম্পর্কে এগোতে পারেনি। তবে এই রায়ের ফলে সেই ভয় কাটবে। 'হোমোফোবিয়া' বলে যেটা ছিল সেটা অনেকটাই কাটবে।
আইনজীবী হিসেবে এই রায়কে কীভাবে দেখছেন?
মেঘ: এটা একটা ইতিহাস তৈরি হল। স্বাধীনভাবে যৌন সংসর্গ হয় না বলেই এত ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে আমাদের দেশে। এই রায়ের ফলে এসব বর্বোরচিত ঘটনা অনেকটা কমবে বলেই আমার মত। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, সমলিঙ্গের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হলে তাতে দু’জনের অনুমতি থাকতে হবে। তবে জন্তুদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ কিন্তু অবশ্যই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। আজকের রায়ের ফলে একটা অধিকার চলে এল। ফলে ভবিষ্যতে, সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বা সন্তান দত্তক নেওয়ার পথও অনেকটা সহজ হল এদেশে।
এই রায়ের ফলে রক্ষণশীল সমাজ কি মেনে নেবে সমকামিতাকে?
মেঘ: সুপ্রিম কোর্টের রায়কে মানতে বাধ্য সকলেই। আমার বিশ্বাস এই রায়ের ফলে সমাজ ধীরে ধীরে বদলাবে।