Advertisment

এনআরএসে বেড়ে উঠছে 'নীলরতন সরকারের নাতি'

নীলরতন সরকার হাসপাতালে সবার চোখের মণি নামগোত্রহীন এক শিশু। জন্মের পর যাকে রেল লাইনের ধারে ফেলে দেওয়া হয়। যার রোগগ্রস্ত ছোট্ট শরীরটাকে সারিয়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হাসপাতালের কর্মীরা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

দুটি পায়ের পাতা দুদিকে বেঁকে রয়েছে, মলনালি ও মলদ্বার নেই শরীরে, কোনো সাড় নেই কোমড়ের নীচের অংশে।

"ও নীলরতন সরকারের নাতি", "বাবা, ও তো রাজার ব্যাটা", "হাসপাতাল চত্বরে সেলেব্রিটি", "ও আমাদের আনন্দ"। এমনই কিছু পরিচয় নিয়ে বড় হচ্ছে ছোট ছেলেটি। প্রকৃতির খেয়ালে জন্ম থেকেই দুটি পায়ে জোর নেই তার। তবে স্রেফ হাঁটু, কোমর আর হাতের জোরে চষে বেড়ায় নীলরতন সরকার হাসপাতালের ছ'তলার শিশু বিভাগ। গত চার বছর ধরে এটাই তার ঠিকানা। রক্তের টান না থাকলেও যে কাউকে নিজের করে নেওয়া যায়, তা আরেকবার প্রমাণ করেছেন নীলরতনের নার্স, আয়া, চিকিৎসকরা। তাঁদের হাত দিয়েই মানবিকতার কাছে হার মানছে প্রতিকূলতা।

Advertisment

'বিকলাঙ্গ' শিশু হিসেবে শিয়ালদহ স্টেশনে রেল লাইনের ধারে কেউ বা কারা ফেলে রেখে যায় সদ্যোজাতটিকে। এক ব্যক্তি সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে নিয়ে যান নীলরতন সরকারে। প্রাথমিকভাবে অসুস্থ থাকায় শিশুটিকে ভর্তি করে নেওয়া হয়। সেটা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মৃতপ্রায় শিশুকে পরীক্ষা করে দেখা যায়, সুষুম্নাকান্ডে বা স্পাইন্যাল কর্ডে রয়েছে বিরাট সমস্যা, দুটি পায়ের পাতা দুদিকে বেঁকে রয়েছে, মলনালি ও মলদ্বার নেই শরীরে, কোনো সাড় নেই কোমরের নীচের অংশে। এতরকম গুরুতর প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত শিশুর দায়িত্ব বোধহয় ঘাড়ে নিতে চাননি তার জন্মদাতারা বা নিকটাত্মীয়রা।

আরও পড়ুন:ব্যস্ত শহরে রোগীর বাহন এক অভিনব অ্যাম্বুলেন্স

হাসপাতালে শিশু বিভাগে কর্মরত আয়া, নার্স, ক্লার্ক ও চিকিৎসকরা মিলে ওর নাম রাখেন আনন্দ। ভর্তির দিন থেকেই তাঁদের মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলেছিল নামগোত্রহীন ছোট্ট শিশুটি। প্রত্যেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখাবেন ওকে। বয়সের আন্দাজ করে হাসপাতালেই করা হয় অন্নপ্রাশন। হাসপাতালে ভর্তি সদ্য জন্ম দেওয়া মায়েদের বুকের দুধ খেয়ে দিন কাটত আনন্দের।

ভর্তির পর থেকে দিনের পর দিন চলে তার চিকিৎসা, কিন্তু একাধিক অপারেশনের পরও আজও সম্পূর্ণ সেরে ওঠেনি আনন্দ। মলনালি বা মলদ্বার না থাকায় সময়মত পেট থেকে মল বার করতে হয় নিত্যদিন। অপারেশন করে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট বয়সের পর তৈরি হয়ে যাবে মলনালি বা মলদ্বার। নীলরতন সরকার হাসপাতালের অর্থোটিক ইনচার্জ ডাঃ আবীর মিত্র জানান, আনন্দের পায়ের সমস্যা নেই, ওর সমস্যা শিরদাঁড়ায়। জন্ম থেকেই স্পাইনা বিফিডা নামক বিরল রোগে আক্রান্ত সে। মূলত যার জন্য আনন্দের পা দুটি অসাড়। তার ওপর এক পা ছোট আরেক পা বড়, কারোর ওপর ভর দিয়েও স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না।

