Durgamurti-Netaji: ভারতীয় জাতীয় জীবনে যাঁরা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন, তাঁদের সকলের জীবনের সঙ্গেই মিথ্যা ও অর্ধসত্য মিশিয়ে যে কোনও ঘটনাকে বা বিষয়কে প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি গৌরবময় করে তোলাটা বরাবরই ছিল। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এবং হাতে হাতে সস্তা ইন্টারনেট-যুক্ত স্মার্ট ফোন এসে যাওয়ার ফলে এই প্রমাণহীন, তথ্যহীন এবং অবাস্তব ইতিহাসচর্চা প্রায় প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।এই ভয়ংকর বিপদময় নকল ইতিহাস চর্চার তাণ্ডবলীলায় যে মানুষটিকে সম্ভবত সবথেকে বেশি অপমানিত হতে হয়েছে, তাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু। এখনও যাঁকে ভারতবর্ষ একমাত্র 'নেতাজি' বলে মনে করে। মূলতঃ সমাজমাধ্যমের এই নকল ইতিহাস চর্চায় কোনও তথ্য-প্রমাণ বা প্রত্যক্ষ স্মৃতিচারণা ছাড়াই জানা যায় যে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় সুভাষচন্দ্র নাকি কলেজের পিছনে 'স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলে' এসে মাটিতে কলাপাতা বিছিয়ে ভাত খেতেন। আবার নাকি কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের কোনও এক তেলেভাজার দোকানে তেলেভাজা খাওয়ার অছিলায় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, ইত্যাদি। যদিও যাঁরা সুভাষচন্দ্র বসুর নির্ভরযোগ্য জীবনী লিখেছেন, তারা এবং স্বয়ং সুভাষচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কোনও ব্যক্তিগত লেখায় এই সব ঘটনার সামান্যতম আভাস পর্যন্ত দেননি।
সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে যে মিথ (অথবা খাঁটি মিথ্যা) ইদানিং প্রায় সর্বত্র চোখে পড়ে, সেটা হল বাংলার দুর্গা প্রতিমার শৈল্পিক গঠনের পরিবর্তন। যার সঙ্গে আবার জড়ানো হয় আরেক বিখ্যাত বাঙালিকে, যাঁর নাম ভাস্কর গোপেশ্বর পাল। যিনি সেই ১৯২৪ সালে লন্ডনে আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনীতে তাঁর অনবদ্য মাটির মূর্তি গড়ার দক্ষতা দেখিয়ে জিতে নিয়েছিলেন ইউরোপের হৃদয়। আরও বছর দুই বিদেশে থেকে এবং প্রচুর মিউজিয়ামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে গোপেশ্বর আত্মস্থ করেছিলেন এক নতুন শিল্পবিদ্যা। যা সেই সময়ে কলকাতার কুমোরটুলির সাধারণ প্রতিমা শিল্পীদের প্রায় স্বপ্নাতীত ছিল।
১৯২৬ সালে দেশে ফিরে কাশী মিত্র ঘাট লেনে তিনি একটি আধুনিক আর্ট স্টুডিও কাম ওয়ার্কশপ তৈরি করেন মূলতঃ ইউরোপীয় ধাঁচে নানা ভাস্কর্য তৈরি করার জন্য। গোপেশ্বর পাল কখনও নিজেকে কুমোরটুলির প্রতিমা শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি। কারণ, নানা সরকারি ও নানা দেশীয় রাজ পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ধনী ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত সংগ্রহের ভাস্কর্য তৈরির জন্য তাঁর চাহিদা সে যুগে ছিল আশাতীত।
এহেন অন্য ধারার এক ভাস্করের কাছে ১৯৩২-৩৩ সালে কুমোরটুলি সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি তাদের বারোয়ারি দুর্গাপূজার মূর্তি তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ জানায়। কাজটা করতে গোপেশ্বর এতটাই অনাগ্রহী ছিলেন যে, তিনি কাজটার জন্য তিন হাজার টাকা পারিশ্রমিক দাবি করেন। যা সেই যুগে অকল্পনীয় ছিল। আশ্চর্য এই যে, গোপেশ্বর পালের মত এক বিশ্বখ্যাত মানুষকে পাওয়ার জন্য কুমোরটুলি সর্বজনীন টাকাটা দিতে রাজি হয়ে যায়। গোপেশ্বরও দুর্গা পুজোর মূর্তি তৈরির প্রস্তাবে বাধ্য হয়ে রাজি হন।
গোপেশ্বর বাংলার চিরকালীন দুর্গার মাতৃময় প্রতিমাকে প্রথমেই ভেঙে নেন সম্পূর্ণ ইউরোপিয়ান আদলে। অর্থাৎ, দুর্গার সমগ্র পরিবারকে একচালায় না রেখে তিনি প্রতিটি দেবতার জন্য পৃথক বেদী ও চালার ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ মণ্ডপে দর্শক এবার থেকে একটি নয়, পাঁচটি পৃথক দেবতাকে সমদূরত্বে দেখতে পেতে শুরু করল। কেন এমন ভাবলেন গোপেশ্বর?
