সংকেত ভরদ্বাজ, পেশায় বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী। অন্য একটি পরিচয়ও রয়েছে সংকেতের। তিনি রূপান্তরকামী, এবং দেশের সব রূপান্তরকামীদের অধিকারের জন্য লড়ে চলেছেন অবিরাম। রাউরকেল্লা শহরে বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোর কথা ভাবলে এখনও বিষণ্ণ হয়ে ওঠে সংকেতের মন। "দীর্ঘদিন ধরে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতরে একটা পরিবর্তন আসছে, কিন্তু সেটা ঠিক কী, বুঝতাম না। একেক সময় ভাবতাম, এই সময়টা এক সময় কেটে যাবে, তখন সব আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাবে," হলো সংকেতের কথা।
"শহুরে অঞ্চলের মানুষ তাও কিছুটা প্রগতিশীল, কিন্তু আমার শৈশবের রাউরকেল্লায় সমকামিতা মেনে নেওয়ার কোনো মানসিকতাই ছিল না। আমার সমস্যা ভাগ করে নিতে পারব, এমন একটাও কাঁধ পাইনি। সম মনস্কদের খুঁজে নিতে হয়েছিল সোশাল মিডিয়ায়। যখন ভুবনেশ্বর চলে এলাম, ছবিটা বদলাল অনেক। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য বড় শহর অনেক ভাল। এখানে নিজের মতো করে থাকার সুযোগ থাকে," ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন সংকেত।
আরও পড়ুন: ৩৭৭ খারিজ, ঐতিহাসিক রায়ের দিনে ফিরে দেখা আইনি ইতিহাস
গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাকে বাতিল করল দেশের শীর্ষ আদালত। এই ধারা অনুযায়ী সমকামিতা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুপ্রিম কোর্টের রায় সমকামিতাকে আইনি স্বীকৃতি নিশ্চয়ই দিয়েছে। কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি কি আইন করে দেওয়া যায়?
এই যেমন ধরা যাক রুবেলের কথা। রুবেল চৌধুরী। ২০ বছর বয়সে বেরিয়ে এসেছিলেন বাড়ি ছেড়ে। ১৫ বছর বয়স থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন নিজের পরিবর্তনটা। তবে পাঁচ বছর সময় লাগে শুধু নিজেকে চিনতে। স্কুল কলেজের বন্ধুরা, শিক্ষকরা, এবং কিছু আত্মীয়স্বজন জানতেন রুবেলের রূপান্তরকামী সত্ত্বার কথা। রুবেলের কথায়, "শত আইনি স্বীকৃতির চেয়েও আমার অভিভাবকদের স্বীকৃতি আমার কাছে অনেক বড়। ওঁরা না মেনে নেওয়া পর্যন্ত আমি বাড়ি ফিরব না।"
তানিশার লড়াইটাও রুবেল বা সংকেতের থেকে খুব কিছু আলাদা না। "আমি যে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সদস্য, সেটাই কোনোদিন খোলাখুলি আলোচনা করতে পারিনি। জামশেদপুরে থাকার সময়ে এতগুলো বছর আমি আর পাঁচজনের মতো 'স্ট্রেইট' হওয়ার ভান করে গেছি। ভয়ে ভয়ে থাকতাম, পাছে কেউ ধরে ফেলে। একবার এক বন্ধুকে বলায় এত ঠাট্টা মশকরা করল, আস্তে আস্তে ওর সাথেও কথা বলা কমিয়ে দিলাম। এক সময়ে পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেল," জানিয়েছেন তানিশা।
আরও পড়ুন: Section 377 verdict decriminalised: রায় ইতিবাচক, রামধনু রঙ তিলোত্তমায়
আর্থিক স্বাধীনতার কথা ভুলে গেলেও চলবে না। ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে দেশের শীর্ষ আদালতে আবদন করেছিলেন যাঁরা, তাদের মধ্যে ছিলেন সুনীল মেহরা। নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে অন্যদের কাছে হাসির খোরাক হবেন, এই ভেবে যাঁর সিভিল সার্ভিসে কেরিয়ারটাই তৈরি করা হল না। সেই সুনীলের মতে, "আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতার জায়গা কর্ম সংস্থান। কর্মক্ষেত্রে অন্য সমস্যা তো আছেই। রোজ রোজ বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতে হবে সেখানে।"
এর মাঝেও চোরাগোপ্তা পথে কখনও এক ফালি আলো ঢুকে পড়ে এই দুনিয়ায়। মাঝে মাঝে হৈচৈ হয় তাঁদের নিয়ে। 'আলিগড়'-এর মতো ছবি টবিও বানানো হয়ে যায় এঁদের নিয়েই। আধা শহর অথবা মফঃস্বলেও পৌঁছে যায় সে সব ছবি। মানুষ জানতে পারেন, শহুরে সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এক জোট হয়ে অধিকারের জন্য লড়ছেন। একটু একটু করে জোর বাড়ছে তাঁদের গলায়। তাঁদের আওয়াজ, তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা পৌঁছে যাচ্ছে অনেক দূর পর্যন্ত।
তবু আইন পালটালে রাতারাতি পালটায় না সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। এখনও এ দেশে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় আঠারোর বহু আগে। পণ না পেলে বধুহত্যা হয়। 'নীচু' জাত ছায়া মাড়ালে পিটিয়ে আধমরা করে দেওয়া হয়। সমাজের বেঁধে দেওয়া কোনো না কোনো মাপকাঠিতে প্রান্তিক হলেই বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় আকছার। এরই মধ্যে আবার কোথাও সূর্য ওঠে, রাত ফিকে হয়ে ভোর হয়। সেই ভোরের অপেক্ষায় আমরা সবাই।