ফুচকা। নাম শুনলেই কেমন জিভে জল এসে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কলকাতার ওলি গলির বিকেল, শাল পাতার বাটি, টকজলের গন্ধ। আলাদা করে কোনও বিশেষ রাস্তা কিমবা পার্কের নাম বলতে হয় না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলেই এদিক ওদিক থেকে কচিকাঁচাদের হরেকরকম ফরমায়েশ, "কাকু এদিকে ঝাল একটু বেশি, আরেকটু টক"। হ্যাঁ শ্যামবাজার, এসপ্ল্যানেড অথবা ঢাকুরিয়ার ছবিটা কম বেশি একই। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার পাটুলি সেন্ট্রাল পার্কের ছবিটা আলাদা। রোদের তেজ একটু কমল কী কমল না, পাটুলির মোড় থেকে একটু ভেতর দিকে চলে এল এক ফুচকার গাড়ি। ঠেলতে ঠেলতে আসছেন এক মাঝবয়সী মহিলা। হ্যাঁ, ঠিক পড়ছেন। ফুচকার গাড়ি এবং মহিলা। ২২ বছর ধরে এই ছবি দেখে চোখ সয়েছে পাটুলিবাসীর। কিন্তু শহরের অন্য প্রান্তে এখনও সরস্বতী মন্ডলকে চেনেনা কেউ।
ঝড়-জল-বৃষ্টি যাই হোক, সন্ধের আগেই ফুচকার গাড়ি নিয়ে ঠিক চলে আসেন সরস্বতী। ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটানা চলে আলুর পুর মাখা, টক জল বানানো। এক নাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে টান ধরে না? তেষ্টায় শুকিয়ে আসে না গলা? আসে তো। আর তাই সন্ধে গড়ালে সরস্বতীর কাজ একটু ভাগ করবে বলে চলে আসেন যে মানুষটা, তাঁর নাম ভবসিন্ধু। নামের মতো গুরুগম্ভীর নয় মোটে মানুষটা। বরং একটু লাজুক, মুখচোরা। জীবনসঙ্গীকে নিয়ে অবশ্য আলতো গর্ব আছে। দুএকটা কথায় ঠিক ধরা পড়ে তা।
আরও পড়ুন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা পাঠান আপনার প্রিয়জনদের
কী ভাবে দু দশক আগে ফুচকা বানানোর কাজে এল সরস্বতী? বিয়ের পর জয়নগরের কুলতলীতে ছিল নিত্য অভাবের সংসার। কাজ খুঁজতেই চলে আসা কলকাতার বুকে। ভবসিন্ধু নিলেন রিক্সা চালানোর কাজ। আর সরস্বতী কাজে লাগলেন বাড়ি বাড়ি। ততদিনে দুটো মেয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোটটা কয়েক মাসের। একবার ভীষণ জ্বরে কামাই হল। সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতেই বাড়ির মালকিন গায়ে হাত তুলল। সরস্বতীর জীবনের অসংখ্য অভিজ্ঞতারই একটা হয়ে থাকতে পারত দিনটা। হল না। এই ঘটনা আমূল বদলে দিল জীবন। চাকরি না, এমন কিছু করতে হবে, যেখানে নিজেই নিজের মালিক, ঠিক করে ফেললেন সরস্বতী। তারপর প্রথম ক'দিন ভুট্টা বিক্রি করা। মাস কয়েকের মধ্যেই ফুচকা বানানোর কাজ শিখে বসা শুরু করলেন পাটুলিতে।
এখন দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে ভরা সংসার সরস্বতী আর ভবসিন্ধুর। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক দেবে এ বছরেই। ছেলে মেয়েদের নামখানার হোস্টেলে রেখে পড়িয়েছে ওঁরা। উচ্চ মাধ্যমিকের আগে বাবা যাবে ছেলের হোস্টেলে। মায়ের বড় ব্যস্ততা। ভোর চারটেয় উঠে ফুচকা বানাতে হয়। খাটনির কাজ, ক্লান্তি আছে, জ্বরও হয় আগের মতো। তবে একেবারে বিছানায় না পড়লে সরস্বতী দোকান খোলে নিয়ম করে। এক আধ দিন না বসলেই পরদিন হাজার প্রশ্ন সামলাতে হয়, "কী দিদি শরীর খারাপ নাকি?", "কাল কী হয়েছিল", অথবা, "শরীর ঠিক আছে তো"? তাই সামান্য গা গরমকে আমল দেয়না।
আরও পড়ুন, আমার দুর্গা: মনীষা পৈলান
টাকা পয়সার টানাপোড়েন এখন তেমন নেই। রিক্সা চালিয়ে যা আয় হয়, তার থেকে অনেক বেশি টাকা আসে ফুচকা বিক্রি করে। এত বছর এলাকায় থেকে সেখানকার খদ্দেরদের সঙ্গে ভারী মিষ্টি সম্পর্ক সরস্বতীর। আকাশে মেঘ করলে কোনও বাড়ি থেকে ছাতা চলে এল। কোনও বাবা আবার মেয়েকে পড়তে বসিয়ে চুরমুর নিয়ে যাবে ঠোঙায় করে। ওদিক থেকে প্রশ্ন আসে, "বুড়ি হোমিওপ্যাথি বড়ি খাচ্ছে না? তাহলে টক দেব না ক'দিন"। তেষ্টা পেলে রাস্তার ওপারের দোকানে দাঁড়িয়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে নেয় সরস্বতী। "এদিকে তখন অপটু হাতে ফুচকার পুর মাখে ভবসিন্ধু। ঝগড়া হয়, অভিমান হয়, রাগও হয়, কিন্তু রাতের বেলা বাড়ি ফিরে একজন রান্না করলে আরেকজন বাসন ধুই। ঘুমোতে গেলে আর ঝগড়া থাকে না, সময় কোথায়?", ঝলমলে হাসিতে ভরা মুখটা নিয়ে বলল সরস্বতী মন্ডল।
আকাশের মুখ ভার হলে কোনও কোনও দিন একটু আগে ঘরে ফেরে দুজন। সন্ধে থেকে একটানা ধকল যায় বলে ফিরতি পথে একটু আস্তে আস্তে হাঁটে 'ফুচকা দিদি'। পেছন পেছন গাড়ি নিয়ে ওর স্বামী। টুকটাক সংসারের কথা বলতে বলতে ঘরে ফেরে ওরা। শুনতে পায়না আর কেউ। সরস্বতী, ওর বর অনেক খবর রাখে না। যেমন সরস্বতীদের জন্য আলাদা একটা নাকি দিন রয়েছে। সারা দুনিয়ায় একটাই দিন। ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস, কেউ বলে শ্রমজীবী নারী দিবস। প্রথম বার শুনল ওরা। ভুলে যাওয়ারও আগে ঘুম এসে যায় চোখে। ভোরে উঠতে হবে যে!