“তুমিও হেঁটে দেখ...”
উঁহু! কলকাতা নয়, নিউ ইয়র্ক! তাও আবার উৎসবের আলোয় রিনিকঝিনিক আলটুসি যখন! যারা যৌবন ছড়িয়ে এসেছে চিনেবাদামের খোলা ভাঙ্গা ময়দান আর উতসবের জলসাঘর পার্কস্ট্রিটে, তাদের চোখে পৃথিবীর আর কোন শীতকাল তেমন মোহময় লাগে কিনা আমি জানিনা, আমার অন্তত লাগেনা। তবুও আমেরিকান “হ্যাপি হলিডেজ” শুরু হতেই একটি ফেলে আসা বছরের ক্রিসমাস ইভের গপ্প মনে পড়ে গেল দুম করে। যেখানে কিছু হিহি কাঁপুনি, হাহা হাসি আর ছিল কিলবিলে রাতবাতিরা জড়িয়ে আষ্টেপৃষ্টে.....!
“অশান্ত বাতাস আজও পাতা উলটে খোঁজে”
জানিনা বাবা, কিসের খোঁজ! বাইরে পা রাখার সাথে সাথে উড়ে যাচ্ছিলাম প্রায়। যা তাপমাত্রা তার থেকে আরো ক’ডিগ্রী কম মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে শান্ত হল হাওয়া। আমাদের হাঁটা শুরু হল। এখানে বেশ ওয়াক টুর করানো হয় এমনিতে। তবে ওই ডলার গচ্চা আছে তাতে। ‘আপন পা চালিয়ে যা’ মন্ত্র আর জিপিএস যতক্ষণ আছে ততক্ষণ কড়িবিহীন সেলফগাইডেড টুর জিন্দাবাদ আমাদের জন্য। গন্তব্য শুরু হল ব্লুমিংডেল দিয়ে। এইখানে বলে রাখা যায়, নামীদামী ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের হলিডে উইন্ডো এই শীতের মরশুমের অন্যতম আকর্ষণ নিউ ইয়র্কের। নিজস্ব অভিনব থিম দিয়ে প্রতি বছর ডিসপ্লে উইন্ডো সাজান কর্তৃপক্ষ, লাখো লাখো লোক দেখতে আসে সেইসব। আঠারশ শতকের শেষ দিকে যখন উইন্ডো ডিসপ্লের চল শুরু হয়, খানিকটা গোড়াপত্তনও ঘটে উইন্ডো শপিং-এর।
আরও পড়ুন, সন্তানরা দূরে, সান্তা সেজে শহরে বড়দিন উদযাপন ‘বুড়ো’দের
মেসি’স শুরু করেছিল এক চমৎকার থিম ডিসপ্লে আঙ্কল টমস কেবিনের গল্প আর পোর্সেলিন পুতুল দিয়ে। সেই থেকে এই শীতকালীন উইন্ডো ডিসপ্লে নিউ ইয়র্ক উইন্টারের অন্যতম ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যুগ যুগ ধরে। যাইহোক, ব্লুমিংডেল এই বছরের থিম রেখেছে সার্কাসধর্মী, নবাগত ছবি “দ্য গ্রেটেস্ট শোম্যান অফ দ্য ইয়ার”-এর আদলে। শীতকালীন সার্কাসগুলো জীবন থেকে কবেই হারিয়ে গেছে আমার। এই উজ্জ্বল লাল নীল সোনালী ম্যানেকুইনরা আর একবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল অতীতে। একটি চকচকে ট্র্যাপিজ খেলোয়াড়, গোলগাল জ্যোতিষী, এমনকি একটি দাড়িওয়ালা মহিলা......এরা কেউই তেমন পারফেক্ট নয়, কিন্তু “No one ever made a difference by being like everyone else” এই উইন্ডোর গায়ে লেখা দামী কথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছিল বারবার। নিজস্বতা বজায় রাখাই ভালো, তা সে যতই এলেবেলে হোক অন্যের চোখে!
