পরনে কালো রঙের কোট, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল-মাসকারা...একঝলকে এহেন অবতারে তাঁকে দেখে আপনার চোখের ভাষায় প্রশ্ন খেলতেই পারে, ‘কে তুমি নন্দিনী?’ তবে মুহূর্তের মধ্যেই আপনার এই ভ্রান্তি দূর হবে। কারণ আদপে তিনি কোনও নন্দিনী নন। গায়ে কালো কোট জড়িয়ে আদালত কক্ষে সওয়াল-জবাব করে নজির গড়েছেন এই কাজলনয়না।
আলিপুর আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় সওয়াল-জবাব করে দেশের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী হিসেবে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন কলকাতার অদূরে সোনারপুরের মেঘ সায়ন্তন ঘোষ। এবার আরও এক নজিরের সাক্ষী হলেন মেঘ। শুধু কলকাতাই নয়, এ রাজ্যে এই প্রথমবার দুর্গাপুজোয় কোনও ক্লাবের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হচ্ছেন এক রূপান্তরকামী। বাগুইআটি জোড়ামন্দির নির্ভীক সংঘের পুজোর হোর্ডিংয়ে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে মুখ দেখাবেন মেঘ।
এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে মেঘ সায়ন্তন বলেন, "এটা খুবই সম্মানের। বাগুইআটি জোড়া মন্দির নির্ভীক সংঘের থিম মেকার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। উনি বলেন, ওঁরা এবার অন্যরকম কিছু করছেন। ওঁদের প্রস্তাব শুনে রাজি হই। কারণ সমাজের আর পাঁচজন রূপান্তরকামীর কাছে এটা একটা নিদর্শন হিসেবে থাকবে।"
শুধু বাগুইআটির ওই পুজো কমিটিই নয়, কলকাতার আরও কয়েকজন পুজো উদ্যোক্তাও মেঘকে তাঁদের পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর তাঁরা আর এগোলেন না কেন? জবাবে সায়ন্তন বললেন, "কলকাতার আরও কয়েকটি পুজো কমিটি আমার সঙ্গে প্রথমে যোগাযোগ করেন ওঁদের পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হওয়ার জন্য। কিন্তু পরে আর এগোননি। গড়িয়ার রামগড়ের একটি পুজো কমিটিও আমার সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু পরে ওঁরা জানান, ক্লাবের সিনিয়র সদস্যরা আমায় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন।" "পুরোনো ধ্যানধারনার" বশেই ওই কমিটিগুলি তাঁকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করার কথা প্রথমে ভাবলেও পরে পিছু হটে বলে মত এই রূপান্তরকামীর।
চলতি বছরের মার্চ মাসের কথা, খানিকটা সিনেম্যাটিক কায়দায় আলিপুর আদালতে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল মেঘের। যে ঘটনার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ওই আইনজীবীকে। কী হয়েছিল? কেনই বা প্রত্যাবর্তন? আর সেটা সিনেম্যাটিকই বা কেন? প্রশ্ন পেয়েই মেঘ গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন, "২০১২ সালে হাজরা ল’কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাস করি। ওই বছরই আইনজীবী হিসেবে আলিপুর আদালতে যোগ দিই। আমার চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, হাঁটাচলা, কথাবর্তা, চালচলন দেখে সকলে আমায় টিটকিরি দিতেন। এমনকি অনেক আইনজীবীও আমায় নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন। একটা সময়ের পর এসব নিয়ে আর লড়তে পারিনি। ২০১৪ সালে আলিপুর আদালত ছাড়ি।"
একথা বলেই ঢোঁক গিলে মেঘ আবার বলতে শুরু করেন, "কখনও ভাবিনি আদালতে ফিরব। গত তিন বছরে বহু মামলা এসেছে আমার কাছে। কিন্তু ওই টিটকিরি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ভয়ে আদালতে যাইনি। সব মামলা এক সিনিয়র আইনজীবীকে দিয়ে দিতাম। এরপর আমার এক বান্ধবী বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করেছিল, যা নিয়ে মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত ছিল। মোম দত্ত নামে ওই বান্ধবীর জোরাজুরিতেই শেষ পর্যন্ত এ বছর আবার আদালতমুখো হলাম।"
এ প্রত্যাবর্তন কিন্তু একেবারেই যেমন-তেমন ছিল না মেঘের জন্য। কারণ এই মামলার হাত ধরেই দেশে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন মেঘ।
বাগুইআটির সেই পুজোর হোর্ডিং
