১৪ ফেব্রুয়ারি এলে ওঁরাও প্রেমের জোয়ারে গা ভাসাতে মুখিয়ে থাকতেন। কিন্তু প্রেম দিবসে আর চার-পাঁচজনের মতো নিজেদের মনের মানুষের হাতে হাত রেখে ঘোরার 'সাহস' হতো না ওঁদের। কিংবা পছন্দের মানুষের সঙ্গে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র পড়ন্ত বিকেলের রোদ মেখে ময়দানে ঘোরার 'স্পর্ধা' দেখাতেন না ওঁরা।
কেউ কেউ 'দুঃসাহস' নিয়েই ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে পার্ক-রেস্তোরাঁয় চলে যেতেন ঠিকই। তবে সেজন্য তাঁদের কানে ধেয়ে আসত নানারকমের টিটকিরি। কেউ কেউ আবার 'সমাজের চোখরাঙানির' ভয়ে চুপিসাড়েই প্রিয়জনকে প্রেম নিবেদন করতেন। সেই ওঁরাই এবার প্রথমবার 'স্বাধীনভাবে' ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র আনন্দে মাতবেন। ওঁরা বলতে, এলজিবিটি কমিউনিটির প্রতিনিধিরা। সুপ্রিম কোর্টের সেই ঐতিহাসিক রায়ের পর এবছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি কি ওঁদের আদৌ 'প্রথম স্বাধীন প্রেমের ভ্যালেন্টাইন্স ডে'?
"সমকামিতা অপরাধ নয়" - সুপ্রিম কোর্টের সেই যুগান্তকারী রায়কে হাতিয়ার করে এলজিবিটি কমিউনিটির অনেকেই এবার স্বাচ্ছন্দ্যে প্রেমের দিন উদযাপনে মাতবেন। অনেকে ইতিমধ্যেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র প্ল্যানও করে নিয়েছেন। যেমন দেশের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী মেঘ সায়ন্তন ঘোষ। সুপ্রিম রায়ের পর তাঁর কাছে এবারের ভ্যালেন্টাইন্স ডে খুবই 'স্পেশাল'। এ প্রসঙ্গে লাজুক হেসে মেঘ বললেন, "প্রথমবার স্বাধীন প্রেমের ভ্যালেন্টাইন্স ডে আমাদের। আমার কাছে খুবই স্পেশাল। বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেট করব দিঘায়।" মেঘের জীবনে ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে অবশ্য এত উচ্ছ্বাস আগে ছিল না। এ প্রসঙ্গে আইনজীবী বললেন, "আগে খুব ইচ্ছে করত যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে মাতামাতি করব। খুব ইচ্ছে করত অন্যদের মতো আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে গিফট দেব। কিন্তু তখন সেভাবে পারতাম না। নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম।"
আরও পড়ুন: প্রেম দিবসে গোলাপ ছুঁলে বিঁধতে পারে দামের কাঁটা
এই মুহূর্তে তাঁর মনের মানুষ নেই, তবুও এবারের ভ্যালেন্টাইন্স ডে গত বছরগুলোর থেকে 'বেটার' হবে বলেই মনে করছেন আরেক রূপান্তরকামী জয়িতা মণ্ডল। ইসলামপুর লোক আদালতের বিচারক বললেন, "যেহেতু সুপ্রিম কোর্টে বৈধতা মিলেছে, তাই আশা করছি বিগত বছরগুলোর থেকে এবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে বেটার হবে। পার্কে বা ডেটিংয়ে গেলে সেই চাহনিটা পাল্টাবে।"
জয়িতার সুরেই সুর মিলিয়েছেন 'মিঃ গে ইন্ডিয়া ২০১৮' সমর্পণ মাইতি। তিনি বললেন, "সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর অনেকেই আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন এখন। আমাদের কাছে এবারের ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র অনেক তাৎপর্য রয়েছে। সকলেই খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবে উদযাপন করতে চাইবেন।" শহরের প্রথম রূপান্তরকামী গাড়ি চালক পল্লবী চক্রবর্তীর কথায়, "আমার মনে হয়, এবারের ভ্যালেন্টাইন্স ডে অনেকটা কালারফুল হবে।"
এলজিবিটি কমিউনিটির সদস্য অভিনব বললেন, "আইনি দিক থেকে বৈধতা মেলায় কমিউনিটির সকলের মনোবল বাড়বে। ফলে এবারের ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপনে একটা বাড়তি জোর কাজ করবে।" একই কথা মেনেছেন স্যাফোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মীনাক্ষী সান্যাল। তিনিও বললেন, তরুণ প্রজন্ম হয়তো কিছুটা উদ্দীপনা পাবে। শহরের একটি ক্যাফের মালিক রাজরূপ ভাদুড়িও বললেন, "এবারের ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে মনোবল বাড়ানোর কাজ করবে সুপ্রিম কোর্টের রায়।" রূপান্তরকামী কুসুম সামন্ত বললেন, "সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এবার আমরা প্রেমের দিন সেলিব্রেট করতে অনেক সাহস পাব।"
আরও পড়ুন: ভ্যালেন্টাইন্স ডে আসলে বোন দিবস! জানতেন?
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সত্যিই কি এবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে স্বাধীন ভাবে মাততে পারবে এলজিবিটি কমিউনিটি? এ প্রসঙ্গে জয়িতা বললেন, "যতই সুপ্রিম রায় হোক না কেন, এখনও সোশ্যাল ট্যাবু বা সামাজিক বাধা রয়েছে।" ক্যাফে ড্রিফ্টারের রাজরূপও বললেন, "বদল আসতে এখনও অনেক দেরি। বদল আসতে অনেকটা সময় লাগে।" পরিচালক রণদীপ সরকারের কথায়, "যতই সুপ্রিম কোর্ট রায় দিক না কেন, এখনও অনেক পথচলা বাকি। এখনও অনেকে ট্যারা চোখে তাকান। যতক্ষণ না সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে, ততদিন স্বাধীন ভাবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করা যাবে না।"
কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষ রূপান্তরকামী মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ও বললেন, "ভালবাসা কোনও আইন মানে না। আইনের বদল হলেও ভালবাসা বরাবরই দুঃসাহসী। তবে সমাজ যতক্ষণ না বদলাচ্ছে, ততক্ষণ অনেকেই গুটিয়ে থাকবে।" সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বললেন মীনাক্ষীও। তাঁর কথায়, "সমাজ যেদিন বদলাবে, সেদিন প্রতিটি দিনই ভ্যালেন্টাইন্স ডে হবে। সামাজিক বদল রাতারাতি হবে না, সময় লাগবে।"