Advertisment

অবোধমাঝি: ধুলামাটির বাউল

ঘরছাড়া মনের জানালায় গুনগুনিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোটোবেলায় শোনা এরকমই মাঠঘাট গ্রামঘরের টুসু পরবের গান, ইতুপুজোর ধূপধুনো। অচিন মানুষই বটে!

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Sanmatrananda

ছবি- মধুমন্তী, গ্রাফিক্স- অভিজিত

বছর চারেক আগের কথা।

Advertisment

ক্যানিং স্টেশনে যখন নামলাম, তখন দিনান্তকাল। বেলা পড়ে আসছে। শীতের দিন। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা এসে যাবে ভেবে দ্রুতপায়ে হাঁটছিলাম। ইচ্ছে হয়েছে মাতলা নদী দেখার। কখনও এদিকে আসিনি এর আগে। পকেটে পয়সা যা ছিল, চা-মুড়ি খেয়ে শেষ হয়ে গেছে। ভাবলাম, শিয়ালদা থেকে আসাযাওয়া দুই পিঠের টিকিট কাটতে পেরেছি, তাই রক্ষে, নাহলে আজ ফিরতাম কীভাবে?

হায়! তখন কি আর জানতাম, আজ আর কোনোমতেই ফেরা হবে না আমার?

বাজারের লোকজন বলল, নদী এখান থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। আমার লাগল বিশ মিনিটেরও বেশি। হাইওয়ে চলে গেছে ব্রিজের ওপর দিয়ে। ব্রিজে ওঠার আগে ডানদিকে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেছে শ্মশানের দিকে। বড় একটা হোর্ডিঙে লেখা—‘বৈতরণী’। ব্রিজের ওপারে কী? পানসিগারেটের দোকানদার বললেন, ‘ওপারে গ্রাম আছে, এদিকে তেমন কিছু নেই।’

নদীর কাছে যাই কীভাবে, ভাবতে ভাবতে ব্রিজের গোড়ায় বাঁদিকে একটা মাটির পথ দেখতে পেলাম। ওই পথ দিয়ে হাঁটছি। নরম মাটি। উঁচুনীচু রাস্তা। চাষের জমিতে জল দেবার জন্য চাষীরা রাস্তা কেটে নালা তৈরি করেছে। নালার উপর দিয়ে দুই বাঁশের সাঁকো। কিছুটা এগোতেই ডানদিকে কতোগুলো টিনের চাল দেওয়া বাড়ি দেখলাম। বন্যার থেকে বাঁচবার জন্য ঘরগুলো বাঁশের মাচার উপর নির্মিত। সজনে গাছ, পাকুড় গাছ, ছাইয়ের গাদা, ধানের ক্ষেত। দুয়েকটা নিভন্ত দোকান। শীর্ণ পথ।

সেই পথ ধরে কিছুদূর এগিয়ে একখানা কাদামাখা চর পড়ল। চর পেরিয়ে আসতে আসতে দেখলাম সামনেই মাতলা। বিস্তৃত পরিসর জুড়ে একা একা বয়ে চলেছে। নদীর একেবারে কাছে পাড়ের উপর গিয়ে বসলাম।

নদীটি বেশ গভীর ও বিস্তৃত। এখন শীতের দিন বলে বোঝা যাচ্ছে না। বর্ষায় এ নদী নিশ্চয়ই উঠে এসে চর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তীরভূমি সেজন্যই কর্দমাক্ত। নরম মাটির উপর ঘোড়ার নালে যে-কাদা ওঠে, মাটির রং সেরকমই কালো।

নদীর বুকের উপর স্থানে স্থানে প্লাস্টিকের জারিকেন ভেসে আছে। জারিকেনগুলোতে শক্ত কাছি বাঁধা। কাছির অপর প্রান্তে নীচে নিশ্চয়ই ভারি পাথর আছে। ওই পাথরগুলো নদীর তলদেশে প্রোথিত থাকে। এই জারিকেনগুলো দিয়ে নদীর বিভিন্ন স্থানের গভীরতা মাপা হয় বোধহয়। নদীতে এখন জোয়ার চলছে। মাছধরার নৌকাগুলি মাঝনদীতে কিংবা চরের কাছে স্থির হয়ে আছে। কতগুলো ভটভটিও আছে। সেগুলো যাত্রী নিয়ে এদিক ওদিক যাচ্ছে। নদী প্রায় দিগন্তসীমা অবধি বিস্তৃত। ওই পারে দেখা যায় অস্পষ্ট হয়ে আসা ছায়াছায়া কতগুলো গ্রাম।

নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে জলজড়ানো হাওয়ায় আমার ঘুম পেতে লাগল। আমার একটি নিজস্ব নদী আছে। সে নদী উত্তর ত্রিপুরার নদী। নাম—মনুনদী। তাকে আমি একবারই কয়েক প্রহর জুড়ে দেখেছিলাম। সেই মনুনদীকে ভালোবেসেছিলাম; সে মিশে গেছে আমার সত্তার সঙ্গে। আমি ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে টের পাচ্ছিলাম, আমার রক্তের ভিতর থেকে মনু আর মাতলা কথা বলছে। একাত্ম হয়ে যাচ্ছে।