যদি কোনও স্মৃতিকথা তিনি কখনও লিখেছেন বলে শোনা যায় না। তবুও তাঁর পরিবারের সদস্যরা মনে করেন যে একটি একচালা প্রতিমার দৃশ্যায়নে যাবতীয় আকর্ষণ কেড়ে নেয় দুর্গার অংশটি। কারণ, দুর্গা অন্য দেব-দেবীর কেন্দ্রে অবস্থান করেন। তাঁর মুখের আকার অন্যদের তুলনায় বড় হয়। ফলে, বেশিরভাগ দর্শক কার্যত গণেশ বা সরস্বতীর শৈল্পিক সৌন্দর্যের দিকে ফিরেও তাকায় না। অথচ, এই মূর্তিগুলো গড়ে তুলতে একজন শিল্পী এতটাই পরিশ্রম করেন যতটা তিনি দুর্গা মূর্তি তৈরি করার সময় করে থাকেন।
দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই এই যে, ইউরোপের নানা মিউজিয়ামে নানা ভাস্কর্য দেখে আসা গোপেশ্বর পাল তাঁর সৃষ্টিতে সেই নান্দনিকতা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন, যার যথেষ্ট সুযোগ বাংলার প্রথাগত দুর্গামূর্তিতে বোধহয় ছিল না। আর শেষ কারণ অবশ্যই এটা যে, কুমোরটুলির অন্য সব প্রতিমাশিল্পীদের কাজের থেকে নিজের কাজকে আলাদা করার সুপ্ত বাসনা তাঁর মধ্যে ছিল।
সেই ১৯৩২-৩৩ সাল থেকে টানা চল্লিশের দশকের শুরু পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক বছর কুমোরটুলির প্রতিমা গড়েছেন গোপেশ্বর পাল। প্রতিবারই তিনি সাবেকি একচালাকে ভেঙে পাঁচটি দেবীমূর্তির জন্য তৈরি করেছেন পাঁচটি স্বতন্ত্র বেদী ও চালা। এই পর্যন্ত যত কিছু বলা হল, তার সবই গ্রন্থিত ইতিহাস, শুধু একটি তথ্য ছাড়া। ঠিক কোন বছর থেকে গোপেশ্বর পাল কুমোরটুলি সর্বজনীনের প্রতিমা গড়তে শুরু করেন এবং এই শৈল্পিক বিপ্লবটি আনেন, তা নিয়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও নির্দিষ্ট প্রামান্য তথ্য নেই। সবই মৌখিক এবং স্মৃতিনির্ভর অনুমান।
অনিতা অগ্নিহোত্রীর মতে সালটা ১৯৩৭। আবার গোপেশ্বর পালের পরিবারের প্রবীণতম সদস্য, ৮০ বছরের ব্যোমকেশ পালের মতে, এটা ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যেকার ঘটনা। গবেষক গেয়ার হেইরস্ট্যাডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এটা ১৯৩৫ সালের ঘটনা।
এই পর্বে গোপেশ্বর পালের এই বিরাট শিল্পভাবনার মধ্যে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে কোনওরকম প্রামাণ্য তথ্য ছাড়াই অনুপ্রবেশ করানো হয় সুভাষচন্দ্র বসুকে এবং সেই মিথ্যা ধারণা, 'ইতিহাস' হয়ে প্রবন্ধে প্রকাশিত হয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এমনকী, কলকাতার একটি বিখ্যাত ইংরেজি সংবাদপত্রে পর্যন্ত।
নিজেদের ৮৬তম বর্ষের স্মারক পুস্তিকায় কুমোরটুলি সর্বজনীন লেখে যে, ১৯৩৯ সালে ষষ্ঠীর আগে হঠাৎ এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তাদের প্রতিমা পুড়ে যায় এবং রাতারাতি গোপেশ্বর পাল সেই প্রথম একচালার মূর্তি ভেঙে নতুন করে পাঁচটি আলাদা নতুন মূর্তি তৈরি করে দেন। এখানে অবশ্য এর সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর কোনও যোগাযোগের উল্লেখ নেই।
