৬
দুদিন সময় বেশি চেয়েছিল রায়না। আশ্চর্যের বিষয় হল, তারপরেও সে আজ বেশি সময় নেয়নি। বরং অন্যদিনের থেকে কমই নিয়েছে। তবে আজ যেন কাজে বেশি ডুব দিয়েছিল। এমনিতেই মেয়েটি চুপচাপ। হৈমন্তীও বাড়তি কথা পছন্দ করে না। বাইরের কারও সঙ্গে তো একবারেই নয়। ফলে দু–একটা হুঁ হাঁ ছাড়া কোনোদিনই তেমন কথা হয় না। আজ যেন আরও তাও হল না। হৈমন্তীও বইতে মন দিয়েছিল। রোজই সে বই নিয়ে বসে। আজকের বইটা ভয়ংকর, তাই খুবই ইন্টারেস্টিং ছিল।
বইয়ের বিষয় ছুরি। নাম নাইভস্ টু থাউজেন্ড নাইনটিন। লেখকের নাম জো কারজম্যান। তিনি একজন ছুরি বিশেষজ্ঞ। ছুরি নিয়ে বিস্তারিত চর্চা রয়েছে। সেই কারণেই বই লেখেন। বইটি গোটা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়। কয়েক লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। নতুন ছুরির ফলার মতোই ঝকঝকে। নানা ধরনের ছুরির বর্ণনায় ভরা। ছুরির ইতিহাস, ছুরির গুণাগুণ, বিশ্ববিখ্যাত ছুরি প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী সংস্থার নাম, ঠিকানা রয়েছে। সঙ্গে পাতায় পাতায় ছবি। ছুরি শুধু ভয়ংকর নয়, সে যে সুন্দরও এই বইটি না দেখলে হৈমন্তীর জানা হত না। যত পড়ছে, দেখেছে অবাক হচ্ছে। প্রাচীন থেকে একেবারে আধুনিকতম ছুরির ছবি দেখে হৈমন্তী মুগ্ধ। কত নতুন ধরনের ছুরিই না এখন তৈরি হয়! এটা একটাও শিল্প। গুণী শিল্পীরা কাজ করছেন। কোথাও ছুরিতে ব্লেডের অংশ চওড়া, কোথাও সামান্য। ফ্লিপার, ড্যাগার, সুসি, ফাইটার, টানটোজ, ফোল্ডিং স, পকেট নাইফ। হাতলে বিভিন্ন কারুকাজ। ভাঁজ করবার নানা কায়দা। গত তিনদিন ধরে এই বইটি নিয়ে হৈমন্তী পড়ে রয়েছে।
এই বইয়ের খোঁজ হৈমন্তী পায় ওয়েবসাইটে। অনলাইনে বইটা অর্ডার করে। তবে মুম্বাইতে নিজের ঠিকানায় নয়। অর্ডার করে কলকাতার এক ঠিকানায়। ঠিকানাটি যার তাকে ফোন করে।
‘তোমার অফিসের ঠিকানায় একটা প্যাকেট যাবে। ওটা আমার। তুমি যখন মুম্বাইতে আসবে নিয়ে আসবে।’
‘আমার অফিসে কেন পাঠালে?’
হৈমন্তী বলল, ‘বাড়িতে পাঠালে ঠিক হত?’
‘তা বলিনি, প্যাকেটে কী আছে?’
হৈমন্তী সামান্য চুপ করে থেকে বলে, ‘বোমা।’
‘ঠাট্টা কোর না হৈমন্তী।’
হৈমন্তী নিচু গলায় বলল, ‘ঘাবড়াবার মতো কিছু হয়নি, একটা বই রয়েছে।’
‘ও। কী বই?’
হৈমন্তী বলল, ‘তোমার জানার দরকার নেই। প্যাকেট খুলবে না। তুমি কবে আসছো? অনেকদিন আসোনি।’
‘কোথায় আসোনি ? প্রতি মাসেই তো যাই। এই মাসে যাচ্ছি না। নেকস্ট মান্থে যাব।’
‘বইটা নিয়ে আসবে।’
‘কীসের বই বললে না তো।’
হৈমন্তী আবার একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘খুনের। হাউ টু মার্ডার। হয়েছে?’
‘পাগলের মতো কী বলছো হৈমন্তী!’
হৈমন্তী বলল, ‘পাগলের মতো বলার কী হয়েছে? কীভাবে খুন করতে হয় জানতে পারি না?’