‘বাউনগাছি যাবেন নাকি?’ কার একটি কণ্ঠস্বরে তন্দ্রা ভাঙল। দেখি, পাড়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে একটি নৌকা। তাতে বছর কুড়ির একটি ছেলে। নৌকায় মেশিন ভটভট করছে। আমি হেসে বললাম, ‘নাহ, কোথায় আর যাবো? এই বসে আছি। আর আমার কাছে যাওয়ার মতো পয়সাও নেই।’

সে বলল, ‘পয়সা লাগবে না। আমি এমনিতেই যাই বামুনগাছি। যাবেন তো আসুন, মেলা দেরি করেন না। বাউনগাছি নে যাবো। আবার ফিরিয়ে নে এসি একেনেই রেকি যাবো। যাবেন তো আসুন।’

নদীতে ঘোরার এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায়? ছেলেটি নৌকা থেকে একটা তক্তা ফেলে দিল পাড়ের উপর। তাতে পা রেখে চটি হাতে সন্তর্পণে নৌকাতে উঠে গেলাম। ছেলেটির নাম অবোধ। অবোধবন্ধু দাস। ভ্রামণিক লোকেদের নৌকা করে এদিকসেদিক বেড়াতে নিয়ে যায়।

বললাম, ‘অবোধ, বিড়ি আছে?’

সে বলল, ‘তা আচে। এই ন্যান। ধরিয়ে বসুন সুখ করি। বাবু হয়ি বসতি পারেন। বা পা ঝুলিয়েও বসতি পারেন নৌকার মধ্যি।’

নৌকা চলতে লাগল ব্রিজের তলা দিয়ে। দুপাশে জল, জমি, ঝোপঝাড়। স্রোতের বিরুদ্ধে নৌকা যাচ্ছে, তাই সময় লাগছে। অবোধ মেশিনের কাছে দাঁড়িয়ে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওইদিকে কী গ্রাম?’

মেশিনের ভটভট আওয়াজটা একটু কমিয়ে মুখভর্তি বিড়ির ধোঁয়া নদীর বাতাসে ছেড়ে অবোধ বলল, ‘কাঁঠালবেড়িয়া। লোকের হাড়ের ব্যামো হলি নয়তো হাড় ভাঙলি ওই গেরামে নে যায়। ওই গেরামে কোবরেজ আচে। রতন কোবরেজ। হাড় জোড়া দিই দ্যায়।’

আমি আর কিছু না বলে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে অবোধ বলল, ‘আপনার গেরাম কোতা?’

আমি বললাম, ‘আমার কোনো গ্রাম নেই। এমনিই ঘুরেঘেরে বেড়াই।’

—খান কী? চলে কী করি আপনার?

—এই যেমন তেমন করে।

অমনি নৌকার ছাউনির নীচ দিয়ে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে আমার কাছে পাটাতনের উপর হাঁটু গেড়ে বসে উজ্জ্বল চোখে সে বলল, ‘ওই দ্যাকো! দ্যাকবামাত্তই আমি বুজিচি। আপনি অচিন মানুষ!’

আমি বললাম, ‘সে আবার কী?’

—উহুঁহুঁ, একুন আর ফাঁকি দিলি হবে ক্যানো? আসে মধ্যি মধ্যি আমাদের গেরামে। তেনারা সব অচিন মানুষ। বে-থা করে না। ঝে ঝা দ্যায়, তাই খায়। যেকেনে সেকেনে রাত্র কাটায়। ঘর নাই, বাড়ি নাই। চালচুলা নাই। সোন্দর সোন্দর কতা কয়। গান গায়। আবার কখুন ঝে চলি যায়, কেউ বলতি পারে না।

আমি হেসে বললাম, ‘তুমি তো টাকা নিয়ে বেড়াতে নিয়ে যাও অন্যদের। আমাকে হঠাৎ বিনা পয়সায় নৌকায় চাপতে দিলে যে?’

—এ বেলা আমার কাজ শেষ হয়্যাল। যাচ্চিলাম বাউনগাচি বাজার কত্তে। দেখনু, বসে আচ নদীপাড়ে। দেখে  ঝা সোন্দর লাগল। ভাবনু, নে যাই বাউনগাচি। পুণ্যির কাজ হবে।

কথায় কথায় অনেক দূর আসা হল। অবোধ নৌকাকে একটি ঘাটলার সমীপবর্তী করে কাছি দিয়ে বাঁধল। একটা চটের ব্যাগ নিয়ে নদীর পাড়ে নামল। যাবার আগে বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাই ট্যাঁক থেকে বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘বইয়ে থাকো। আমি যাবো আর আসবো। এক বান্ডিল বিড়ি দিয়ে গ্যালাম। বয়ে বয়ে বিড়ির ছেরাদ্দ কর।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাদামাখা পথ বেয়ে সে হন হন করে হেঁটে মিলিয়ে গেল।