একটু দূরেই ডিলান’স ক্যান্ডি বার। বব ছাড়া ডিলান হয়, আর ক্যান্ডিরও বার হয় এইসব জানলাম প্রথম। এরপর পশ্চিমে দুটি ব্লক হেঁটেই পৌঁছলাম ম্যাডিসন এভিনিউতে বার্নেস। হাস ব্রাদার্স জুটির কামাল চোখে পড়ল স্থাপত্য আর গ্রাফিক জুড়ে। প্রিমর্ডিয়ালে যেমন জীবনের সূচনার গল্প, তেমনি ইউটোপিয়ায় আছে বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গনের আভাস, সবাইকে নিয়ে চলাই যে সুখ- রংবেরঙের স্ট্রাইপড জেব্রা রেনবো ব্যাগিন্স আর তার বন্ধু রাইনোনা ওয়াইডার সে কথাই জানাল আমাদের। কে জানে এই বার্তা দেখেছেন কিনা ক্ষমতাবান অথচ ইমিগ্রেশনবিরোধী একজন! মিলেনিয়ামে আবার স্পষ্ট করে বলা আছে, যে ভবিষ্যত আমরা দেখতে চাই তাকে তৈরি করতে হবে আমাদেরই বর্তমানে। মাশরুম সিঙ্গুলারিটি জানলা বলল সেই দিনের কথা, যেদিন গাছপালা, পশুপাখি আর কম্পুটার দখল নিয়ে নিতে পারে পৃথিবীর। রাউডি রডি ভাইপার ডাউনটাউন থিমের রাজা, বিষ নয়, শান্তি ছড়ায় সে। আহা, এমন একটা সত্যি ভাইপার যদি থাকত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতেও? আর একটি লম্বা ব্লক পেরিয়ে পৌঁছলাম স্বপ্নের ফিফথ এভিনিউতে, এইখানে অনেককিছু করার আছে। তার গল্প তাই আর একটু ছড়িয়ে বলা যাক।
“মাথার ওপর চাঁদোয়ানীল, পায়ের তলায় সর্ষে”
সত্যি তাই। কিন্তু সময় যত বাড়ছে, ঠান্ডার দাপট তেমনি ঊর্ধ্বমুখী। তাতেও আমাদের উৎসাহ একইরকম। আলোর গ্রিনরুম শহরে ফুটপাথে হাঁটার অভিজ্ঞতাও বেশ হাতিবাগান, গড়িয়াহাট আর এসপ্ল্যানেডকে মনে করাচ্ছিল। দুপাশে দোকান, বড় বড় ব্র্যান্ডের পাশে ফুটপাথী পসরা সাজিয়ে নানা দোকানীরা। মাইকেল করসের নকলি ব্যাগ থেকে শুরু করে রোলেক্স ঘড়ি, কী নেই? আছে নানান শীতের টুপি, মাফলার, আলো জ্বালা স্যান্টা টুপি, গলায় আলোর মালা। ছোট ছোট ফুড কার্টগুলোয় খাবারের গন্ধ উঠছে খানিকটা। চিকেন ওভার রাইস, বার্গার, কাবাব....আছে কিছু গরম ক্যারামেলাইজড বাদামের কার্ট। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে আগুনের হালকা তাপ লাগছিল গায়ে। বেশ আরামদায়ক এই আবহাওয়া। সারাটা শীতকাল জুড়ে এভাবেই বসে থাকে সব দোকানীরা, গায়ে একটা জ্যাকেট, কান মাথা ঢাকা দিয়ে হেঁকে চলেছে জিনিসের দর। পেটের দায় ঠান্ডাকে হার মানায় বলেই হয়ত।
অনেকের আবার কথায় স্পষ্ট বাংলাদেশি টান। আমরা এক ডলারের পিজা খেয়েছিলাম ওখানেই। বাংলাতেই জিজ্ঞেস করল একজন, “আপনারা কি কলকাতার বাঙালি”? আচ্ছা এই যে বাংলাদেশের বাঙালি, কলকাতার বাঙালি, এত যে প্রকারভেদ- রবীন্দ্রনাথ, মাছের ঝোল আর মিষ্টি আমরা সবাই একইরকম ভালোবাসিনি বুঝি? যাকগে। ফিফথ অ্যাভিনিউর শুরুতেই গেলাম বার্গডর্ফ গুডম্যান। শীতের সেন্ট্রাল পার্ক, নিয়ন আলোর ৪২ স্ট্রিট, আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ জানিয়ে রুপোলি ডাইনোর ছড়াছড়ি...