এরপর হৈমন্তী ফোন কেটে দিয়ে নিজের মনেই হেসেছিল।
খানিক আগে রায়না যখন বলল, ‘ম্যাডাম, আমার কাজ শেষ আপনি উঠতে পারেন।’ হৈমন্তী অবাক হয়েছিল। চাপা উত্তেজনায় তার শরীর শিরশির্ করে ওঠে। সে ডিভান থেকে নেমে এগিয়ে যায়। চেয়ারে রাখা রোবটা পরে ধীরে ধীরে। আসলে সে সময় নেয়। ছবিটা দেখার জন্য মনের মধ্যে যে ব্যাকুল কৌতূহল ধরে রেখেছে, আজ তার অবসান হবে। এতগুলো সিটিং দিয়েছে, তারপরেও সে জানে না ছবিটা কেমন হচ্ছে। আজ প্রথম দেখবে। কাজ শেষ হওয়ার পর। প্রতিবার কাজ করে ইজেল যেমন ভাবে ঢাকা দিয়ে রায়না চলে গেছে, তেমনই থেকেছে। যে মেয়েটি ফ্ল্যাট ঝাড়পোঁছ করে, হৈমন্তী তাকে কখনও একা এঘরে ঢুকতে দেয়নি। গেস্টদেরও এ ঘরে প্রবেশের অনুমতি নেই। স্টাডি লক করা থাকে। নামে স্টাডি হলেও এই ছোটো ঘরটাকে হৈমন্তী বলে, ‘একার ঘর।’ এখানে লেখাপড়া, অফিসের কাজ করে, গান শোনে। কখনও মন খারাপ হলে একা বসে থাকে চুপ করে।
রায়না প্রথমদিন কাজ হয়ে গেলে বলেছিল, ‘ম্যাডাম, আপনি কি ছবিটা দেখবেন? যদিও আজ কিছুই হয়নি। শুধু পেনসিলে ড্রইং করেছি। শরীরের এক আদল। আপনাকে চেনা যাবে না।’
হৈমন্তী বলল, ‘তুমি কী চাও?’
রায়না দ্বিধা নিয়ে বলেছিল, ‘কাজ কমপ্লিট হওয়ার আগে আমি ছাড়া কেউ কাজটা দেখুক আমি চাই না।’
হৈমন্তী বলেছিল, ‘যদি কাজ পছন্দ না হয়?’
রায়না বলল, ‘এইটুকু রিস্ক তো থাকবে। সব কিছু সবাইকে পছন্দ হতে হবে তার কোনো মানে নেই। যে কোনো আর্টই একজন আর্টিস্টের হয়। তার কেমন লাগছে সেটাই আসল। তবে আপনার বিষয়ে আলাদা। আপনি পেমেন্ট করে নিজের ছবি করাচ্ছেন।’
হৈমন্তী বলল, ‘শেষে ভাল না লাগলে তো শুধরোনোর উপায় থাকবে না।’
‘না, থাকবে না।’
হৈমন্তী হেসে বলেছিল, ‘তখন কি আমি সারাজীবন একটা ভুল আমিকে বয়ে বেড়াব?’
রায়না একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ম্যাডাম, কিছু কিছু সময় তো তাই করতে হয়। নিজের ভুলকে বয়ে বেড়াতে হয়। হয় না? আর তা না চাইলে স্টোররুমে ফেলে রাখবেন। সেও একরকম ক্যারি করা।’
হৈমন্তী ছোটো একটা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হল।
‘আচ্ছা, ছবি পছন্দ না হলে কি পেমেন্ট ফেরত ?’
রায়না সামান্য হেসে বলল, ‘না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আপনি আমাকে ডেকেছেন। সুতরাং পরীক্ষা দেওয়া আমার হয়ে গেছে। এবার আপনার পরীক্ষা, আমি আপনার কারেক্ট চয়েস কিনা সেই পরীক্ষা দেবেন। তাই আমার পারিশ্রমিক ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।’
হৈমন্তী খুব খুশি হল। বলল, ‘ঠিক আছে তুমি কাজ করো। আমি ছবি দেখব একেবারে ফিনিশ হওয়ার পর।’
এখন সেই ছবি দেখা হল। রায়নাকে কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে তো এতো সুন্দর নয়। মেয়েটা ছবিতে কিছু একটা ম্যাজিক করেছে। সেই কারণে তাকে এমন মারাত্মক লাগছে। রায়না কি ম্যাজিক করেছে?
হৈমন্তী মুখে তুলে অস্ফুটে বলল, ‘রায়না এসো, কাছে এসো। তোমাকে একটু আদর করি। ইউ আর গ্রেট।’
রায়না লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ। ম্যাডাম, আমি কি একটা অনুরোধ করতে পারি?’
‘বল।’
রায়না দ্বিধা জড়ানো গলায় বলল, ‘আমি কি একজন আমার এই কাজটা দেখাতে পারি। সে আমার ভীষণ বন্ধু। একই সঙ্গে কাজ শিখেছি। হি ইজ আ স্কালপটার। আর কাউকে নয়, শুধু একজনকে।’
হৈমন্তী হালকা হেসে বলল, ‘নাম কী?’
‘সোহন।’
‘তোমার বয়ফ্রেন্ড?’
রায়না মাথা নেড়ে বলল, ‘আমরা একসঙ্গে থাকি।’
হৈমন্তী বলল, ‘ঠিক আছে। ওকে নিয়ে আসবে। তবে কিছুদিনের জন্য আমি কলকাতায় যাচ্ছি। ফিরে আসি, তারপর।’
--------------------
পড়ুন এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্বগুলি