রিয়া আর তাতাই, দুই ভাইবোন পিঠোপিঠি বয়সের। তাতাই-এর এবার বোর্ড এক্সাম। বাড়ির পরিবেশ তাই খুব গম্ভীর। রিয়া উঠেছে ক্লাস নাইনে। দাদার পরীক্ষা বলে রিয়া এখন বাবা মায়ের ঘরেই কোনের দিকে পড়ার টেবিল আনিয়ে নিয়েছে। দাদাকে বিরক্ত করা যাবে না। বোর্ড এক্সাম শেষ হল। ইলেভেনের ক্লাসও শুরু হয়ে গেল তাতাইয়ের। এখন দাদা আর নিজের ঘরে আরও বেশি করে ঢোকা বারণ রিয়ার। তাতাইয়ের 'প্রিভেসি' নষ্ট হবে। স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-চাকরি জীবনেও অটুট থাকল তাতাইয়ের 'প্রিভেসি'। রিয়া কেবল মানিয়ে মানিয়ে চলে। নিজের জায়গা খোঁজে কখনও বাবা-মার সঙ্গে, কখনও দাদা না থাকলে দাদার ঘরে।
ওপরের গল্পটা খুব অচেনা কি? ফ্রেমে অল্পস্বল্প বদল এনে নিজেদের বাড়িতেও ধরিয়ে দেওয়া যায়, বলুন? হ্যাঁ তৃতীয় বিশ্বের দেশে এরকম তো কতোই ঘটে। দেশ স্বাধীন হল, বিজ্ঞানের অগ্রগতি হল, চাঁদের মাটিতেও পৌঁছে যাচ্ছে ভারত, কিন্তু পুরুষতন্ত্রের ছবিটা বদলাল না আজও। তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারেও সন্তানরা প্রায়শই লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হন। বিশেষ করে যে বাড়িতে বিপরীত লিঙ্গের একের বেশি সন্তান থাকে।
আরও পড়ুন, ‘সাত চড়ে মুখে রা নেই’! মুখ খুলতে আজও ভয় দেশের মেয়েদের, বলছে সমীক্ষা
ভাইবোনে এই ঝগড়া তো এই গলায় গলায় ভাব, এ সব অস্বাভাবিক নয়। সমস্যা অন্যখানে। বিশিষ্ট মনঃসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ এই প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে জানালেন, "আমাদের সমাজে পুত্র এবং কন্যাকে বড় করার সময় বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। বন্ধু বাছাই, খেলা, বাইরে বেরনোর ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের সমান স্বাধীনতা পায় না। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারে বৈষম্যটা চোখে পড়ার মতো হয়। খাওয়ার সময় মাছের ভালো পিসটা এখনও রেখে দেওয়া হয় বাড়ির ছেলেদের জন্য। অসুখ বিসুখে ছেলেদের চিকিৎসায় বেশি খরচ করা হয়। আর একটা বিষয় সমাজের সব স্তরেই পরিলক্ষিত হয়। পুরুষতন্ত্রকে বয়ে নিয়ে চলে কিন্তু পরিবারের মায়েরাই। তাঁরা পুত্র সন্তানদের বেশি যত্ন করেন অনেক ক্ষেত্রেই। মেয়েদের বেলায় কেমন যেন 'আর তো ক'দিন পরেই বিয়ে হয়ে যাবে' গোছের ভাবনা থাকে মায়েদের"।
এই বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কী কী করা দরকার? উপায় বাতলালেন মোহিত বাবু- "বৈষম্যের দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পুরুষতন্ত্রের শিকড় অনেক গভীরে চলে গিয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ নয়। তাই সচেতন ভাবে বেরোতে হবে। মেয়েদের বিয়ের ওপর জোর না দিয়ে তাঁদের আর্থিক ভাবে স্বাধীন করার দিকে জোর দিতে হবে। ঘরে এবং বাইরে দু-দিকেই স্বাবলম্বী হতে হয়ে আজকালকার ছেলে এবং মেয়েদের। বাড়িতে তাই ভাই বোন দুজনকেই সব কাজের অভ্যাস করানো উচিত। কোনও কাজ লিঙ্গ ভিত্তিক হয় না। আর ছেলে মেয়ের সঙ্গে বন্ধু হতে হবে মা-বাবাদের। যাতে কখনও বাবা মায়ের আচরণে মনের ব্যবধান তৈরি হলেও সমস্যার কথা খুলে বলতে পারে ছেলে মেয়ে উভয়ই"।