নিজের কিমবা কাছের মানুষটি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, কীভাবে বোঝা যায়? করণীয়ই বা কী?

কারও মনখারাপ মানেই তিনি ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের রোগী নন। কিন্তু যদি বিষন্নতার সময়টা ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে, তা যদি সংশ্লিষ্ট মানুষটির ব্যবহারিক জীবন, কাজকর্মের স্বাভাবিক গতিকে নষ্ট করে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসা প্রয়োজন।

কারও মনখারাপ মানেই তিনি ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের রোগী নন। কিন্তু যদি বিষন্নতার সময়টা ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে, তা যদি সংশ্লিষ্ট মানুষটির ব্যবহারিক জীবন, কাজকর্মের স্বাভাবিক গতিকে নষ্ট করে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসা প্রয়োজন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অভিজিৎ বিশ্বাস

সুশান্ত সিং রাজপুতের আকস্মিক মৃত্যুর পর বেশ কিছু দিন পেরিয়ে গিয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে প্রবল আলাপ আলোচনার স্রোত তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু প্রশ্নগুলো তো রয়েই গিয়েছে আর অধিকাংশ মানুষের কাছেই উত্তরও অজানা। মনখারাপ মানেই কি অবসাদ? যদি না হয়, তাহলে কী করে বুঝব কোনটা মনখারাপ আর কোনটাই বা অবসাদ? আদৌ কি প্রচুর কাজ করে বা প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলে অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব? যিনি অবসাদে ভুগছেন, ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছেন নিজের ভিতরে, একটু একটু করে পা বাড়াচ্ছেন আত্মহত্যার অন্ধকার গলির দিকে, তাঁকে জীবনে ফিরিয়ে আনার রাস্তাগুলোই বা কী? ডিপ্রেশন কি সত্যিই কেবল 'বড়লোকের সমস্যা', সত্যিই কি 'দুঃখবিলাস' ছাড়া আর কিছু নয়?  অবসাদ হলে আমরা প্রথমে কার কাছে যাব- মনোবিদ না সাইকিয়াট্রিস্ট? এমনই বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা বিশদে কথা বলেছে দুই বিশিষ্ট মনোবিদ মোহিত রনদীপ এবং অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।

Advertisment

মনখারাপ না অবসাদ- বুঝব কী করে? দুইয়ের মধ্যে ফারাক কী? মনোসমাজকর্মী মোহিত রনদীপ চেষ্টা করলেন সহজ করে বুঝিয়ে দিতে৷ তিনি জানালেন, মনখারাপের তুলনায় বিষন্নতার তীব্রতা অনেক বেশি৷ সাধারণ মনখারাপ স্বল্পস্থায়,  তার মধ্যে দিয়ে আমরা অনেকেই যাই। এতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। কিন্তু ডিপ্রেশন আমাদের দীর্ঘসময় আচ্ছন্ন করে রাখে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস যদি আমরা বিষন্ন হয়ে থাকি, তাহলে বুঝতে হবে সমস্যা গুরুতর। ডিপ্রেশনের সময় শরীর গতিহীন হয়ে যায়, এনার্জি কমে আসে৷ কোনও কাজ করতে পারি না আমরা। অজস্র নেতিবাচক চিন্তা আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে৷ মনে হয়, সামনের দিনগুলিতে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। গোটা জীবনটাই ব্যর্থ এবং এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী কেবল নিজেই। কোনও কিছুতেই আনন্দ পান না অবসাদে ভোগা মানুষ। কাজেই সাধারণ মনখারাপের সঙ্গে ডিপ্রেশনের কোনও মিল নেই।

আরও পড়ুন, পাল্টানো সময়ে ক্রমশ একলা হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম

প্রায় একই কথা বললেন অনুত্তমাও৷ তাঁর কথায়, জীবনের বিবিধ ঘাতপ্রতিঘাতে অনেকেই মনোকষ্টে থাকেন। এই অতিমারীর মতো পরিস্থিতিতে মনমেজাজ ভাল থাকার তো কথাও নয়। কিন্তু কারও মনখারাপ মানেই তিনি ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের রোগী নন। কিন্তু যদি বিষন্নতার সময়টা ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে, তা যদি সংশ্লিষ্ট মানুষটির ব্যবহারিক জীবন, কাজকর্মের স্বাভাবিক গতিকে নষ্ট করে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসা প্রয়োজন।

Advertisment

একজন ডিপ্রেশনে ভুগছেন কিনা, তা কি তাঁকে দেখে বোঝা সম্ভব? অনুত্তমার মতে, সবসময় কখনই সম্ভব নয়। কারণ অনেকসময়ই এমন হয় যে, অবসাদের রোগী নিজের অবস্থার কথা পাশের মানুষটিকেও জানতে দিতে চান না। চেষ্টা করেন লুকিয়ে রাখতে৷ সেই চেষ্টা সফলও হয়। কিন্তু অনেক সময় আবার বোঝা সম্ভবও বটে। অনুত্তমার কথায়, "বাড়ির লোকেরা যদি দেখেন একজনের আচরণ বদলে গিয়েছে, স্বাভাবিক প্রাণোচ্ছলতা আর নেই, তাহলে তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত সংবেদনশীল ভাবে কথা বলতে পারেন। যদি এমন হয় যে, একজন মানুষ যে কাজগুলিতে আনন্দ পেতেন, তা আর পাচ্ছেন না, হাসির সিনেমা দেখলেও তিনি ক্লান্ত বোধ করছেন, তাহলে বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখা উচিত। ক্লান্তি খুব জরুরি একটি চিহ্ন। ফোনে ডায়াল করতে ক্লান্তি তৈরি হয়, বিছানা থেকে উঠতেও ক্লান্ত লাগে।"

