তাঁর বাহন একটা ছোট্ট কালো রঙের স্কুটি। না, এ স্কুটি যেমন তেমন নয়। শহরের রাজপথে যেসব স্কুটি রোজ ছুটছে, তার থেকে এ স্কুটি একটু আলাদা। না, এ কোনও আশ্চর্য স্কুটিও নয়। আর চার-পাঁচটা স্কুটির মতোই সাধারণ। কিন্তু সাধারণ হয়েও অসাধারণ হিসেবে নজির করেছে এ স্কুটি। অবশ্যি, এসবের পেছনে স্কুটির মালিকের হাত রয়েছে। যিনি স্কুটি চালিয়ে এই মুহূর্তে শুধু কলকাতাতেই নয়, গোটা দেশেও এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।
স্কুটির মালিক তথা চালক বড়বাজারের এক ব্যবসায়ী, নাম কৈলাস মোহতা। কলকাতার রাস্তায় তাঁকে দেখে স্যালুট করেন ট্র্যাফিক পুলিশরা। সাধারণ মানুষ, যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁরা প্রকাশ্যে স্যালুট হয়তো করেন না, কিন্তু মনে মনে কুর্নিশ জানাতে ভোলেন না। অনেকে আবার বলেন, ‘‘আঙ্কল, দারুণ মেসেজ!’’
কিন্তু এই দারুণ মেসেজটা কী? কেনই বা তাঁকে দেখে ট্রাফিক পুলিশের মুখেও হাসির রেখা দেখা যায়! স্কুটির দুই হ্যান্ডেলে ছোটো সাইজের প্ল্যাকার্ড, আর চালকের পিঠে ব্যাগ নেওয়ার মতো করে লাগানো আরও একটি প্ল্যাকার্ড। যে প্ল্যাকার্ডে লেখা রয়েছে, ‘‘বিনা কারণে হর্ন বাজাবেন না।’’ একথা বাংলাতে যেমন লেখা রয়েছে, তেমনই লেখা রয়েছে হিন্দি ও ইংরেজিতেও। আর এভাবেই ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে কলকাতার রাস্তায় হর্ন বাজানোয় লাগাম টানতে নিজ উদ্যোগে সচেতনতামূলক প্রচার করে আসছেন কৈলাস মোহতা। শুধু দু’চাকাতেই নয়, চারচাকার ক্ষেত্রেও গাড়ির কাঁচে ‘নো হঙ্কিং’-এর পোস্টার লাগিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন কৈলাস মোহতা।
গতবছর থেকে এ শহরে নো হঙ্কিং প্রচার চালালেও, গত ৩০ বছর ধরে নিজের গাড়িতে হর্ন না বাজিয়ে কলকাতা চষে বেড়াচ্ছেন বড়বাজারের ওই ব্যবসায়ী। হঠাৎ এমন উদ্যোগের কথা মাথায় এল কীভাবে? জবাবে ৩০ বছর আগের স্মৃতিচারণা করলেন কৈলাসবাবু। তিনি বললেন,‘‘১৯৮৪ সালে লাইসেন্স পাই। এরপর ১৯৮৮ সালে আমেরিকা গিয়েছিলাম। এমবিএ পড়ার জন্য একটা ট্রেনিংয়ের জন্য সেদেশে প্রায় দেড় বছর ছিলাম। ওখানকার রাস্তায় দেখলাম হর্ন না বাজিয়ে কীভাবে সুশৃঙ্খল ভাবে সবাই গাড়ি চালাচ্ছেন। এরপর দেশে ফিরে আমিও ঠিক করলাম যে হর্ন বাজাবো না।’’
২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারির কথা, সেদিন প্রথম হর্ন বাজানো বন্ধ করতে সচেতনতামূলক বার্তা সমেত পোস্টার নিয়ে স্কুটি চালিয়েছিলেন কৈলাস মোহতা। সেদিন তাঁকে রাস্তায় দেখে অনেকে সাধুবাদ জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘আমি যখন রাস্তায় বেরোই এরকম পোস্টার নিয়ে, তখন দেখতাম আশপাশের চালকরাও গাড়িতে হর্ন বাজাতেন না। এখনও যখন আমি রাস্তায় বেরোই, তখনও আমায় দেখে অনেকে হর্ন বাজান না। কিন্তু আমার পক্ষে তো সবসময়ে রাস্তায় বেরোনো সম্ভব নয়।’’