রূপান্তরকামী আইনজীবী হিসেবে প্রথম কোনও মামলা জেতা, কেমন ছিল জার্নিটা? জবাবে মেঘ বললেন, "তিন বছর পর যখন আদালতে ফিরলাম, তখন কিন্তু আর সেভাবে টিটকিরি সহ্য করতে হল না আমায়। মানুষগুলো কেমন যেন বদলে গেছে। আমার পাশে দাঁড়াচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে। এই বদল দেখে বেশ ভাল লেগেছিল। তবে এই মামলার বিরোধী পক্ষের আইনজীবী আমি রূপান্তরকামী বলে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে আরেক আইনজীবী এই মামলা লড়েছিলেন। ওই আইনজীবী বলেছিলেন, তিনি কোনও রূপান্তরকামীর সঙ্গে মামলা লড়বেন না। মামলার বিচারক বি সামন্ত খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন আমায়। এই মামলার পরই সবাই আমায় যেন নতুন করে চিনল। এখন যেখানেই যাই, সবাই খুব কদর করে আমার।"
ছোটবেলা থেকেই আইন নিয়ে পড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল? উত্তরে মেঘ বললেন, "উচ্চ মাধ্যমিকের পর বাবা-মায়ের জোরাজুরিতে আইনের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিই। তারপর পাকাপাকিভাবে আইন পড়া শুরু করি। তবে আইনজীবী হব সেরকম কোনও ভাবনা ছিল না আমার।"
একজন রূপান্তরকামীকে তাঁর পরিজনরা কি মেনে নিতে পেরেছেন? প্রশ্নটা শুনেই যেন মেঘের গলা বুজে এল। বললেন, "ছোটবেলা থেকে তো বাড়িতেও অনেক অপমানিত হয়েছি। বাবা তো প্রথমে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তবে মা বরাবরই সাপোর্টিভ আমার প্রতি। বাবা এখন আমার স্বীকৃতির কথা সকলকে বলে। কিন্তু এখনও বোধহয় পুরোপুরি মন থেকে মেনে নিতে পারেনি।"
আরও পড়ুন, Mr.Gay: এ দেশে সমকামিতার স্বীকৃতি নিয়ে আশাবাদী সমর্পণ
রূপান্তরকামী হিসেবে এ শহরে আরও এক নজির গড়েছেন মেঘ। প্রথম রূপান্তরকামী হিসেবে শহরে নাচের স্কুল খুলেছেন। সোনারপুরের বাড়িতেই বসে নাচের স্কুল ‘রুদ্রপলাশ’-এর আসর। এছাড়াও অন্যত্র তাঁর স্কুলের শাখা খুলেছে। নাচের স্কুল নিয়ে বলতে গিয়ে মেঘ বলেন, "আমি ভরতনাট্যম আর কুচিপুড়ি শিখেছিলাম। এখন নাচ শেখাই। যেখানে রূপান্তরকামীদের পাশাপাশি সমাজের মূলধারার ছেলেমেয়েরাও নাচ শিখতে আসে।"
নাচের স্কুলের কথা বলতে গিয়ে প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রসঙ্গ টানলেন মেঘ। বললেন, "ঋতুপর্ণ ঘোষ আমার আদর্শ। উনি যে বছর মারা গেলেন, সে বছরই আমি নাচের স্কুল খুলি। ওঁর মৃত্যুদিনে প্রতি বছর ‘ঋতু উৎসব’ এর আয়োজন করি।" রূপান্তরকামী হিসেবে নাচের স্কুল খুলেছেন বলে কোনও সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে? জবাবে মেঘ জানালেন, "এ বছর ঋতু উৎসব নিয়ে একটা সংবাদপত্রে ছবি প্রকাশিত হয়। যেখানে রূপান্তরকামীদের সঙ্গে কয়েকজন মূলধারার শিশুদের ছবি ছাপানো হয়েছিল। যা দেখে ওই শিশুদের অভিভাবকরা আমায় রীতিমতো অপমানিত করেন। কেন রূপান্তরকামীদের সঙ্গে ওঁদের বাচ্চার ছবি ছাপানো হল, তা নিয়ে প্রশ্ন করেন ওঁরা।"
রূপান্তরকামী হলে সকলেই নাম বদলান। পুরুষ থেকে কেউ লিঙ্গ বদলালে তাঁদের নামেরও লিঙ্গের ফারাক হয়। তবে আপনি নাম বদলালেন না কেন? জবাবে মেঘ বললেন, "আগে আমার নাম ছিল সায়ন্তন ঘোষ, এখন আমার ডাকনাম মেঘ শুধু যোগ করেছি। মনে প্রাণে জানি আমি নারী, সেটা খাতায় কলমে অন্যকে বোঝানোর কোনও মানে নেই। নাম নয়, কাজেই আমার পরিচয়। কাজের গুণ হিসেবেই আমার নাম থাকুক।"
রূপান্তরকামীদের নিয়ে সমাজকে আরও সচেতন করা হোক, এমনটাই চান মেঘ। শুধু তাই নয়, স্কুল-কলেজে এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি। বললেন, "এই সরকার অনেক সাহায্য করছেন, কিন্তু আরও সাহায্যের দরকার। রূপান্তরকামী বলতে অনেকেই বোঝেন, রাস্তায় সিগন্যালে দাঁড়িয়ে টাকা চাওয়া, কিন্তু সেটা কেন করতে হয় সেটা বোঝা উচিত। রূপান্তরকামীদের জীবিকারও দরকার।"
৩৭৭ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কোনও পজিটিভ রায় দেবে বলেই আশাবাদী মেঘ। সংসার করতে চান, কিন্তু অতীত তাঁকে অনেক ধাক্কা দিয়েছে এ নিয়ে। মনের মানুষের খোঁজ তো রয়েইছে। তবে মেঘ চান, তাঁকে মানুষ হিসেবে যদি কেউ গ্রহণ করেন, তবেই তিনি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলবেন। তবে তাঁর আশঙ্কা রয়েইছে, যেমন বললেন,‘‘কোন মা চান, যে কোনও রূপান্তরকামীকে তাঁর ছেলের বউ করে ঘরে তুলবেন? সেই সাহস আছে?’’