সুইটি কুমারী
২০০১ সালের কথা। উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি শহরে, রহস্যময় জ্বরের প্রকোপে প্রাণ গিয়েছিল বেশ কিছু মানুষের। ল্যাবরেটরিতে সে সংক্রমণের কারণ জানা যায়নি, ডাক্তাররা তার নাম দিয়েছিলেন ‘শিলিগুড়ি ফিভার’। ২০০৬ অবধি জানাই যায়নি এ জ্বরের কারণ নিপা ভাইরাস। এক বছর পরে, রাজ্যের আরেক জেলা নদিয়াও এ রোগের কবলে পড়েছিল। শিলিগুড়ি সংক্রমণই যে এদেশের প্রথম নিপা সংক্রমণ সে কথা এখন স্বীকৃত। জানয়ারির ২১ থেকে ফেব্রুয়ারির ২৩ পর্যন্ত এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা সে সংক্রমণে সরকারি হিসেবেই মারা গিয়েছিলেন ৪৯ জন। মৃতদের মধ্যে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া রোগীরা ছাড়াও ছিলেন চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল কর্মীরাও।
শিলিগুড়ির বর্তমান মেয়র অশোক ভট্টাচার্য সে সময়ে ছিলেন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী। তিনি জানালেন, ‘‘রোগের আতঙ্কে শিলিগুড়ির এক চতুর্থাংশ মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়েছিলেন।’’
সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে সে সময়ে খুবই বেগ পেতে হয়েছিল বলে মনে আছে তাঁর। ‘‘একটা হাসপাতালে প্রথমে সংক্রমণ দেখা দিলেও পরে তা ছড়িয়ে পড়ে আরও তিনটি হাসপাতােল। রেকর্ড অনুসারে ৬৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন চিকিৎসা চলাকালীন বন্ড সই করে চলে গিয়েছিলেন। রোগীদের ৭৫ শতাংশই ছিলেন হাসপাতালের কর্মী অথবা যাঁরা সংক্রমিতদের দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন।’’
আরও পড়ুন, Nipah Virus: অযথা আতঙ্কের কারণ নেই, বলছে স্বাস্থ্য দপ্তর
সে সময়ে শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন ডাক্তার এন বি দেবনাথ। সংক্রমিত সমস্ত রোগীদের সেখানেই রেফার করা হয়েছিল। ‘‘রোগটা কী সেটাই যেহেতু জানা ছিল না, সে জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসাও করা যাচ্ছিল না। ডাক্তাররা সহায়ক চিকিৎসা করার পাশাপাশি রোগীদের এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য অপেক্ষা করছিলেন’’।
গত বছর অবসর নিয়েছেন তিনি। ডাক্তার দেবনাথের কথায়, তাঁর কর্মজীবনে এ ঘটনা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সংক্রমণ যে কী, তা জানতে শিলিগুড়ি পৌঁছেছিলেন পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিট্যুট অফ ভাইরোলজির চিকিৎসকদের একটি দল, এসেছিলেন আহমেদাবাদের বিশেষজ্ঞরা এবং এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরাও। শুধু শিলিগুড়ি নয়, যেসব শহর থেকে রোগীদের রেফার করা হয়েছিল সেখানেও গিয়েছিলেন তাঁরা। এমনকি সংক্রমিতদের বাড়িতেও পৌঁছেছিলেন তাঁরা।
আরও পড়ুন, ট্যারানটুলা আতঙ্ক: কোথা থেকে আসছে এই অযথা হিস্টিরিয়া?
অশোক ভট্টাচার্যের মনে আছে কতটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন বিশেষজ্ঞরাও। ‘‘ভাইরোলজিস্টদের একটি দলের প্রস্তাব ছিল উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে নিপা আক্রান্ত রোগী ছাড়া বাকি সব রোগী ও হাসপাতাল কর্মীদের ছেড়ে দেওয়া হোক।’’ শিলিগুড়ি পুরসভার সক্রিয়তা ছাড়াও আরও একটি বিষয়ে যে তাঁদের উদ্যোগী হতে হয়েছিল। ‘‘আমাদের লোকজন রেল স্টেশন ও বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নজর রেখেছিল, সে সময়ে যে সব ডাক্তাররা শিলিগুড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল।’’
শেষ পর্যন্ত ভাইরাস নিজে নিজেই অকর্মণ্য হয়ে যায়। ২৩ ফেব্রুয়ারির পর আর কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি বলে জানালেন তিনি।