১০
ছন্দা সাহা আর তার স্বামী বসন্ত সাহার সঙ্গে খুব অদ্ভুত ভাবে আলাপ হয়েছিল মুকুরদের। ঘটনাটা ছিল, একেবারে নাটকের মতো। মজার ব্যাপার হল, ঘটনাটা ঘটেও নাটক দেখতে গিয়ে। নাটকের ভিতর নাটক হয়। থিয়েটার উইদিন থিয়েটার। এটা শিল্পের একটা ফর্ম। কিন্তু এটা ছিল নাটকের বাইরে নাটক।
দু’বছর বছর আগের ঘটনা।
অকাদেমিতে নাটক দেখতে গিয়েছিল মুকুর আর সুনন্দ। বাদল সরকারের লেখা দুটো নাটক। ‘সারারাত্তির’ আর ‘সলিউশন এক্স’। দলের নাম ‘ভাঙা মঞ্চ’। এই গ্রুপ থিয়েটার সেই সময় বেশ নাম করেছিল। কাগজের ছোটো বিঞ্জাপন দেখে মুকুর ঠিক করল যাবে। কলেজ জীবনে মুকুর নাটক দেখত। বন্ধুরা ছিল সিনেমার পোকা, মুকুরের নেশা ছিল নাটকে। নাটকের জন্য সঙ্গী পাওয়া যেত কম। তারপরেও এক আধজন জুটে যেত। কোনোদিন অত্রিনা, কোনোদিন আফরিন। কেউ না থাকলে একাই যেত। অকাদেমি, শিশির মঞ্চ, রবীন্দ্রসদন তো ছিলই, গিরিশ, মিনার্ভাতেও যেত। দূরে বলে মধুসূদন মঞ্চে যেতে একটু অসুবিধে হতো। বাড়িতে রাগ করত। তবে মেয়ের নাটক দেখার নেশায় বাবার মদত ছিল। এই নাটক দেখতে গিয়ে টুকটাক অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। যেমন মধুসা আর কিশোর। ওরা পরে বিয়েও করে। এবারের পার্টিতে নেমন্তন্নও পেয়েছে। কলেজ ইউনিভার্সিটি শেষ করবার পর নাটকের নেশা দূর হল মুকুরের। শ্বশুরবাড়ি বাড়ির বউয়ের বাইরে বেরোনো পছন্দ করত না। কতবার যে চাকরি ছাড়তে বলেছে। নাটক দেখা তো দূরের কথা। দমদমে আলাদা ফ্ল্যাটে চলে যাওয়ার পর আবার একটু আধটু হয়েছিল। তবে আর একা যাওয়া পোষায় না। সুনন্দও সময়ও পায় না। তার নিজেরও তো স্কুলের খাতা দেখা, প্রশ্ন করা থাকে।
যাই হোক সেবার বাদল সরকার বলেই ইচ্ছে হল মুকুরের। কলেজের পর বাদল সরকারের নাটক আর দেখা হয়নি। সুনন্দও রাজি হল। তখনও থিয়েটারে অনলাইনে টিকিট সেভাবে চালু হয়নি। হলে গিয়ে লাইন দিয়ে কাটতে হল। মোটামুটি ভালই জায়গা পেয়েছিল। ‘সলিউশন এক্স’ নাটকটা তো দারুণ হল। ওরকম মজার নাটক খুব কমই হয়। ইন্টারভ্যালের পর শুরু হল, ‘সারারাত্তির’। মুকুর নড়েচড়ে বসল। সিরিয়াস নাটক। নাটকটা দেখেনি আগে। আসবার আগে শ্রাবস্তীকে ফোন করেছিল। সিধু জেঠী। ও খানিকটা বলেছে। সত্যি মেয়েটা এসব জানেও বটে! বলেছিল সারারাত্তির একটা অ্যাবসার্ড নাটক।
‘অ্যাবসার্ড নাটক! সে আবার কী?’
