শহর কলকাতায় অবাঙালির সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে, বাংলার রাজধানীতে থাকলে কী হবে, তাঁরা নিজেদের সংস্কৃতিতেই বেশি আস্থা রাখেন। বাঙালি সংস্কৃতির চেয়ে খানিকটা ভিন্নভাবে নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে মেতে থাকেন কলকাতার অবাঙালিরা। যেমন, বাঙালিরা দুর্গাপূজাকে বেশি গুরুত্ব দেন। আর, কলকাতার অবাঙালি হিন্দুরা বেশি গুরুত্ব দেন রামনবমী, জন্মাষ্টমী, হোলি, ছট পুজোর মত উৎসবকে।
আর, অবাঙালিদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে থাকতে যাঁরা বেশি অভ্যস্ত, তাঁদের অন্যতম হল মাড়োয়ারি সম্প্রদায়। যাঁদের প্রধান কেন্দ্র বড়বাজার। তবে, একটা ব্যাপারে কিন্তু, বাঙালিদের মতই তাঁরা সমান গুরুত্ব দিয়েই ধর্মাচরণ করেন। তা হল, বড়বাজারের পুঁটেকালী মন্দিরে পুজোপাঠ। যেখানে বাঙালিদের পাশাপাশি কলকাতার অবাঙালিরাও নিয়মিত যাতায়াত করেন। নিয়মিত পুজোপাঠ করেন। সবটাই অবশ্য মনস্কামনা পূরণের জন্য। এই মন্দিরে শহরের অবাঙালিরা বাঙালিদের মতই দৈব কৃপালাভের আশায় মাথা ঠেকান। আর, প্রার্থনাও সারেন বাঙালিদের কায়দাতেই।
শুধুমাত্র পুঁটেকালী মন্দিরের প্রতি বড়বাজারের অবাঙালি সম্প্রদায়ের বিশেষ প্রীতির কারণ এটা এলাকার মন্দির, তেমনটা কিন্তু নয়। বরং, তাঁদের এই মন্দিরের প্রতি আকর্ষণের প্রধান কারণ অলৌকিকত্ব। সেই ব্যাপারে জানতে হলে, এই মন্দিরের ইতিহাসটাও জেনে রাখা দরকার। কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটে তারাসুন্দরী পার্কের পাশে এই পুরোনো কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তান্ত্রিক মানিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে দেবীর উচ্চতা মাত্র ছয় ইঞ্চি। মূর্তি আনা হয়েছিল নববৃন্দাবন থেকে। ৯৬৪ বঙ্গাব্দে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
কথিত আছে মানিকচন্দ্রের উত্তরপুরুষ খেলারাম একটি হোম করছিলেন। সেই সময় গঙ্গার খাদ থেকে একটি পুঁটিমাছ লাফিয়ে হোমকুণ্ডে পড়ে যায়। খেলারাম অর্ধদগ্ধ মাছটিকে তুলে ফের জলে ফেলে দিতেই তা আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেই থেকে এখানকার দেবীর নাম পুঁটিকালী বা পুঁটেকালী। ব্রিটিশ জমানায় মন্দিরটি রাজপথ নির্মাণের জন্য ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু, দেবীর কৃপায় আদালতের শরণাপন্ন হয়ে তা রক্ষা করেন মন্দিরের সেবায়েতরা। শুধু তাই নয়, ১৯৩০-এর দশকে এই মন্দির সংস্কার করে বর্তমান চেহারা দেওয়া হয়। এই মন্দিরের অন্যতম বিশেষত্ব, এর একটি পাতালকক্ষও আছে।
আরও পড়ুন- ভক্তের ভার বহন করেন শ্যামনগরের মূলাজোড় ব্রহ্মময়ী কালী, জড়িয়ে রামপ্রসাদ-বামাক্ষ্যাপার নামও
পুঁটিমাছ অর্ধেক দগ্ধ হওয়ার পরও যেখানে বেঁচে ওঠে, সেই মন্দিরে যে অলৌকিক ঘটনার ঘনঘটা থাকবে, তা সহজেই বোঝা যায়। অসংখ্য ভক্ত এখানে এসে তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। আর, সেই কারণেই কলকাতার বাঙালিদের পাশাপাশি, অবাঙালি সম্প্রদায়ের কাছেও এই মন্দির বিশেষ পছন্দের। এই মন্দিরে নিত্যপূজা তো হয়ই। মনস্কামনা পূরণের পর ছাগবলিও হয় হামেশাই। যাবতীয় পূজা চলে তন্ত্রমতে। শ্যামাপূজার দিন দেবীকে স্বর্ণবেশ পরানো হয়। সেদিন ভৈরবী পুজোও হয় এই মন্দিরে। তার পরদিন আবার হয় কুমারী পুজো ও অন্নকূট উৎসব। অবাঙালিরা অবশ্য মনস্কামনা পূরণের পর দেবীকে নিরামিষ ভোগই নিবেদন করেন। এককথায় এই মন্দির আর, তার অলৌকিক ঘটনাবলী, শহর কলকাতার অন্যতম বিস্ময়।