নিউইয়র্ককে আদর দেওয়া সবকিছুই আছে সেই ডিসপ্লেতে! বোনাস স্টপ হিসেবে উঁকি দিলাম টিফানিতেও। অন্ধকারে নিউ ইয়র্ককে দেখতে মাঝে মাঝে মনে হয় জলে ভাসা এক টুকরো হীরকদ্যুতিময় হিমশৈলের মত। টিফানির জৌলুস ঠিক সেইরকম। ঠিকরে পড়ছে রত্নখচিত আলোকদ্যুতি, চিনচিনে গুঁড় বরফের বিছানায়, রকেফেলারের রেপ্লিকাও উপস্থিত একখণ্ড জানলায়। চোখ ধাঁধিয়ে গেছে লহমায়।
গন্তব্য এবার স্যাকস ফিফথ অ্যাভিনিউ। আমার দেখা সবচয়ে প্রিয় ডিসপ্লে এটিই। কিছুটা একচোখোমি রয়ে যেতে পারে লেখাতেও তাই। ডিজনির স্নো হোয়াইট আর সেভেন ডোয়ার্ফের আশি বছর পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে এখানে। ডিজনির প্রতি আমার দুর্বলতা এই ইহকালে আমি ত্যাগ করতে পারবনা এ কথা ঠিক, কিন্তু ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি চলছে, তারই মধ্যে ফুটপাথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকা অতগুলো মন্ত্রমুগ্ধ মানুষ নিশ্চই কিছুর টানে এসেছে, এ আমার একার আহ্লাদ নয়। মিনিট দশেকের সেই লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোতে আলোর প্লাবনে ভিজে একশা হয়ে ছিলাম। ভাল করে ফটো তোলা, ভিডিও কোনটাই করিনি। সবকিছু ক্যামেরার লেন্স দিয়েই যদি দেখি, তাহলে চোখের সার্থকতা কোথায়? যাইহোক, এরপর রাস্তার ঠিক উল্টোদিকেই রকেফেলার সেন্টার। আমেরিকা তথা বিশ্বের তাবড় তাবড় ক্রিসমাস ট্রিগুলোর মধ্যে একটি। সঙ্গে আইস স্কেটিং। ৪৫০০০ এলইডি লাইটের রমরমায় দিশেহারা লাগছিল বেশ। কী ব্যাপ্ত, কী বিশাল! পরীদের সাইরেনে নেমে আসে ক্রিসমাস এইখানে! লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন....সেই স্বপ্নের ভোজবাজির মধ্যে চোখ গেল সেন্ট প্যাট্রিক’স ক্যাথিড্রালের দিকে। রোমান গথিক স্টাইলের নিউ ইয়র্ক তথা আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ আইকনিক ক্যাথলিক চার্চটি। সব উন্মাদনার মাঝে স্থবির দাঁড়িয়ে নিজের অপার গভীরতা নিয়ে। কিছু প্রশস্তি আসলে বড্ড ভাল লাগে। মাঝে ব্রায়ান্ট পার্ক ক্রিসমাস ভিলেজ যাওয়া হয়েছে। সেটার গল্প বলছি একটু পর।
আপাতত জমাটি লাল বলের ডেকরেশন পেরিয়ে রেডিও সিটি হয়ে লর্ড এন্ড টেলর। হিহি ঠান্ডায় চোখ মেলে দেখলাম জানলায় আটকানো পোলার বিয়ারের হাই ফাইভ, তারাখচিত নিউ ইয়র্কের আকাশের ছবি, ভিনটেজ সার্কাস, কাঠের ওয়ান্ডারল্যান্ড! লাল স্যুট পরা একজন মানুষ তাকিয়ে আছে তার নিজের স্নো গ্লোবের দিকে...ইনি কি ঈশ্বর? বরফঢাকা পশ্চিমি দেশগুলোর দিকে এভাবেই চেয়ে থাকেন শীতকালে? নাকি মাঞ্জাদার স্যান্টা? আমি ছোটবেলায় স্যান্টাকে ঠাকুর ভাবতাম। অবশ্য আজও ঠিক জানিনা ঈশ্বর আর স্যান্টার পার্থক্য কোথায়। তবে শিশুদের সারল্যের স্যান্টা, বড়দের বোদ্ধা হৃদয়ের ঈশ্বর না হওয়াই হয়ত ভাল।