মোহিত বাবু অবশ্য জানালেন, "আত্মহত্যা করার কথা ভাবছেন এমন অনেকে কিন্তু পাশের মানুষজনের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চান। নানাভাবে বুঝিয়ে দিতে চান যে তিনি চলে যাচ্ছেন। কেউ আচমকাই ধার নেওয়া টাকা বা বই ফেরত দিতে থাকেন, কেউ কোনও কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে শুরু করেন। কিন্তু এগুলোর অর্ন্তনিহিত বার্তাটি আমরা অনেকসময় বুঝতে পারি না"।

অনুত্তমা এবং মোহিত- দু'জনেই মনে করিয়ে দিলেন, ডিপ্রেশনের সমস্যা রয়েছে এমন কারও সঙ্গে কথা বলার সময় প্রয়োজন চূড়ান্ত সংবেদনশীলতা। অবসাদে ভুগছেন এমন কেউ কথা বলতে চাইলে আমরা যেন সম্পূর্ণ নন-জাজমেন্টাল হই, জেরা করে না ফেলি যেন তাঁকে৷ কোণঠাসা হয়ে গেলে আরও অনেক বেশি সমস্যায় পড়েন রোগী।  অনুত্তমার কথায়, "অবসাদ নিয়ে সমাজে এখনও প্রচুর ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন,  অবসাদ বা অবসাদজনিত কারণে আত্মহত্যা একটি বিশেষ বয়সের সমস্যা। আদপেই তা নয়। এমনকি, একদম বাচ্চারাও অবসাদে ভোগে। অনেক সময়  অবসাদজনিত কারণে শারীরিক সমস্যা তৈরি হয় তাদের।"

আরও পড়ুন, লকডাউনে সোশ্যাল মিডিয়ায় খাবারের ছবি পোস্ট করা মানেই কি মানসিক বিকৃতি?

ডিপ্রেশনে দাওয়াই হিসাবে অনেকে কাজে ডুবে যাওয়ার পরামর্শ দেন। প্রচুর কাজকর্ম করলে নাকি অবসাদ কেটে যায়। কতখানি সত্যি এই ধারণা? মোহিতের মতে, এটি সর্বৈব মিথ্যা ও ভুল একটি ধারণা। অবসাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, এতে এনার্জি চলে যায়। ফলে কখনই জোর করে কাজকর্মে ডুবে থাকা সম্ভব হয় না। এমন করলে লাভের চেয়ে বরং ক্ষতি হয় বেশি। অনুমত্তার কথায়, "ডিপ্রেশন হলেই মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে যান। সাইকিয়াট্রিস্ট বা মনোবিদ- যে কোনও কারও কাছে গেলেই হবে৷ আপনার ওষুধ প্রয়োজন নাকি কাউন্সেলিং,  নাকি দু'টোই- তা ওঁরাই বলতে পারবেন।"

ডায়েরি লিখলে কি অবসাদ কাটে? মোহিতের মতে, কিছুটা ভেন্টিলেশন তো হয় বটেই। সকাল থেকে রাত অবধি আমরা অজস্র অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যাই৷ তার কতটুকুই বা আমরা প্রকাশ করতে পারি? অধিকাংশ অনুভূতিই ভিতরে জমতে থাকে৷ কোনও এক সময় সেগুলিই বিস্ফোরকের মতো ফেটে পড়ে। ডায়েরি লেখার অভ্যাস থাকলে কিছুটা হালকা হওয়া যায়।

সুশান্তের মৃত্যুর পর অনেকেই দাবি করছেন, অবসাদ নাকি বড়লোকদের সমস্যা৷ গরীব মানুষের অবসাদ হয় না। কতটা সত্যি এই ধারণ?  দুই মনোবিদই কার্যত উড়িয়ে দিলেন এই দাবি। অনুত্তমার মতে, সব বয়সের, সব পেশার, সব অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষেরই অবসাদ হতে পারে। মোহিত বললেন, "আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ কৃষক, চা শ্রমিক, গরীব মানুষ আত্মহত্যা করেন৷ তাঁদের অনেকেই অবসাদের শিকার। দারিদ্র, রোজগারহীনতার মতো সমস্যাও অবসাদের জন্ম দিতে পারে।"

নিম্মবিত্ত মানুষের পক্ষে অবসাদের চিকিৎসা সম্ভব? অনুত্তমা জানালেন, সরকারি হাসপাতালে খুব কম খরচে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা হয়। অনেক এনজিও বা বেসরকারি সংস্থাও সচেতনতামূলক কাজ করে৷ কাজেই বেসরকারি ব্যয়বহুল চিকিৎসাকেন্দ্রই একমাত্র গন্তব্য নয়। মোহিত অবশ্য মানছেন যে, সবকটি জেলা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে ঠিকই, কিন্তু তার প্রচার পর্যাপ্ত নয়। ফলে অনেকে জানতেই পারেন না।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন