লোভে পড়ে গিয়ে হাজির হলাম সেই আশ্রমে। বেশ ঘন জঙ্গলের মধ্যে আশ্রম। জায়গার নাম বাথলি। মূল বাবাজী একজন বাঙালি। তিনি বেশ সাগ্রহে থাকতে দিতে রাজি হলেন আমায়। বললেন যতদিন ইচ্ছে থাকতে। সঙ্গে এটাও খুব গর্ব করে জানালেন যে তাঁর আশ্রমে যেকোনো নেশার দ্রব্যের প্রবেশাধিকার আছে। আমি সামান্য হকচকিয়ে গেলাম। যাইহোক ভাবলাম দুতিনদিন বিশ্রাম নেব এখানে। বাবাজীর ব্যাপারে সামান্য খটকাও লাগল। বাবাজীর হিন্দিতে স্পষ্ট বাংলার টান। কিন্তু বাবাজী দাবী করছেন দীর্ঘদিন প্রবাসে তিনি নাকি বাংলা ভুলে গেছেন। খুবই সন্দেহজনক। একটা ভাষা পুরোপুরি ভোলা সম্ভব নয়, বিশেষ করে সেটা যখন মাতৃভাষা। কিছু বললাম না আর। আশ্রমে উনি একা নন, আরও তিনজন রয়েছেন। একজন হরিয়ানার, একজন গুজরাট এবং একজন কেরালার। বেশ একটা সর্বরাজ্য সমন্বয় মার্কা ব্যাপার। কিন্তু গন্ডগোল বাধল পরেরদিন। উনি দেখি আমার সব ব্যাপারে ভুল ধরা শুরু করে দিলেন। আমার খাওয়াদাওয়া, কথাবার্তা, আচার ব্যবহার সবেতেই দেখি ওনার প্রবলেম রয়েছে। সাধারণত আমি সবজায়গাতেই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি প্রথম দিকে। এখানেও একটু অবাক লাগলেও কিছুই বললাম না। আশ্রমের জায়গাটি সত্যি অসাধারণ। বেশ খোলা জায়গা, সামনেই নর্মদা। ঠিক পাশেই আরেক বাবাজী একটা ঘর তৈরী করে একাই থাকেন। তিনিও বাঙালী, বাড়ি বর্ধমান। সন্ধ্যেবেলা তার সঙ্গে বসে শুরু হল গল্প। উনি নর্মদা পরিক্রমা করতে ১৯৯১ সালে সাইকেল নিয়ে অমরকণ্টক এসেছিলেন, আর ফিরে যাননি। সে এক দারুন অভিজ্ঞতার গল্প শুনলাম। গত দশ বছর ধরে উনি এইখানেই আছেন পুরো জঙ্গলের মধ্যে। এমনও সময় গেছে কোনো খাবার জোটেনি দিনের পর দিন। শুধুমাত্র নিমপাতা খেয়ে থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন। সে এক নিদারুন অভিজ্ঞতা, বেশ ঋদ্ধ হলাম। রাতের বেলা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন আরও দুজন। পরদিন সকালে উঠে ভাবলাম আজ বেশ লেখালেখি করব কিন্তু তখনই বিপদ। সেই বাবাজী হঠাৎ করে আমায় বললেন তুমি আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে যাও। আমি তো পুরোই অবাক। এতটা অপমানিত আগে হইনি। বুঝলাম উনি এখানে বেশ জাঁকিয়ে ব্যাবসা খুলে বসেছেন, আমি বেশীদিন থাকলে ওনার জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। বিনা বাক্যব্যয়ে আমি লোটাকম্বল গুটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আরও পড়ুন, পায়ে হেঁটে, ইচ্ছেমত নর্মদা (অষ্টম চরণ)
বেরিয়ে একটু বিপদের মধ্যেই পড়লাম। সাধারণত আমি একটু আগে থেকে হিসেবে করে নিই যে পরেরদিন কোথায় থাকব। কিন্তু আজ সেই সুযোগটুকুও দিলেন না উনি। মোটামুটিভাবে ম্যাপে দেখলাম যে কাছাকাছি রয়েছে ওমকারেশ্বর। হেঁটে গেলে পৌঁছাব না। প্রথমে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে একটা বাসরাস্তায় পৌঁছালাম। সেখান থেকে বাস ধরে পৌঁছালাম ওমকারেশ্বর। সেখানে আরেক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ওমকারেশ্বর বেশ বড় জায়গা। ফলত কোনও আশ্রমে আমার আশ্রয় জুটবে না। হোটেল খোঁজা শুরু করলাম। কিন্তু গন্ডগোল বাধল সেখানেই। প্রশাসনের নির্দেশে একা কোনও ব্যক্তি কোনো হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে পারবে না। তবুও নিষ্ফল চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। অবশেষে গজানন আশ্রমে একটা ডরমিটরির সন্ধান পেলাম। সেখানেই উঠব ঠিক করেছি। সেখানে আবার আরেক সমস্যা। সকাল আটটায় ডরমিটরি খালি করে দিতে হবে। ডরমিটরিতে থাকার সময় বিকেল চারটে থেকে পরদিন সকাল আটটা। ওমকারেশ্বর ঠিক নর্মদা নদীর মাঝামাঝি অবস্থিত। এখানে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। যারাই নর্মদা তীর ধরে হাঁটেন তারাই ওমকারেশ্বরে কিছুদিন থাকেন। আমার আর সেই উপায় থাকল না। কারণ একেতই থাকার জায়গা পাচ্ছি না, যাও বা পেলাম সেটা সকাল আটটায় ছেড়ে দিতে হবে। পিঠে ভারী ব্যাগ নিয়ে সব ঘোরা সম্ভব না। পরপর দুটি ঘটনায় বেশ আশাহত হলাম। কাল কোথায় যাব ভাবতে ভাবতে ডরমিটরিতে ঢুকলাম। সে এক লম্বা হলঘর, তাতে শয়ে শয়ে বিছানা পাতা। তার মধ্যে ২০৭ নাম্বার বেড আমার। বেশ একটা জেলখানা জেলখানা অনুভূতি এল। গণশোওয়া আর কাকে বলে!