কলকাতার মতো ঘনবসতিপূর্ণ জনবহুল এলাকায় হর্নের দাপাদাপি বন্ধ করা কি আদৌ সম্ভব? উত্তরে কলকাতার ‘নো হঙ্কিং ম্যান’ বললেন, ‘‘সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে প্রথমে। পাশাপাশি প্রশাসনকেও আরও উদ্যোগী হতে হবে। বিনা কারণে হর্ন বাজানোর অপরাধের শাস্তি আরও কড়া করা দরকার।’’ একইসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, গাড়িতে যেসব হর্ন লাগানো থাকে, তা নির্দিষ্ট ডেসিবেলের হওয়া উচিত। বিভিন্ন গাড়িতে বিভিন্ন ধরনের হর্ন লাগানো থাকে, যার শব্দ অনেকক্ষেত্রেই খুব চড়া। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও গিয়েছিলেন কৈলাসবাবু। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ কর্মসূচিতে নো হঙ্কিং মেসেজ অন্তর্ভুক্ত করা। যদিও তাঁর আক্ষেপ, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পরও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। তবে, এ বছরের জানুয়ারি মাসে শহরের এক প্রান্তে হোর্ডিংয়ে হর্ন বাজানো নিয়ে সরকারের সচেতনতামূলক বার্তা দেখে মন ভরেছে ওই ব্যবসায়ীর।
অবশ্য নিজে হর্ন একেবারে না বাজালেও অন্য কারও ক্ষেত্রে এমন নির্দেশ দেওয়ার পক্ষে একদমই নারাজ কৈলাসবাবু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কলকাতার রাস্তায় গাড়িতে হর্ন বাজান। কিন্তু অকারণে নয়। বারবার বলছি বিনা কারণে হর্ন বাজাবেন না। অধিকাংশ গাড়ি চালকই বিনা প্রয়োজনে হর্ন বাজান। অনেকে তো যানজটে আটকে থাকলেও গাড়িতে হর্ন বাজান আগে যাবেন বলে। এসব ক্ষেত্রে হর্ন বাজানোয় লাগাম টানতে হবে।’’
আপাতত কৈলাসবাবুর প্রধান লক্ষ্য, হর্ন বাজানো নিয়ে এ শহরকে সচেতন করা। সেজন্যই সম্প্রতি একটি সংস্থা খুলেছেন, যার নাম ‘সাইলেন্ট ক্রুসেডর’। এ নিয়ে ২৯ জুলাই ছিল ওই সংস্থার প্রথম বৈঠক। যে বৈঠকে ঢুঁ মেরে জানা গেল কৈলাসবাবুদের আরও জনমুখী উদ্যোগের কথা। কৈলাসবাবু জানালেন, তাঁরা একটি ওয়েবসাইট খুলছেন খুব শীঘ্রই। ফেসবুকেও পেজ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে প্রচার চালানো হচ্ছে। তবে এতেই শেষ নয়, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই শহরের বুকে বড় বড় হোর্ডিংয়ে নো হঙ্কিং নিয়ে প্রচার চালাবেন কৈলাসবাবু। পাশাপাশি স্কুল-কলেজেও এ নিয়ে চালানো হবে প্রচার।
আরও পড়ুন, এবার শহরে ঘুরবে ‘ফুড ভ্যান’, সৌজন্যে মোবাইল ফুড এটিএম
এত প্রচার করছেন তিনি, নো হঙ্কিং নিয়ে তাঁর হাতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা, কিন্তু আদৌ কি কলকাতার রাজপথের কান শান্তি পাবে? নো হঙ্কিং ম্যান বললেন, ‘‘সকলকে নিজে থেকে সচেতন হতে হবে। এ ব্যাপারে বুঝতে হবে। এজন্যই আমাদের লক্ষ মানুষকে সচেতন করা।’’
নো হঙ্কিং মিশনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এই মানুষটি। চার বছরের খুদে নাতিও দাদুর হাত ধরে হর্ন নিয়ে আওয়াজ তুলছে। আলতো গলায় কৈলাসবাবুর চার বছরের নাতির মুখেও শোনা গেল ‘‘হর্ন নিকাল দো।’’ কৈলাসবাবুর উদ্যোগের কথা মাথায় রেখে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে আপনিও যদি প্যাঁ-পোঁ করা বন্ধ করেন কিংবা কিছুটা লাগাম টানেন, তাহলে অনেকটাই সেরে যেতে পারে তিলোত্তমার কানের রোগ ।