সন্ধ্যা এসেছে। নিস্তব্ধ নদীতীর। দুয়েকটি তারা ফুটে উঠছে জলাজংলার উপরের আকাশে। নদীর বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে শামুকের গায়ের ঘ্রাণ, পানকৌড়ির পালকের গা বেয়ে গড়িয়ে নামছে নক্ষত্রের অশ্রুবিন্দু। ঘরছাড়া মনের জানালায় গুনগুনিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোটোবেলায় শোনা এরকমই মাঠঘাট গ্রামঘরের টুসু পরবের গান, ইতুপুজোর ধূপধুনো। অচিন মানুষই বটে! নিজের কাছেই অচিন থেকে গেলাম সারা জীবন।

আধঘণ্টার মধ্যেই অবোধ ফিরে এল। বাজার করেছে। থলির কানা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আছে লাউলতা। আরেকটা প্লাস্টিকের ব্যাগে মাছের টুকরো। অবোধের আজ সারাদিন আয় হয়েছে ভালোই বোধহয়।

প্লাস্টিকের ব্যাগটা মুখের কাছে তুলে ধরে সে সোল্লাসে বলল, ‘মাছ কিনলাম। বাড়িতে তুমি আজ রাতে থাকবে। বলে অতিথ-ফকির! ভালো করি খাওয়াতে হবেনে?’

আমি বললাম, ‘বলো কী, অবোধ? আমার যে ফেরার টিকিট কাটা আছে!’

—টিকটিস ফেলি দাও মাতলার জলে। আজ আমি তোমাকে ছাড়চিনি। আমার ঘরে আজ রাত্র থাকবে। খাবে, ঘুমাবে। কাল সকালে চলি যাবে গুটিগুটি। আমি টিকটিসের ট্যাকা দিয়ে দেবানে।

মনে মনে ভাবলাম, ভালোই হল। যাবো আর কোন চুলোয়? এমন নদীর বাতাসে নিশিযাপন; এমন অপূর্ব সুযোগ জোটে কার ভাগ্যে? আমি আর আপত্তি করলাম না।

ঘণ্টাখানেক নদীপথ দিয়ে বেয়ে এসে চড়ার কাছে এক জায়গায় নৌকা বাঁধল সে। তারার আলোয় ছাওয়া পথ বেয়ে গান গাইতে গাইতে বাজারের থলে হাতে চলেছে অবোধমাঝি। আর আমি তারই পেছন পেছন।

টিনের চালের একহারা ঘর। বাঁশের মাচার উপর। ঘরে সে একাই থাকে। ছোটোবেলায় মা-বাপ মরে গেছে। এখনও বিবাহাদি করেনি। মাতলায় নৌকা বায়। পারার্থীদের পার করে। ভ্রামণিকদের বেড়াতে নিয়ে যায়। আরও কীসব করে পেটের দানাপানি জোগাড় করার জন্য।

রাতে মাছের ঝোল, লাউয়ের ডাঁটার তরকারি দিয়ে কুপীর আলোয় বসে দুজনে পেট ভরে ভাত খেলাম। খেতে খেতে রাত হল বেশ।

খাওয়ার পর জ্যোৎস্নায় চরের উপর আমি আর অবোধ বসে আছি। অন্ধকারে বিড়ির নীল ধোঁয়া মায়াকুহক রচনা করেছে। অবোধ বলল, ‘তুমি তো অচিন মানুষ। গান জানো না? গান গাও দিনি। শুনি।’

খানিক ইতস্তত করে গাইলাম, ‘নীলবরণী নবীনা রমণী নাগিনীজড়িত জটাবিভূষিণী; নীল নলিনী জিনি ত্রিনয়নী নিরখিলাম নিশানাথ-নিভাননী...’

আলোআঁধারিমাখা সেই অস্ফুট নদীতীর... হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যাওয়া কবেকার শিবচন্দ্রর লেখা কালীকীর্তনের তন্দ্রামদির সুর... মুগ্ধ মাঝি অবোধবন্ধু দাস... আর সেই অপার্থিব মায়ায় আবৃত ঐশী নিশাকাল...

পরের দিন সকালে ফিরে এসেছিলাম কলকাতায়। সে প্রায় চার বছর আগের কথা।

মাস তিনেক আগে এই সেদিন আবার গিয়েছিলাম ক্যানিং, মাতলাপারে। সেই জায়গাটায় গেলাম। কিন্তু আশ্চর্য! সেই বাড়িটার চিহ্নমাত্র নেই। তার জায়গায় পড়ে আছে শুধু কয়েকটা বাঁশ, ভাঙা করোগেটেড টিনের চাল আর নিঃস্ব হা-হা করা কাদামাখা নদীতীর।

একে ওকে জিজ্ঞেস করলাম। একজন বলল, বছরখানেক হল অবোধ এ গ্রাম থেকে উঠে গেছে নৌকা বেচে দিয়ে। কোথায় গেছে সে, কেউ বলতে পারল না।

এই সিরিজের সব লেখা একত্রে

dhula matir baul
Advertisment