ভোরবেলা বেশ মনখারাপ নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাব জানি না। সামনেই ইন্দিরা সাগর ড্যাম এবং ইন্দিরা সাগর সরোবর, সেইসঙ্গে পুনাসার জঙ্গল। লোকাল লোকজনের সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝলাম এর পুরোটাই বাসে পেরোনো আমার পক্ষে মঙ্গল। পরিস্থিতি অনুযায়ী তাই করলাম। বাসে যেতে যেতে ভাবতে বসলাম কোথায় গিয়ে নামা যায়। কিছুই ঠিকঠাক মনমত হচ্ছে না। সেই এক বাঙালী বাবাজীর পাল্লায় পড়ার পর থেকেই পুরো প্ল্যান চৌপাট হয়েই চলেছে। হঠাৎ করে বাসেই একটা জিনিস চোখে পড়ল। একটা বেশ বড় ব্যাগ, এবং তাতে পেন দিয়ে খাঁটি বাংলায় ‘ওঁম’ লেখা। ব্যাগের মালিক কে? খুঁজে পেলাম। প্রায় আমারই বয়সী একটি ছেলে। একটু আগ্রহ নিয়েই তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। নাম দেবাশিস রায়, বাড়ি বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী থানার অন্তর্গত হালদি পাড়া গ্রামে। প্রায় চার-পাঁচ বছর হল মধ্যপ্রদেশে শাড়ির ব্যবসা করছে। বর্তমানে খাতেগাঁও নামের একজায়গায় থাকে। আমি একটু ইতস্তত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম যদি রাতে থাকার একটা বন্দোবস্ত হয়। সে দেখি এক কথায় রাজি। বলল যে কোনো চিন্তা নেই। তার সঙ্গেই যেতে। চললাম!
একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওরা পাঁচজন থাকে। দেবাশিস রায়, সোমনাথ চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, বাবলু ধারা এবং প্রবীর ঘোষ। সবাই শাড়ির ব্যবসাই করেন। প্রত্যেকেই শিক্ষিত কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে চাকরী নেই। অতএব নিজের গ্রাম নিজের রাজ্য ছেড়ে মধ্যপ্রদেশে পড়ে আছেন। মুহূর্তে আপন করে নিলেন আমাকে। ভগবান আছেন কিনা আমার জানা নেই কিন্তু আমার মত অনাহূত অতিথিকে যারা আশ্রয় দেন মানুষ হিসেবে তাঁরা নিঃসন্দেহে অনেকের থেকে এগিয়ে আছেন। আমাকে পেয়েও তারা খুবই আনন্দিত। আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে আগ্রহী। আমার অনারে রাতে ভালোমন্দ খাওয়া দাওয়া হল। রাতে এই ভাবতে ভাবতে ঘুমালাম যে এক জায়গায় টাকাপয়সা দিয়েও থাকার জায়গা পাই না আবার অন্য জায়গায় কেউ অত্যন্ত আদরে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়।
সকালে বেরিয়ে আবার হন্টনপর্ব শুরু করলাম। এবার আবার নিজের ট্র্যাকে ফিরে এসেছি। গন্তব্য বিজলগাঁও। ম্যাপে দেখে নিয়েছি একটি নর্মদা মন্দির আছে। রাস্তার দুপাশে বাবলাগাছ, তাতে হলুদফুল। ভালোই লাগছে। নর্মদা মন্দিরে এসে পরিচয় হল অসাধারণ একজন মানুষের সঙ্গে। নাম দীপকবাবা।
আমি একা একা নর্মদা নদীতীরে হাঁটছি শুনে খুবই খুশী কারণ উনিও একাই নর্মদা পরিক্রমা করেছেন এবং এখন দ্বিতীয়বার পরিক্রমায় আছেন। উনি বর্ধমানের দয়ানন্দ সরস্বতী আশ্রমের একজন সন্ন্যাসী। আমার সম্পূর্ণ যাত্রাপথের বিবরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন। তারপর বক্তব্য রাখলেন। আমি কোন কোন জায়গা মিস করেছি এবং সামনে কোন কোন জায়গায় যাব তা বিশদে বলে দিলেন। সবই ওনার মুখস্থ। ওনার মত একজন মানুষ যদি আমার অভিযানের প্রথমেই পেতাম তো চিন্তা অর্ধেক কমে যেত।