মঙ্গলবার সকাল থেকে মহড়া দিয়েছেন। সারা ক্ষণ শুধুই অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা। আর রাতেই সব শেষ। চলে গেলেন কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী কেকে। মঞ্চে থাকা স্পটলাইট বারবার বন্ধ করতে বলেছিলেন কেকে। তাঁর শরীরে যে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, সেটা অনেকেরই চোখে পড়ে। কেকের অনুষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কেউ কেউ বলছিলেন, ‘এদিন মঞ্চে প্রচণ্ড ঘামছিলেন গায়ক। কিছুটা অস্বস্তিও বোধ করছিলেন’।
তারপরই শো’ শেষে হোটেলে ফেরার পথেই গাড়িতে শীত শীত ও অনুভব করেন কেকে। গাড়িতে হোটেলে ফেরার পথে গাড়ির এসিও বন্ধ করতে বলেন তিনি। হোটেলে ফিরে যাওয়ার পরই খানিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। CMRI হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। ময়না তদন্তে দেখা যায়, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েছে কেকে’র। ময়না তদন্তের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কেকে’র শরীরে মিলেছে অ্যান্টাসিড। কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিক বলেন, “কেকে’র স্ত্রী’ও স্বীকার করেছিলেন কেকে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টাসিড খেতেন। সেদিনও কী শরীরের কিছু সমস্যা অনুভব করেই কী অ্যান্টাসিড খেয়েছিলেন কেকে? অনুষ্ঠানের আগেই কী তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শরীরে কিছু সমস্যা?
অনুষ্ঠানের দিন সকাল থেকেই অসুস্থ ছিল KK। অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েকঘন্টা হাতে থাকতেই হাতে ও কাঁধে ব্যাথাও অনুভব করেন তিনি। এমনটাই জানিয়েছে, কেকে’র ম্যানেজার রীতেশ ভাট। তিনি আরও বলেন, ‘সকাল থেকে বেশ দুর্বল এবং শরীরে কিছু সমস্যার কথাও ঘনিষ্ঠ মহলে জানান KK’। সেই অসুস্থ শরীরেই পারফর্ম করতে স্টেজে ওঠেন তিনি। হাতে থাকা ২০টি গানের লিস্ট। আর সেই ঝড় তোলা পারফরমেন্স। হাজার হাজার দর্শকের মাঝে সঙ্গীত পরিবেশন করছেন তিনি। মাঝে মধ্যেই ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ব্যাকস্টেজে সাদা তোয়ালে দিয়ে শরীরের ঘাম মুছে নিচ্ছেন KK। মঞ্চের আলো নিভিয়ে দেওয়ার কথাও বলতে শোনা যায় তাকে। ইশারায় এসি’না চলার ব্যাপারেও কিছু বলতে দেখা যায় KK কে। পাশাপাশি চোখে পড়েছে স্টেজে সারি বেঁধে দর্শক দাঁড়িয়ে, চুড়ান্ত অব্যবস্থার বেশ কিছু ভিডিও।
আরও পড়ুন: SSC ‘scam’: দায়িত্ব থেকে সরানো হল বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে, তুঙ্গে তরজা!
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, KK-র বাঁদিকের ধমণীতে ৮০ শতাংশ ব্লকেজ দেখা গেছে। পাশাপাশি অন্যান্য ধমনীতেও ধরা পড়েছে ব্লকেজ। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন শো চলাকালীন স্টেজের মধ্যেই গরমে গানের সঙ্গে নাচছিলেন তিনি। এর ফলে অত্যাধিক উত্তেজনার তৈরি হয়। দেহে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় শিল্পীর। অবিলম্বে সিপিআর দিলে শিল্পীকে বাঁচানো যেত বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
গাড়ি করে ফেরার পথেই শিল্পী বার বার বলছিলেন, ”আমার সাংঘাতিক ঠান্ডা লাগছে। গাড়ির এসি বন্ধ করো।” একথা জানিয়েছেন স্বয়ং তাঁর ম্যানেজার রীতেশ ভাট। অথচ প্রকাশ্যে আসা বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গিয়েছে শো চলাকালীন মারাত্মক ঘামছেন কেকে। বারবার তোয়ালেতে মুখ মুছছেন। ছায়াসঙ্গী ম্যানেজার বলেন, গাড়িতে উঠতেই মারাত্মক হাতে-পায়ে ক্র্যাম্প ধরে কেকে-র।
এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে গাড়ি থেকে নেমে নিজের পায়ে ভাল করে দাঁড়াতেও পারছিলেন না তিনি। কিন্তু তা-ও হোটেলে লবিতে অপেক্ষা করে থাকা অনুরাগীদের হতাশ করেননি। মাংসপেশিতে টান ধরার জন্য তাঁকে ধরে সোফায় বসানোর চেষ্টা করতেই তিনি পড়ে যান বলে জানিয়েছেন রীতেশ। পরে সেখানে বসে বমিও করে ফেলেন।
যদিও ময়নাতদন্তে উঠে এসেছে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের কারণেই মৃত্যু হয়েছে কিংবদন্তী এই শিল্পীর। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কেকে-র মুখে ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সেই সঙ্গে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে হোটেলের রুমে মিলেছে বেশ কয়েকটি অ্যান্টাসিডও। কেকে’র মৃত্যু প্রসঙ্গে চিকিৎসকরা যেটা অনুমান করছেন, অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অবিলম্বে সিপিআর দিলেও হয়ত বাঁচানো যেত প্রখ্যাত শিল্পীকে।
চিকিৎসকরা কেকে’র মৃত্যুর পর অ্যাসিডিটি এবং হার্টের সমস্যার মধ্যে কয়েকটি সাধারণ ফারাকের কথা জানিয়েছেন। শারদা হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ শুভেন্দু মোহান্তি বলেন, অনেকে হার্ট অ্যাটাককে হজমের সমস্যাগুলির সাথে গুলিয়ে ফেলেন। সেক্ষেত্রে বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, রক্তচাপ, ধূমপানের প্রবণতা ইত্যাদি নানান বিষয়গুলি মাথায় রাখা দরকার। তিনি বলেন যদি কারুর এই লক্ষণগুলি থাকে এবং বুকে ব্যাথা অনুভব করেন তবে তৎক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।
ডঃ এ গোপী বলেন, “কেকে’র ক্ষেত্রেও হয়ত একই সমস্যা দেখা গিয়েছিল। তিনি হত কনসার্টের আগেই বুকে ব্যাথা অনুভব করেছিলেন কিন্তু সেটাকে হজমের সমস্যা ভেবে অ্যান্টাসিড খেয়ে এড়িয়ে যান, যার ফলেই প্রাণ হারাতে হয় তাকে। হার্ট অ্যাটাক এবং হজমের সমস্যাগুলি কিছু সাধারণ উপসর্গ আলাদা থাকে। হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে বুকে ব্যাথার সঙ্গে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেবে। যেটা সাধারণ হজমের সমস্যার ক্ষেত্রে হবে না। দুটিকে আলাদা করে বোঝার জন্য অবশ্যই ইসিজি করা প্রয়োজন। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ইসিজিতে হার্ট অ্যাটাক ধরা পড়ে। বুকে ব্যাথা হলে অ্যান্টাসিড খাওয়ার ৩০ মিনিটের পরেও যদি সমস্যা না মেটে তাহলে অবিলম্বে ইসিজি করে নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন ডাঃ এ গোপী। তিনি বলেন, হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে প্রতিটি মিনিট মূল্যবান।