Advertisment

শুদ্ধি, কলকাতা পুলিশের উদ্যোগে জীবনের মূল স্রোতে ফিরছেন ওঁরা

দেবদারুর ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ আলোয় হাসি মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে হয়ে উঠেছে তখন। জল রঙ আর প্যাস্টেলের ছোয়ায় সাদা কাগজ প্রাণ পাচ্ছে নতুন করে। কারও খাতায় সিদ্ধিদাতা গনেশ, কারও খাতায় আঁকা কঙ্কালের ওপর রামধনুর রঙ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

চলছে মনসংযোগের শিক্ষা।

প্রিয়াঙ্কা দত্ত

Advertisment

প্যারেড গ্রাউন্ডে পরপর দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারুর ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ আলোয় হাসিমুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তখন। জল রঙ আর প্যাস্টেলের ছোঁয়ায় সাদা কাগজ প্রাণ পাচ্ছে। কারো খাতায় সিদ্ধিদাতা গণেশ, কারো খাতায় আঁকা কঙ্কালের ওপর রামধনুর রঙ, কোন খাতা আবার রঙিন ফুল, সবুজ পাতায় ভরে গিয়েছে। হাসছে ওঁদের মতোই। এই দৃশ্য এক বসে আঁকো প্রতিযোগিতার, যা কিন্তু আর পাঁচটা বসে আঁকোর থেকে আলাদা, অসাধারণও বলা যেতে পারে। একরাশ অন্ধকার থেকে আলোর দিকে হেঁটে যাওয়া কিছু মানুষের লড়াইয়ের অন্যতম মুহূর্ত।

কয়েক মাস আগেও মাদকাসক্ত জীবন কাটাতেন ওরা। অপরাধ, ড্রাগ, মদের নেশা যাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাপন অসম্ভব করে তুলেছিল, এখন তাঁরাই নতুন করে জীবনের মূল স্রোতে ফিরছেন, সৌজন্যে কলকাতা পুলিশের এক অভিনব উদ্যোগ, 'শুদ্ধি'। চলতি বছরের জানুয়ারী মাস থেকে শুরু হয় শুদ্ধির পথচলা। এবং এই চার-পাঁচ মাসেই অনেকটা সুস্থ তাঁরা, অনেকাংশেই স্বাভাবিক হয়েছে জীবনযাপনও। শহরের কয়েকটি হোমে রেখেই চিকিৎসা চলছে এঁদের। 

suddhi হোমে চলছে কাউন্সেলিং

আরও পড়ুন: Eid al Fitr holidays 2018: ভুয়ো বিজ্ঞপ্তি নিয়ে পুলিশের নোটিশ জারি

প্রধানত দুটি কারণে অভিনব 'শুদ্ধি'। এক, গভীরভাবে মাদকাসক্ত অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা। দুই, এই প্রচেষ্টায় সামিল করা সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে, যাঁরা কেবল অর্থ প্রদান করে এই উদ্যোগকে সমর্থন করবেন তাই নয়, চাইলে অন্য অনেক উপায়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমাজসেবা করতে পারবেন, যার বিস্তারিত বিবরণ তাঁরা পাবেন প্রকল্পটির ওয়েবসাইটে গেলে।  

চিকিৎসাধীন সুকান্তর কথায়, "শুদ্ধি আমায় নতুন জীবন দিয়েছে। এতদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম, এখন আর সবার সামনে আসতে ভয় পাই না। শুদ্ধির কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।" শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া শেষ করে নামী শেফ হতে চায় সুকান্ত। অন্যদিকে পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ অনুভব করতে শিখেছেন হোসেন। পিছুটান, পরিবার, কর্তব্য কাকে বলে, বুঝতে শিখেছেন তিনি। সুকান্ত-হোসেনের সহযোদ্ধা বিশ্বজিৎ কাঞ্জি হাসিমুখে স্বীকার করলেন তাঁর ভাবনাচিন্তার আমূল বদল ঘটেছে নিজের অজান্তেই। নেশার অন্ধকারের বাইরের এই জীবনটা তাঁর কথায়, "দারুণ ভাল লাগছে"। জীবনের অনেকটা 'সময় নষ্ট' হওয়ার জন্য আফসোস করছেন বছর ৩৫-এর ইকবাল, যাঁর সারা গায়ের ক্ষতচিহ্ন দেখলে শিউরে উঠতে হয়। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। ঘা এখন শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। বাইরের তো বটেই, ভেতরেরও। নারকীয় জীবন ছেড়ে ভাল থাকার স্বাদ পেয়ে খুশি প্রত্যেকেই। তাঁদের অকপট স্বীকারোক্তি, প্রায় ১০০ দিনেরও বেশি সময় ড্রাগ না নিয়েই দিব্য ভাল আছেন। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন ধীরে ধীরে। নতুন করে বাঁচতে চান আবার। 

publive-image

আরও পড়ুন: কলকাতায় যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়তে পারে ৫০০ বাড়ি