এই একই কুমোরটুলি সর্বজনীন তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট www.kumartulisarbojanin.com-এ পরিষ্কার লিখেছে যে, ১৯৩৮ সালে বিধ্বংসী আগুনে তাদের প্রতিমা সম্পূর্ণ পুড়ে গেলে পুজো কমিটির সভাপতি সুভাষচন্দ্র স্বয়ং গোপেশ্বর পালকে অনুরোধ করেন, একরাতের মধ্যে আবার প্রতিমা গড়ে দিতে এবং সেবারই প্রথম গোপেশ্বর পাল সাবেকি একচালার প্রতিমা ভেঙে পাঁচটি পৃথক মূর্তি বানিয়ে সবাইকে হতবাক করে দেন। এখান থেকেই শুরু হয় প্রমাণহীন কল্পকাহিনির গৌরবময় মিথ্যা ইতিহাস, যে আমরা যে ফর্মে দুর্গার পরিবারের প্রতিমা দেখি, সেটি সৃষ্টির পিছনে রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণা। সত্যিই কি, ১৯৩৮ অথবা ১৯৩৯ সালে কোনও বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল, কুমোরটুলি সর্বজনীন দুর্গোৎসবে? কুমোরটুলির ইতিহাস নিয়ে বর্তমানে গবেষণারত গৌতম দত্ত বলেন যে, এরকম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সেবার পুজোয় হয়নি।
১৯৩৮ সালে দুর্গাপুজো পড়েছিল ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর এবং ১৯৩৯ সালে পুজো পড়েছিল ১৯ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর। সেই সময়ের সংবাদপত্র এবং দমকল দফতরের কোনও নথিতে এরকম কোনও অগ্নিকাণ্ডের উল্লেখ নেই। বরং, ১৯৩৮ সালের দুর্গাপুজোয় বৃষ্টি এবং বাংলার নানা স্থানে বন্যার রিপোর্ট আছে। ১৯৩৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, The Statesman পত্রিকার আবহাওয়া রিপোর্ট বলছে, 'Scattered thunder showers in South Bengal'। এহেন অবস্থায় বিরাট অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম।
তাহলে এই আগুন লাগা, প্রতিমা ও প্যান্ডেল পুড়ে যাওয়া এবং সুভাষচন্দ্রের অনুপ্রেরণা- ইত্যাদির 'কাহিনি' নির্মাণ হল কীসের ভিত্তিতে? যে দুই বছর সুভাষচন্দ্র কুমোরটুলি সার্বজনীনের সভাপতি ছিলেন, অর্থাৎ ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯- সেই দুই বছর তিনি সেই একই এলাকার অন্য একটি দুর্গাপুজো বাগবাজার সর্বজনীনেরও সভাপতি ছিলেন এবং এই বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসবে সুভাষচন্দ্র অনেক বেশি জড়িয়ে ছিলেন। কারণ, এই পুজোর সঙ্গে সেই সময় পুজোর মাঠে কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ সাহায্যে স্বদেশি মেলা এবং প্রদর্শনী হত।
কী আশ্চর্য, এই বাগবাজার সর্বজনীনের পুজোর মণ্ডপ ও প্রতিমা ১৯৪০ সালের ৬ অক্টোবর ষষ্ঠীর রাতে বিরাট অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। ১৯৪০ সালের ৭ অক্টোবর, অমৃতবাজার পত্রিকায় বিরাট হেডিং দিয়ে ছাপা হয়, 'Durga Image Burnt Down- Fire Accidents at Baghbazar and Chorbazar- Exibition totally demolished midnight outbreaks takes North Calcutta by surprise. Heavy loss to stall holders.'
