সত্যি বলতে কি, দশ বছর বাংলা, তথা, ভারতবর্ষের বাইরে থাকার ফলে দুর্গাপুজোর মহিমাটাই শরীর-মন-অন্তরাত্মা থেকে আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে। পুজোর গন্ধ, শরতের মেঘ, কাশফুল, পুজো আসছে-পুজো আসছে কলরব, প্যান্ডেল, বাঁশ ফেলার আওয়াজ, গড়িয়াহাটের ‘সেল’, চোখ-ধাঁধানো আলোর রোশনাই, ‘মাইকাতঙ্ক’, কিছুই নেই। কলকাতা আছে কলকাতাতেই, কিন্তু আমরা স্বেচছায় উৎখাত হয়ে যাওয়া বাঙালিরা নেই কলকাতায়। এখানে নেই সেই হঠাৎ করে জ্বলে ওঠা ঝলমলে সোনা রোদ্দুর, ঝিলমিল করে ওঠা নারকেল গাছের পাতা। এমনিতে ক্যানাডার আকাশ নৈসর্গপূর্ণ থাকে প্রায় অর্ধেক বছরই। কিন্তু কবিগুরুর ‘শেষের কবিতা’র অমিতের ভাষায়, “ভালো জিনিষ যত কম হয় ততই ভালো”, তাই কলকাতার রোদে-পোড়া ছাই আকাশ হঠাৎ ঠিক পুজোর আগে নীলাম্বরী সেজে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে মনকে যেরকম আলাদা ভাবে উতলা করে, তা ঠিক বাংলার বাইরে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না। নেশা জাগানো সেই স্বর্গীয় মহালয়ার মুহূর্তখানি মনের মধ্যে আলাদা করে যা আলোড়ন তোলে, তাতেই পুজো আসার আগে প্রেক্ষাঘর ‘হাউস্ফুল’ হয়ে যায় , সোজা হয়ে দাঁড়ানোই দায়। বাঙালী ভেসে যায় আবেগে।
বিদেশের আকাশ যতই চেষ্টা করুক, সেই অদ্বিতীয় আবেগ উদ্ভূত করতে পারেনা বাঙালির মনে। তাই এখানে যখন দুর্গাপুজোর প্রচেষ্টা দেখি, ফাইবার-গ্লাসের ঠাকুর, বছরের পর বছর একই মুর্তি, রেকর্ড করা ঢাকের বাজনা, ইউটিউবে মহালয়া, উইকেন্ডে উৎকট সজ্জায় বাঙ্গালিকে দেখি, তাদের জেন-ওয়াই ভারতীয় পোষাক পরে বলিউডের গানে নাচছে দেখি, সবই কেমন যেনো মেকি লাগে। না আছে ফুল, না বেলপাতা। স্মোক-অ্যালার্মের জ্বালায় না ধূপ, না ধুনো। এক আঁজলা প্রণাম করেই শাড়ির আঁচল সামলিয়ে, গহনা সামলিয়ে তারা চলে যান খিচুরি-ভোগের লাইনে। দেশ থেকে আনা বিভিন্ন শাড়ি ও গহনার পসার সাজিয়ে বসেন অনেকে, আর থাকে খাবার স্থানে দেওয়াল জুড়ে বিজ্ঞাপন। বলছি না কলকাতায় এর থেকে বিশেষ কিছু অন্যরকম হয়, কিন্তু ওটা কলকাতা। ওখানে সাত-খুন মাপ!