এদিকের শেষ গন্তব্য মেসি’জ। তার আগে টুক করে মাথা তুলে দেখে নিয়েছি লাল-সবুজের বাহারি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংটা। কী উদ্ধত আলোকিত উচ্চতা! হাত নাড়ছিল বুড়ো স্যান্টা পুতুল, আ পারফেক্ট গিফট ব্রিংস পিপল টুগেদার। সত্যি! উপহার দামী হওয়া নিয়েই ভেবে মরি আজকাল। ‘গিফট অফ দ্য মেজাই’ কি তবুও দিতে পারি ভালবাসি যাদের? ফিফথ অ্যাভিনিউ অবধি এসেই গেছি যখন টাইমস স্কোয়ার না গেলে ঠিক পুণ্য কমপ্লিট হয়না। সেটাও শেষ হল। একটি উবের নিয়ে এইবার ব্রুকলিনের দিকে। ঘড়িতে প্রায় আটটা। নাক মুখ লাল হয়ে গেছে ঠান্ডায়। শীতে জবুথবু দৃষ্টিতে নিউইয়র্কের ঝলমলে রাত ঝাপসা হচ্ছে মাঝেমাঝে। গাড়ির গরমে একটু আরাম পেতেই শরীরের ব্যথা বেদনা জানান দিচ্ছে। আমল দিলে চলবেনা। ষ্টারবাকসের কফি আর বেড়ানোর পাগলামি জিন্দাবাদ। এখানেও গাইডেড টুর পাওয়া যায়। আমরা নিইনি। আলোর পাড়ায় যখন নামলাম, মনে হল এই এত আলো এত আকাশ আগে দেখিনি...কই চোখে পড়েনি! এই গল্প বলার আগে ফেলে রাখা ক্রিসমাস ভিলেজের কথাটা বলে নিই।
যিশু যদি শুকতারা খোঁজে
তবে ব্রায়ান্ট পার্ক ক্রিসমাস ভিলেজে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। ১৭৬টি ভেন্ডরের মার্কেটে ঢুকেই আমি ব্যোমকে গেলাম। একবার যদি সিলকম্যানের বডি এম্পোরিয়ামে লোশন দেখি, আর একবার ছুটি ন্যাচুরা ব্রাসিলে ক্রিম দেখতে। নিনোভা, তান্জর, মিন এন্ড মন. মেক্সিকান ভিলেজ ইত্যাদি ঘেঁটেঘুটে এক পিস আর্টওয়ার্ক কেনা হল। সাজানো দিব্য সব হলিডে গিফট শপ। লাভপপ, স্যান্টা’স ওয়ার্কশপ, ইটস অলওয়েস ক্রিসমাস ইন নিউ ইয়র্ক। শেষের দোকানের নামটি ভারী পছন্দ হল। লুকিয়ে একটি গিফট কিনলাম কত্তার জন্য। দুটো পুতুলের হাত ধরাধরি। জানি হয়ত এ বোকামি তিরিশের পর মানায়না। তবুও প্রেম অবোধ, অর্বাচীন...সহজে প্রাচীন হয়না! জিনিসপত্তরের আগুনের মত দাম হয়ত নয়, কিন্তু মধ্যবিত্ত হাতের সহ্য ক্ষমতা সীমিত, অল্পতেই ফোস্কা পড়ে যায়। খাবার দোকানও প্রচুর। মেক্সিকান, চাইনিজ, বলিভিয়ান, কত সব। খাওয়ার সময় ছিলনা। বাচ্চাদের জিনিসের দোকানও প্রচুর, তেমনি আছে সুইট আর ক্যান্ডি শপ। ফ্রি আইস স্কেটিং রিন্ক, পিছনে বিশাল ক্রিসমাস ট্রি। এটিকে ঘিরেই দোকানের বাহার বসেছে যত। শপিং এরিয়াতে মেয়েরা সারারাত থাকতে পারে। অতএব আর বেশি উস্কানি না দিয়ে নিজেকে বেরিয়ে পড়লাম। তারপরের গল্প তো আগেই বলা আছে।
“ছোট টাউনের শীতে কী আর খবর থাকে”, আলো মাখামাখি ছাড়া
