Advertisment

স্বাধীনতার ৭২ বছর: ট্রেনে করে নিয়ে আসতে হয় পানীয় জল

সকাল হতে না হতেই শিয়ালদহগামী ট্রেনে চেপে তাঁরা পৌঁছে যান বালি ঘাট, দক্ষিণেশ্বর বা বরাহনগর স্টেশন চত্বরে। রাস্তার কলের লম্বা লাইনে গোটা ২০, ২৫ জলের জার নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে জল ভরে আবার পরের ট্রেনে বাড়ি ফিরে আসেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ট্রেনসাইনের সামনে লাইন দিয়েছে জলের জ্যারিকেনরা।

স্থান, বালি ঘাট স্টেশন। হাতে ভারী জলের ড্রাম নিয়ে ক্রমাগত উঁচু সিঁড়ি ভাঙছেন বছর চল্লিশ পঞ্চাশের গৃহবধূরা। হাত মিলিয়েছেন বাড়ির ছেলেরাও। কথা বলার জো নেই কারোর। কেউ ইচ্ছুক হলেও ঘনঘন নিশ্বাস বাধা হয়ে দাঁড়ায় কথার মাঝে। কোথা থেকে এসেছেন? বা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জল? সে সম্পর্কে জানতে চাইলে উঠে আসে ভয়াবহ জল সঙ্কটের কথা। আরেকটু প্রশ্ন করতেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পায় নিজ নিজ এলাকার পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে।

Advertisment

rajchandrapur water problem সিঁড়ি বেয়ে জল ভরে নিয়ে মানুষ উঠছেন বালি ঘাট স্টেশনে, সেখান থেকেই ধরবেন ডানকুনি লোকাল। ছবি: অরুণিমা কর্মকার

জল আসবে আসবে করে কেটে গেছে ২৪ টা বছর। কিন্তু আর কতদিন? ট্রেনে করে দিনের পর দিন জল বয়ে আনতে নাভিশ্বাস উঠেছে হাওড়ার রাজচন্দ্রপুর এলাকার বাসিন্দাদের। তবুও কোনো হেলদোল নেই প্রশাসনের। এই এলাকায় নেই কোনো পানীয়জলের ব্যবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এলাকায় কুয়ো বা টিউবওয়েলের জলে রয়েছে প্রচণ্ড পরিমানে আয়রণ। কাজেই তা কোনোভাবেই খাওয়ার উপযোগী নয়। বহুবার জলের আবেদন করলেও কোনো লাভ হয়নি। তাই প্রশাসনের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছেন রাজচন্দ্রপুর এলাকার বাসিন্দারা।

শুকনো মরুভূমি অঞ্চল বা গভীর জঙ্গল নয়, কলকাতা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের গল্প। নামেই পঞ্চায়েত, এলাকার আদব কায়দা পুরোদস্তুর শহুরে। অথচ বালির নিশ্চিন্দা, দুর্গাপুর, অভয় নগর ১ ও ২, সাঁপুইপাড়া, বসিরহাটি, আনন্দনগর, সামরাইল পঞ্চায়েত এলাকার মানুষদের জল পেতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পার্শ্ববর্তী এলাকায় হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা বর্তমানে ৫০, ৬০ টাকা দিয়ে জল কিনে খেতেই অভ্যস্ত। কেউ কেউ আবার এই জল এনে দেওয়াকে ব্যবসায় পরিণত করেছেন। যারা জল কিনে খান, তাঁদের দাবি, দিন দিন জলের দাম চড়ছে।

rajchandrapur water problem দৈনিক সকালে স্টেশন চত্বরের কলে জল ভরার জন্য লম্বা লাইন। ছবি: অরুণিমা কর্মকার

রাজচন্দ্রপুর এলাকার এক বাসিন্দা জানান, সকাল হতে না হতেই শিয়ালদহগামী ট্রেনে চেপে তাঁরা পৌঁছে যান বালি ঘাট, দক্ষিণেশ্বর বা বরাহনগর স্টেশন চত্বরে। রাস্তার কলের লম্বা লাইনে গোটা ২০, ২৫ জলের জার নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে জল ভরে আবার পরের ট্রেনে বাড়ি ফিরে আসেন। তবে একবারে নিয়ে যাওয়া জলে গোটা দিনটা কাটানো সম্ভব নয়, তাই পরের পর ট্রেন ধরে অনেকবারই যেতে হয় জল আনতে। এমনভাবেই দিন কাটেছে রাজচন্দ্রপুর এলাকার বাসিন্দাদের। দিনের রান্না থেকে শুরু করে খাওয়ার জল, প্রয়োজনের সমস্ত জলই ট্রেনে করে বয়ে আনতে হয়। জল সঙ্কটের কথা তুললে বারংবার প্রশাসনের ওপর বিরক্তি জানান এলাকাবাসী।

আরেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, এক এলাকা থেকে অনেকে আসেন জল নিতে, কাজেই ভীড় জমে যায় জলের কলগুলিতে। অগত্যা তখন দূরের কল থেকেই জল আনতে যেতে হয়। কিন্তু অতগুলো জলের জার বয়ে আনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এদিকে আবার তাড়া থাকে পরের ট্রেন ধরার, চটজলদি স্টেশন পৌঁছনোর জন্য ভাড়া করতে হয় সাইকেল ভ্যান। যার খরচ দিন পিছু প্রায় ১০০ টাকা। ফলত দিন আনা দিন খাওয়া সংসারে সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। এদিকে দিন গড়ালে অফিস টাইমে লোকের মুখে কটুকথাও শুনতে হয়। কিন্তু উপায় নেই। ভীড়ে গাদাগাদিতেই জল নিয়ে আসতে হয় বাড়িতে।

আরও পড়ুন: স্কাইওয়াকের পৌষমাসে কি দক্ষিণেশ্বরে ব্যবসায়ীদের সর্বনাশ?