কাজেই একমাত্র ভরসা ক্যালিপার। এই হাসপাতালে কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়। সেই বিভাগ থেকেই আনন্দের জন্য বানিয়ে দেওয়া হয় 'বাইল্যাটারাল ট্রাঙ্ক হিপ নী অ্যাঙ্কেল ফুট অর্থোসিস'। যার ওপর ভর করে নিজের নরম পায়ে দাঁড়াতে পারে আনন্দ। শুধু যে দাঁড়ায় এমনটা নয়, এখন গোটা শিশু বিভাগ দৌড়ে বেড়ায় সে। আবীরবাবু জানান, দেড় বছর আগে এই যন্ত্র বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আনন্দের এখন বাড়ন্ত বয়স, কাজেই ছোট হয়ে গেছে যন্ত্রটি। পুনরায় লিম্ব সেন্টারের অর্থোটিক বিভাগের উদ্যোগে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে নতুন আরেকটি যন্ত্র।

publive-image ক্যালিপার পরার সময় মোজা পরার কথা অন্যরা ভুললেও খুদে আনন্দ ভোলে না, পাল্টা নিজেই মনে করিয়ে দেয়।

চিকিৎসক ডাঃ আমারা হাসান বলেন, "দত্তক নেওয়ার চেষ্টা করেছি বহুবার, সিডাবলুসি কে তিনবার চিঠি দেওয়া হলেও দত্তক নেওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়নি।" হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ডাঃ হাসানকে আনন্দ মা বলেই জানে। তাকে যদি মসকরা করে জিজ্ঞাসা করা হয়, "কিরে, মা কোথায়?" আধো আধো স্বরে সে বলে ওঠে, "মা তো অফিসে।" প্রতিদিন ডাঃ হাসানের সঙ্গে সকালের জলখাবার খায় নীলরতনের এই ছোট্ট সেলেব্রিটি। ওখানেই প্লে-রুমে লেখাপড়া করে। শিশু বিভাগের পর্যবেক্ষণ ঘরে রয়েছে তার নিজস্ব খাট ও আলমারি।

আরও পড়ুন: ক্যানসার রোগীদের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি খোদ কলকাতার সরকারি হাসপাতালে

বহু মানুষ, যাঁরা হাসপাতালে এসে জানতে পারেন আনন্দের কথা, অনেক সময় টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চান। হাসপাতাল সেই সব টাকা জমা রাখে ব্যাঙ্কে। সেখান থেকেই চলে আনন্দের ভরণপোষণের খরচ। গোটা শিশু বিভাগ কে বেলুন দিয়ে সাজিয়ে রমরমিয়ে পালন করা হয় আনন্দের জন্মদিন। আবীরবাবু জানিয়েছেন, আনন্দের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে লিম্ব সেন্টারের অর্থোটিক বিভাগ। কিন্তু তার বড় হয়ে ওঠার পাশাপাশি এক চিন্তা ঘনীভূত হচ্ছে নীলরতনের নার্স, আয়া, চিকিৎসকদের মনে - ডিসচার্জের পর হোমে কেউ এমনভাবে যত্ন নেবে না ওর, ব্যাঘাত ঘটবে চিকিৎসার।

আনন্দের হাসপাতালে কেটেছে প্রায় চার বছর। দস্যি ছেলেটা এখন ‘ডোনট কেয়ার’ হাবভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায় শিশু বিভাগের গোটা ফ্লোর। আবীরবাবু জানিয়েছেন, "পায়ের জোর নেই তো কী হয়েছে, ও তোয়াক্কা করে না।" ক্যালিপার পরার সময় মোজা পরার কথা অন্যরা ভুললেও আনন্দ ভোলে না, উল্টে নিজেই মনে করিয়ে দেয়। কেউ কেউ বলেন, "ওকে দেখলে, কথা বললে সারাদিনের কাজের চাপের কষ্ট কমে যায়।"

ছোট বয়সেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে একাধিক প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে। কাজেই আর পাঁচটা শিশুর মতো ভয় করে না ওর। অচেনা কোলগুলোকেই আপন করে নিয়েছে সে, নীলরতনে কর্মরত নার্স, আয়া, ডাক্তাররাই আনন্দের একান্নবর্তী পরিবার।

kolkata
Advertisment