কীভাবে শুরু হয় 'শুদ্ধি'? প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ডিসি (সাউথ) মিরাজ খালিদের কথায়, "চুরি বা ছিনতাই-এর জন্য যাদের ধরে আনা হত, তারা ছাড়া পাওয়ার পর আবারও সেই একই জীবনে ফিরে যেত, নেশার জন্য টাকা জোগাতে একের পর এক অপরাধ করত, নিজেরাও নেশার দ্রব্য বিক্রি করত।" ক্রমে আইনের রক্ষকরা বুঝলেন, এই ধরণের অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে কোন উপকার তো হবেই না, বরং সমাজের ক্ষতিবৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রবল। রোগের চিকিৎসা প্রয়োজন, শুধু রোগীর নয়।এই অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের অপরাধীদের একটা সুস্থ জীবনে ফেরানোর ভাবনা থেকেই 'শুদ্ধির' পরিকল্পনা মাথায় আসে কলকাতা পুলিশ কর্তৃপক্ষের। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী, ব্যয়বহুল প্রকল্প, কাজেই নিজেরা যতই অর্থব্যয় করুন, কর্তৃপক্ষ বুঝলেন আরও সহায়তার প্রয়োজন। মিরাজ খালিদ বলেন, "এরপর ক্রাউড ফান্ডিং শুরু হয়, মূলত আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া পেজের মাধ্যমে। ইচ্ছুক ব্যক্তিরা যোগাযোগ করতে শুরু করেন। দেশ বিদেশ থেকে ব্যপক সাড়াও মেলে। সাধারণ মানুষ যাঁরা অর্থ সাহায্য করছেন, তাঁরা চাইলে দেখা করতেও আসতে পারেন।" 

এডিসিপি অপরাজিতা রাই জানান, "শুদ্ধি শুরু হয়েছিল দু'জনকে নিয়ে, এখন এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছেন ৪১ জন, সংখ্যাটা বাড়ছে ক্রমশ। পুরো উদ্যোগটাই চলছে ক্রাউড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে। এক্ষেত্রে যাঁরা অর্থ সাহায্য করছেন তাঁরা সরাসরি টাকা পৌঁছে দিতে পারেন। কোনও মাধ্যম নেই। আমরা যোগাযোগটা করিয়ে দিই মাত্র। কলকাতা পুলিশের কর্মীরাও নিয়ম করে দেখা করতে যান হোমের আবাসিকদের সঙ্গে। ওঁদের মাদকাসক্ত জীবন থেকে বের করে জীবনের মূলস্রোতে ফেরানোই আমাদের লক্ষ্য।" 

publive-image

আরও পড়ুন: দুঃস্থদের পাশে আসিফ, কলকাতায় খুলছে আরও ফুড এটিএম

এই প্রকল্পে সহযোগিতা করছে প্রাপ্তি ফাউন্ডেশন, যার কর্ণধার পরিক্ষিত ধরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল আবাসিকদের ছ'মাসের কোর্স করতে হয়। শরীরচর্চার পাশাপাশি সাইক্রিয়াটিস্ট এবং সাইকোলজিস্ট দ্বারা চিকিৎসাও চলে নিয়মিত। পাশাপাশি ভোকেশনাল ট্রেনিং হিসেবে হাতের কাজও শেখানো হচ্ছে। এখান থেকে বেরোনোর পর তাঁদের কাজও দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই দুটি প্রাইভেট সংস্থার সঙ্গে কথা বলে দুজনকে চাকরী দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে কলকাতা পুলিশ। 

publive-image

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিমা মুখার্জির কথায়, শহরে বহু নেশামুক্তি কেন্দ্র রয়েছে যেখানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা মাদকাসক্তদের চিকিৎসা হয় না। এতে শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। সেদিকটা নজর রাখতে হবে। "নেশায় আসক্ত হওয়ার প্রাথমিক কারণটা কী সেটা খুঁজে বের করে চিকিৎসা শুরু করা উচিৎ। ওরা যেখানে থাকছে সেই পরিবেশটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে বন্দিদশার ক্ষেত্রে। পাশাপাশি পরিবারের ভূমিকাটাও জরুরি, তাই মাদকাসক্তদের সঙ্গে পরিবারেরও কাউন্সেলিং দরকার হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই শোনা যায় চিকিৎসার নামে মানসিক অত্যাচার চলে নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলিতে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কলকাতা পুলিশের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।"

kolkata police kolkata
Advertisment