অর্থাৎ, সত্যি সত্যিই প্রমাণ আছে যে ১৯৩৮ বা ১৯৩৯ নয়, তবে ১৯৪০ সালে কুমোরটুলি সর্বজনীনের একটু দূরের পূজা বাগবাজার সর্বজনীন পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল এবং অমৃতবাজার পত্রিকার একই দিনের রিপোর্ট পরিষ্কার লিখেছে, '...another image was quickly requisitioned and artists working through out the night finished it before the dawn'- অর্থাৎ সেই রাত্রেই শিল্পীরা নতুন প্রতিমা গড়া শুরু করেন এবং ভোরের আগে সেটা সম্পূর্ণ করেন।
তবে কী, সেবার বাগবাজারের প্রতিমাশিল্পী ছিলেন গোপেশ্বর? এমন দাবি কেউ কখনও করেননি। বরং, সংবাদপত্র বলছে, সেই বছরে অর্থাৎ ১৯৪০ সালেও 'The Kumartuli image made by G Pal & Sons looks replica of the past years though of course the image have gained in expressiveness.' তবে কী রাতারাতি বাগবাজারের নতুন মূর্তি গড়ার পিছনে সুভাষচন্দ্র বসুর কোনও নির্দেশ বা অনুপ্রেরণা ছিল?
সেটাও কার্যত অসম্ভব। কারণ, ১৯৪০ সালের দুর্গাপুজোর সময় সুভাষচন্দ্র প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি ছিলেন। আর, সেই বছর তিনি বাগবাজার সর্বজনীন পুজোকমিটির সভাপতিই ছিলেন না। বরং, প্রেসিডেন্সি জেলের বন্দিদের নিয়ে তিনি সেবার নিজের দুর্গোৎসব পালনে ব্যস্ত ছিলেন। সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে সুভাষচন্দ্রের অনুপ্রেরণায় বাংলার সাবেকি একচালার প্রতিমা ভেঙে নতুন ফরম্যাটে প্রতিমা গড়া শুরু হওয়ার কাহিনির পক্ষে এখনও পর্যন্ত কোনও গ্রহণযোগ্য প্রামাণ্য তথ্য নেই।
আরও পড়ুন- মান্দালয়ের কারাগারে দুর্গোৎসব- মাথায় রক্তচন্দনের টিকা আর বুকে লড়াকু শক্তি নিয়ে সেদিন সুভাষচন্দ্র
শুধুমাত্র ১৯৪০ সালের একটি প্রতিবেশী পুজোর অগ্নিকাণ্ড এবং কুমোরটুলি সর্বজনীন ও বাগবাজার সর্বজনীন, এই দুটি পুজোই একই বছরে (১৯৩৮ ও ১৯৩৯) সভাপতি থাকার সূত্রকে ধরে এই হাস্যকর অপাচ্য 'ইতিহাস' তৈরি করা হয়েছে এবং সমাজমাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। গোপেশ্বর পালের পরিবার থেকেও এই হাস্যকর ইতিহাসকে অস্বীকারই করা হয়েছে। কারণ, গোপেশ্বর পালের মত কিংবদন্তির শিল্পভাবনা কোনও রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে বা অনুরোধে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।