এটাই আমার ডাইকার হাইটসের এক লাইনি অভিজ্ঞতা। ব্রুকলিনের ছোট্ট প্রান্তর জুড়ে পরপর সাজানো গোছানো আলোমাখানো সব বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে যেন লণ্ঠন হাতে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। আমাদের নিত্যদিনের ক্ষতগুলোয় প্রলেপ লাগবে বলে। কোন বাড়িতে হাওয়াভরা স্যান্টা পুতুল গল্প বলছে বাচ্চাদের, কোথাও রাজকন্যের নাচ, বাড়ির দরজায় স্নোম্যান, গুঁফো প্রহরীসব আরো। লাল হলদে সবুজ আলোর বল, জিঙ্গল বেলস মিউজিক, বড় বড় কার্টুনগুলো, রেনডিয়ার ব্যালকনি, লনে দুলছে হাওয়ায়। গাছে গাছে আলোর ডালপালা পাতার সাজগোজ দেখে বোঝাই যায়না শীতের দাপটে আদতে ন্যাড়া হতচ্ছাড়া। আলোর জ্যাকেটে মুড়ে আছে পুরো অঞ্চলটা। এই বাড়ি যদি বলে আমায় দেখো, তো সে বলবে আমায়। আমাদের কলকাতার পার্কস্ট্রিট, পুজোর লাইটিং এইটুকুই তো আলোর খেলা দেখেছি আমি। এসব দেখে তিরতিরে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছিলাম বারবার। ঘন্টাখানেক স্বপ্নে বেঁচে ছিলাম সত্যি।
নিউ ইয়র্কের জৌলুস যদি মাইকেল জ্যাকসনের শো দেখা হয়, ব্রুকলিন আমায় দিল ফরিদা খানুমের একলা গজল। ফুটপাথ ধরে আসতে আসতে কেবল চুপচাপ হাঁটছি সাবওয়ের দিকে। হালকা উঁচুনিচু রাস্তা. উবেরে আসতে আসতে দেখছিলাম একজন আমেরিকান ভেটেরান একটি ফুটপাথে বসে। সামনে সাইনবোর্ড “হেল্প মি”। পাশেই সবাই লাইন দিয়ে দামী হোটেলে ঢুকছে ক্রিসমাস ডিনার খেতে। হয়ত আজই উড়ে যাবে হাজার ডলার একটি ডিনার প্লেটেই। বুঝতে পারিনি তখন ভগবানকে ধন্যবাদ দেব ওই ভেটেরানের জীবন আমার হয়নি তাই। সারাজীবন দেশের জন্য যুদ্ধ করে এই পুরস্কার কি তার প্রাপ্য ছিল? নাকি আফশোস করব যে আজ আমি কোন দামী রেস্তঁরায় গেলাম না খেতে। একটু আগেই যেমন করছিলাম নিজের ক্যারিকেচার আঁকাতে পারিনি বলে। ফুটপাথে বসেছিলেন বেশ কিছু শিল্পী। তুলির টানে এক একটি মুখ করে তুলছিলেন হাস্যস্পদ। ব্রুকলিনের এই আলোর শহরতলি আমায় হঠাৎ শিখিয়ে দিয়ে গেল জীবনটা কেবল অতিবাহিত করার মধ্যেও সুখ বড় কম নয়। কী পেলাম আর কী পেলাম না-র এই গর্ব আর হতাশার চেয়েও অনেক বেশি কিছু লুকিয়ে আছে অন্য কোথাও, খুঁজে নিতে হয় নিজেকেই।
বাস ধরে যখন বাড়ি ফিরে আসছি ক্লান্ত কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে আছে ভিতরবাহির আমার। অবান্তর স্মৃতির ভেতর গুঁজে গুঁজে ঠেসে দিয়েছি আলো ঝলমলে সন্ধ্যের সব টুকরোগুলো। কোনও ক্রিসমাসে যদি আলো কম পড়ে যায়, এইখান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সাজিয়ে নেব আবার। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার আমরা সবাই, সময় বিশেষে! অন্তরটা রোশনাই দিয়ে সাজিয়ে নিতে হলে মস্ত দামী কিছু সত্যি লাগেনা!