আরও পড়ুন, প্রবাসিনীর চিঠি: হা কৃষ্ণ
এতোবছর এরকম-ই দেখে মন নিভে গেছিল। দুর্গাপুজোয় সেজে-গুজে বেড়োনোর ইচ্ছেটাই চলে গেছিল। কিন্তু এবছর এক মন-ধাঁধানো ঘটনা দেখে তো আমি উৎফুল্ল! টরন্টোর রাস্তায় এবছর নেমেছে ঢাক। কাঁসর-বাদ্যি বাজিয়ে, ভারতের পতাকা বয়ে, ‘আমারপুজো টরন্টো’ নামক এক পুজোসমিতি করল দুর্গাপুজোর ঘোষণা। তাদের পড়নে কাছা ধুতি, পাঞ্জাবি। মহিলাদের অঙ্গে শাড়ি, হাতে শাঁখ । প্যানোরামা ইন্ডিয়া পারেডে অংশগ্রহণ করে পশ্চিমবঙ্গের প্রতীক হয়ে তারা ঢাকের সাথে নাচল টরন্টোর মস্ত-অকুস্থলে – ন্যাথান ফিলিপ স্কোয়ারে।
শুধু তাই নয়, ‘আমারপুজো’র শুভদীপ মিত্র বললেন, তারা নাকি পুজোর প্রাঙ্গণে প্যান্ডেলও করছেন কয়েক বছর ধরে। কোনো বছর দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, কোনো বছর রথ, আবার একবছর হয়েছিল প্যাগোডা। কলকাতার মহা-শিল্প প্যান্ডেলের কাছে যদিও এ যৎসামান্য, তবুও মনে হয়, যাক্, কিছুটা মন তো ভরল।
‘বঙ্গপরিবার’ নামক আর এক পুজোসমিতি অবাক করা এক কথা বলল । প্রেসিডেন্ট অমিতাভ চক্রবর্তী বললেন, প্রত্যেক বছর তাঁরা ১০৮টা পদ্মফুল আনান মালেশিয়া থেকে। সত্যিকারের ফুল! প্লাস্তিকের নয়। সেই ১০৮টা পদ্মফুল দিয়েই দেবীর বোধন হয়। উড়োজাহাজে আসে সে পদ্মফুল। এক বছর পুজো করেই তা ফেলে দেওয়া হয়। যেমন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ক্ষীরের পুতুল”এর ছোটোরানী পটিয়সীর জন্য যে শাড়িটি রাজা সাত-সমুদ্র-তেরো-নদী পেরিয়ে এনেছিলেন, সেই আকাশের মতন নীল, বাতাসের মতোন ফুরফুরে শাড়িটি এক দেশের রাজকন্যা একটিবার পরে মহাদেব নীলকন্ঠের পুজো করে, ঘরে এসে শাড়িটি ছেড়ে, দাসীদের দিয়ে দেন -- কেমন যেনো মনে পড়ে গেল এটা শুনে।
বঙ্গপরিবারের এক সদস্য এক বছর দেশ থেকে বেড়িয়ে ফিরল গলায় একটা আস্ত ঢাক ঝুলিয়ে। ইউটিউবে ঢাক অনেক শোনা হয়েছে, এবার থেকে বাজবে সত্যিকারের ঢাক! নাচবে ধুনুচি নাচ। অবশ্য আগুন ছাড়া।
তবে দুর্গোপুজোর সারমর্ম বজায় রেখেছেন কিন্তু সকলে -- এটা সর্বধর্ম সন্মিলনের একটি পারিবারিক উৎসব, হিন্দু ধর্মের শুধুমাত্র একটা ‘পুজো’ নয়। যে কারণে নানান ধর্মের নানান পরিবার এতে অংশগ্রহণ করতে কোনো বাধাই দেখেনা। মুসলিম, ক্রিসচান, শিখ, এমন কি, ভারতবর্ষ ছাড়াও অন্য দেশের মানুষ এই উৎসবে উৎসাহ পান। অর্থাৎ, এবার শুধু জাস্টিন ট্রুডো বাঙালির ঢাকের তালে ধুতি পরে যদি একবার নাচতে রাজী হন তো দুর্গাপুজো অক্লেশে এক আন্তর্জাতিক উৎসব হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। পুজোসমিতিরা কি এই চিন্তাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করবেন নাকি?
সেজন্যই এবছর নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আছে কনজারভেটিভ এমপি লিসা রাইট, কুস্তিগির টাইগার জিত সিং, টাইগার আলি সিং এবং আরো অনেক বিদেশি।
অবশ্যই দুর্গাপুজো মানেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিলবিল করা “যাদের খুশির অন্ত নেই” তারা একটা অত্যন্ত বাধ্যতামূলক “আমাদের সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে”র সাথে নাচ নাচবে, এবং তার সাথে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সমবেত গান জরুরী। তাছাড়া, এখানকার কিশোরকণ্ঠী, লতাকন্ঠী, আশাকন্ঠী ছাড়াও বিদেশ থেকে (মানে ভারতবর্ষ থেকে) সদ্য সা-রে-গা-মা য় বিজয়ী বা ইন্ডিয়ান আইডল এর বিজয়ী কে আনতে পারলে তো বাজিমাত! অন্তত ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডলার অবধি বাজেট থাকে প্রত্যেক পুজোর! মানে বাইশ থেকে তিরিশ লাখ ভারতীয় টাকা ব্যয়!
