এই তো ক'দশক আগেও মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে ঘরে বোরোলিন, ডেটল, রবি ঠাকুরের দেওয়াল জোড়া ছবির মতোই বাধ্যতামূলক ছিল বসার ঘরের টেবিলের ওপর রাখা আড়াই ইঞ্চির বাংলা অভিধান। বদলানো সময়ে কতটা পাল্টালো ছবিটা? এই নিয়েই খোঁজ খবর নিতে পৌঁছনো গেল বই পাড়ার আনাচে কানাচে।
সংসদ বাংলা অভিধান। এপার বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিধান এটিই। সর্বশেষ (পঞ্চম) সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০০০ সালে। এরপর নতুন কোনও সংস্করণ নেই। একাধিকবার পুনর্মুদ্রণ হয়েছে অবশ্য। কিন্তু দীর্ঘ দু'দশকের বাংলা ভাষার বিবর্তন, শব্দের পালটে যাওয়া ব্যবহার, নতুন শব্দ, কিছুই কি তাহলে ধরা থাকেনি অভিধানে? প্রশ্ন নিয়ে পৌঁছে যাওয়া শিশু সাহিত্য সংসদের দফতরে। প্রাক্তন ডিরেক্টর দেবজ্যোতি দত্ত বললেন, "রোজ নতুন শব্দ আসছে বাংলা ভাষায়। সব যে অভিধানে ঠাঁই পাবে, এমনটা হয় না। এদের মধ্যে কিছু শব্দ কালজয়ী হবে, কিছু হারিয়ে যাবে। তাই ভাষার বিবর্তনের নিরিখে ২০ বছর খুব বেশি সময় নয়। তবে এটা আমরা স্বীকার করেই নিচ্ছি বাংলা ভাষায় যে সমস্ত অভিধান রয়েছে, তা শান্তিপুরের বাংলার ওপর ভিত্তি করেই লেখা। বাঁকুড়া কিমবা পুরুলিয়ার আঞ্চলিক শব্দ সেখানে পাবেন না"।
আরও পড়ুন, আমাদের নীতি আছে, নৈতিকতা নেই: গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার
ভাষাবিদ ডঃ পবিত্র সরকার মনে করেন অভিধান যেদিন প্রকাশিত হল, সেইদিন থেকেই পুরোন হয়ে গেল। তাই যারা অভিধান প্রকাশ করেন, তাঁদের এই চেষ্টাটা রাখতে হবে, প্রতি বছর না হলেও প্রতি পাঁচবছর অন্তর বাংলা ভাষায় আসা নতুন শব্দগুলো রাখতেই হবে। আর অভিধানকে ছাত্রপাঠ্যের বাইরে ছড়িয়ে দিতে চাইলে বাছবিচার না করে রকের ভাষা, আবার অতি উচ্চশিক্ষিতদের পরিশিলিত ভাষা দুইয়ের উল্লেখই রাখতে হবে অভিধানে। এখানে লোক সম্বল, প্রযুক্তিগত, দু'ধরনের সীমাবদ্ধতাই রয়েছে। তবু এই মুহূর্তে বাংলা ভাষায় সংসদের অভিধানের কোনও বিকল্পই নেই। চলন্তিকার অভিধানে এখন খুবই মুদ্রণত্রুটি পাওয়া যায়"
"বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে বিশুদ্ধতাবাদের পথে না হাঁটাই ভাল। কিছু শব্দের খুব সুন্দর বাংলা করেছে বাংলাদেশ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ফিনান্সিং এর বাংলা অর্থায়ন। এপার বাংলা এটা শিখতেই পারে। আবার হিন্দি ভাষা থেকে বাংলায় 'ধামাকা'র মতো শব্দ চলে এসেছে, এগুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করার তো দরকার নেই। বাংলা ভাষায় নানা বিদেশি ভাষার ব্যবহার প্রথম থেকেই ছিল। একটা সমাজে কোনও ভাষার গায়ের জোর বেশি, কোনও ভাষার কম। ইংরেজি ভাষা এক সময় আমাদের কাছে সাম্রাজ্যবাদের ভাষা ছিল, রাজভাষা ছিল। এখন সেটা বিশ্বের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভাষা হয়ে উঠেছে। আমরা এখন মনে করি বাংলা ভাষা শিখে আমরা চাকরি পাব না। তাই সেই ভাষার প্রতি আমাদের ভক্তি শ্রদ্ধাও বেশি। আমরা কথায় কথায় প্রমাণ করার চেষ্টা করি, আমরা ইংরেজি ভাষা জানি। আর তাই অ্যাকচুয়ালি আমি এটা মিন করিনি, এই ধরণের বাক্য তৈরি হয়"।
আরও পড়ুন, রফিক-সালাম-বরকতকে মনে আছে, আর ধীরেন্দ্রনাথ?
ভাষা বহমান থাকলে তাতে নতুন শব্দ জন্ম নেবে, আবার কালের নিয়মে কিছু শব্দ হারিয়ে যাবে, এটাই নিয়ম। সংসদের বাংলা অভিধানের পঞ্চম সংস্করণে ঢুকে পড়া সেরকমই কিছু শব্দের হদিশ দিলেন ভাষাবিদ এবং অভিধানকার সুভাষ ভট্টাচার্য। ক্যাডার, ঝাঁকিদর্শন, চামচা, গুরু, বনধ, মোর্চা, ফান্ডা এরকমই কিছু শব্দ। ষষ্ঠ সংস্করণে আসছে কোলাজ, মোরাম, সুখটান -এর মতো শব্দ। তবে নতুন সংস্করণ আসতে এত সময় লাগছে কেন প্রশ্ন করা হলে সুভাষ বাবু বললেন, "বাংলায় অভিধান লেখার ব্যাপারে টিম ওয়র্কের ক্ষেত্রে কিছুটা গাফিলতি রয়েছে"।
বাংলা অভিধান বিক্রি নিয়ে একটু হলেও আশার কথা বললেন কলেজ স্ট্রিটের কথাশিল্প। ৩৬ বছর ধরে বই বাজারের সঙ্গে যুক্ত থাকা অনিরুদ্ধ পোদ্দার বলছেন, "শেষ পাঁচ বছরে বাংলা অভিধান কিন্তু বেশি বিক্রি হয়েছে। আগে ইংরেজি অভিধানের চাহিদা বেশি ছিল, এখন সেই তুলনায় বাংলা অভিধানের চাহিদা বেশি। তবে এই প্রসঙ্গে সংসদের দেবজ্যোতি বাবুর ব্যাখ্যা অবশ্য অন্যরকম। তিনি বলছেন, "ইংরেজি অভিধান এখন কেউ কিনছে না। কারণ ইন্টারনেটে অনলাইন ডিকশনারি পাওয়া যায় এবং তা কম বেশি নির্ভরযোগ্য। অথচ বাংলা শব্দের অর্থ বা ইংরেজি শব্দের বাংলা সঠিক অর্থ পেতে গেলে ইন্টারনেটের ওপর ভরসা করা চলে না"।
কী করে একটু আদরে যত্নে রাখা যায় বাংলা ভাষাকে? এই প্রশ্নে সবাই এক মত - ভাষাকে নিয়ে গর্ব করতে হবে। এই ভাষায় স্বপ্ন দেখতে হবে, গল্প, আড্ডা, ঝগড়া, সোহাগ সব হোক এই ভাষাতেই।