রাজচন্দ্রপুর এলাকার জল দিয়ে রান্না করলে ভাত লাল হয়ে যায়, রাতের বেলা সেই ভাতেরই রঙ হয়ে ওঠে কালো। যা কোনো ভাবেই খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না। ডাক্তার অমিতাভ নন্দী জানিয়েছেন, অতিরিক্ত আয়রণ পেটে গেলে পেট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে। সঙ্গে ডাইরিয়া এবং লিভারের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

rajchandrapur water problem উপায় নেই, খাওয়ার জল আনতে ভীড় ট্রেনেও এমনভাবেই যাতায়াত করতে হয় রাজচন্দ্রপুর এলাকার বাসিন্দাদের। ছবি: অরুণিমা কর্মকার

পঞ্চায়েত মন্ত্রী রাজীব ব্যানার্জি বলছেন, রাজচন্দ্রপুর এলাকায় জল নিয়ে আসার জন্য ১৫১ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। অনেক জায়গায় বসানো হয়েছে পাইপ লাইনও। আশা করা হচ্ছে, এবছরের মধ্যেই ওই এলাকায় চলে আসবে পানীয় জলের সুব্যবস্থা। তবে তিনি জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের কাজে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে রেল সংস্থা।

হাওড়া ডিভিশনে জয়পুর, এবং শিয়ালদহ ডিভিশনে বালি অঞ্চল দিয়ে পাইপ লাইন নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন রেলের অনুমতির। এদিকে রেলের মুখপাত্র রবি মহাপাত্র জানাচ্ছেন, যেখান দিয়ে পাইপ লাইন বসানোর আবেদন করা হয়েছে, সেখানে লাইন ধ্বসে যেতে পারে। তাই অন্য জায়গায় বসানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে দল গঠন করা হয়েছে। সমস্যা মিটে গেলে পাইপ লাইন বসানোর অনুমতি দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

রাজীববাবু নিজেই জানান, বালির জগাছা ব্লকে জল পানযোগ্য নয়। ফিল্টার করলেও জলের স্বাদ বা রঙ পরিবর্তন হয় না। তবে রেলের অনুমতি না পেলেও রাজচন্দ্রপুর এলাকায় তৈরি করা হচ্ছে ওয়াটার প্ল্যান্ট। কলকাতা শহরে যেমন গঙ্গার জলকে পরিশোধিত করে খাওয়ার জলের উপযোগী করে তোলা হয়, রাজচন্দ্রপুর এলাকাতেও ঠিক তেমনটাই করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। বর্তমানে প্ল্যান্ট তৈরির কাজ প্রায় শেষের পথে।

rajchandrapur water problem বালি জগাছা ব্লকে জল কখনই পানযোগ্য নয়। ফিল্টার করলেও জলের স্বাদ বা রঙ পরিবর্তন হয় না।

দুর্গানগর ১ ও ২, এবং অভয়নগর এলাকার বাসিন্দারা পরের মাসের মধ্যেই পানীয় জল পেয়ে যাবেন বলে খবর। অন্য জায়গা থেকে ওই অঞ্চলে জল আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রেল অনুমতি দিয়ে দিলে শুরু হবে বাকি কাজ। এমনটাই আশ্বাস দিয়েছেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী।

তবে নিশ্চিন্দা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারেন নি। তিনি বলেছেন, "আমিও সাধারণ মানুষ, আমিও চাই শিগগিরই জল চলে আসুক এলাকায়। কিন্তু এখন অবধি তা সম্ভব হয়নি।"

এদিকে দুর্গাপুর অভয়নগর এলাকায় পাইপ লাইন বসতে দেখে ধড়ে প্রাণ এসেছিল এলাকাবাসীর। তবে সে পাইপে আজও এসে পৌঁছয়নি জল। স্থানীয় বাসিন্দাদের পঞ্চায়েত থেকে জানানো হয়েছিল, তিন মাসের মধ্যে দুর্গাপুর অভয়নগরে ঢুকে পড়বে পানীয় জলের পাইপ। ঠিক, পাইপ এসে পৌঁছেছে, তিন মাস গিয়ে ঠেকেছে ছমাসে, কিন্তু সে পাইপে দেখা নেই পানীয় মিষ্টি জলের। কাজেই বিড়ালের ভাগ্যে আদৌ শিকে ছিড়ল কী না, সে প্রশ্নের উত্তর কে দেবে তা জানা নেই।

Howrah panchayat Independence Day
Advertisment