‘বঙ্গপরিবারে’র যে প্রতিমাটা পুজো করা হয়, সেটি বছর তিনেক আগে কলকাতা থেকে আনানো হয়েছিল। কালো প্রতিমা। কলকাতার প্রখ্যাত চিত্রকর, শুভমিতা ডিন্ডা, তার প্রথম দুর্গাপ্রতিমা বানিয়েছিলেন বঙ্গপরিবারের জন্য। প্রেসিডেন্ট অভিজিত বললেন ওটা বোধহয় ইতিহাসের প্রথম কালো দুর্গাপ্রতিমা।
কলকাতায় শুনলাম নাকি এবার থেকে অনবদ্য কিছু প্রতিমা ভাসান দেওয়া হবেনা, রেখে দেওয়া হবে? সত্যি নাকি? শিল্পকর্মকে সন্মান দেওয়ার এর থেকে বড় আর কিছু নেই। হোক না একই মুর্তি পুজো দু-তিন বছর ধরে, কিন্তু ওই সব অতুলনীয় প্রতিমা প্রত্যেক বছর জলে ফেলে দিতে বড়ই কষ্ট হয়।
সেদিক থেকে ক্যানাডার মাথাব্যাথা নেই। সরকারের কড়া আইন অনুযায়ী জলে ফেলার কোন প্রশ্নই নেই। তাই রেখে দিয়ে নতুন করে সাজিয়ে পুজো হয় প্রত্যেক বছর।
তবে এইবার কি কিছু রাস্তার ধারে আলাদা করে আলো লাগাবে? হই-চই করবে কি সারা ক্যানাডার মানুষ? দিওয়ালি আর চাইনিজ নিউ ইয়ারের মতন দুর্গাপুজোও কি উৎসবের তালিকায় পড়বে? না কি কলকাতার ছট্-পুজোর মতন রাস্তার ধার দিয়ে আমরা ঢাক বাজাতে বাজাতে যাবো, আর সবাই হাঁ করে দেখবে। বলবে “ও! ইন্ডিয়ান ফেস্টিভ্যাল”। ক্যানাডা বহুসংস্কৃতির দেশ বটে, কিন্তু জোর করে আমাদের উৎসব সবার ঘাড়ে চাপানোটাও ঠিক নয়।
তবে চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে শাড়ি পরে সেজে-গুজে শুধু ফ্যাসফ্যাসে খিচুড়ি-ভোগ খেয়ে মন হতাশ করে ফিরেও আসতে আর ইচ্ছে করেনা যে। একটু আলো, একটু উচ্ছলতার জন্য বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হলে কি সবাই আপত্তি করবেন? সরকার কি খুব রাগ করবেন?
প্রত্যেক বছর বাঙালির মন ভেসে যায় কলকাতায় মায়ের ত্রিনয়নের টানে। তবে বিদেশে বসে বাঙালি কলকাতাকেই দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে আসছে সাত-সমুদ্দর-তেরো নদী পেরিয়ে। তবে, আর দুঃখ কী?
আহা! এবার শুধু চাই রাস্তার ধারে ধারে কাশফুল!
একটা কথা বললে অবাক হবেন, এই পুজোর সময় কিন্তু ক্যানাডার রাস্তার ধারে সত্যি কাশফুলের মতন একরাশ ফুল ফোটে – খাগড়া। সাদা নয়, খয়েরি রঙের। বৈজ্ঞানিক নাম, ‘ফ্রাগমাইট অস্ট্রালিস’। একদম কাশ ফুলের মতন দেখতে। জন্ম বলে ইউরোপে। ছবিও দিলাম। এখানে হাওয়ায়-হাওয়ায় এসেছে। ওন্টারিও সরকারকেও বেশ বিপাকে ফেলেছে এই উদ্ভিদের আক্রমণাত্মক চরিত্র। সব হাইওয়ের পাশেই থাকে-থাকে হাওয়ায় দোলে এই গাছ। ঠিক দুর্গাপুজোর আগে এই প্রজাতির জন্ম হয় এবং এটিকে উদ্ভিদ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। পুজো শেষ হয় আর এগুলো ঝরে যায়। কি অদ্ভুত! গায়ে কাঁটা দেয় ভাবলে! তাহলে কি মায়ের জাদু সত্যি সত্যিই সারা বিশ্বের আকাশে-বাতাসে-ভূমিতে বিরাজমান? সর্বধর্ম, সর্বজাতি নির্বিশেষে বিদ্যমান? বাংলাদেশে, তথা শুধু ভারতবর্ষেই আবদ্ধ নয়? না কি, এটা পরাগকরণের সময়! এই সময়কার তাপমাত্রায় এইরকম আগাছা জন্মায় সব দেশে।
কে জানে?