শ্রাবস্তী বলেছিল, ‘এই ধরনের নাটকের সূত্রপাত প্যারিসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই স্টাইলকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। এখানে চরিত্রগুলো ইচ্ছে করে অবাস্তব, দুর্লভ করে তৈরি করা হয়। দেখতে দেখতে তাদের কখনো মনে হবে চিনি, কখনো মনে হবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তারা যে সংলাপ বলবে বেশিরভাগের কোনো অর্থ নেই। পারস্পরিক মিল নেই। ঘটনায় কার্যকারণ খুঁজে পাবে না, এমনকী শুরু শেষের যেন বালাই নেই। অথচ দেখতে মজা লাগবে। একধরনের সেন্স তোমাকে প্রিক করবে। খোঁচা দেবে। অনেকক্ষণ তুমি ভাববে মুকুরদি। প্রতিটা ভাবনাই হবে আলাদা আলাদা।’
মুকুর বলেছিল, ‘বাপ্রে এ তো বিরাট ইনটেলেচ্যুয়াল।’
শ্রাবস্তী হেসে বলল, ‘বাদল সরকারের সারারাত্তির দেখতে গেলে কিঞ্চিৎ মাথা তো লাগবেই।’
নাটক জমে উঠেছিল। হল চুপ। যাকে বলে, পিন ড্রপ সাইলেন্স। হঠাৎ ঘটল অঘটন। মিনিট কুড়ি পর এক মহিলা সিটে বসে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।
‘আমার গলার হার...আমার গলার হার কোথায় গেল... কোথায় গেল আমার হার?’
মহিলা চার নম্বর সারিতে বসেছিলেন। তিনি হাত ছুঁড়ে এমন হট্টগোল শুরু করে দিলেন যে নাটক থমকে গেল। মহিলার চিৎকার থামল না।
‘হার আমার গলা ছিল...কে নিল? নিল কে?’
হলে ভিড়। বাদল সরকারের লেখা নাটক এতদিন পর মঞ্চে হচ্ছে, ভিড় তো হবেই। অনেকেই মহিলার ওপর রেগে গিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন।
‘চুপ করুন দিদি। আপনার হার গোল্লায় যাক।’
‘বাড়িতে গিয়ে খুঁজবেন।’
‘থানায় যান।’
‘নিজের গলায় ভাল করে দেখুন। পরে নেই তো?’
‘হার পরে থিয়েটার দেখতে এসেছেন কেন? এটা নেমন্তন্ন বাড়ি না থিয়েটার হল?’
খেপে ওঠা মহিলা কোন কথায় কান দিলেন না। তিনি প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলে যেতে লাগলেন, ‘আমার সোনার হার...লাখ টাকার ওপর দাম...।’
পরিচালক স্টেজের সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাত তুলে বললেন, ‘দিদি, নাটকটা শেষ হতে দিন। তারপর খুঁজে দেখা যাবে।’
মহিলা চিৎকার করে বললেন, ‘নাটক শেষ হতে দিন মানে! লাখ টাকার হার আপনার শো’য়ের মধ্যে চুরি হয়ে যাবে, আর আপনি বলছেন নাটক শেষ হতে দিন! এতো মনে হচ্ছে, আপনাদের সাপোর্ট রয়েছে...।’
এই কথায় বিরাট হট্টগোল শুরু হল। এবার হলের লোক আলো জ্বালাতে বাধ্য হয়। সবাই মহিলাকে দেখতেও পেল। উনি চেয়ারে বসে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন। পাশে সম্ভবত স্বামী। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
‘তখনই বললাম, এতো দামী জিনিস পরে বাইরে যেও না। একটু আগে বললাম খুলে ব্যাগে পুরে রাখো। রাখলে তো... তারপর কী হল!’
মহিলা মুখ তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘খুলে রাখতে গিয়েও তো...একটু আগেও ছিল। ইন্টারভ্যালের সময়... আমার মনে হয়, গলায় কেউ টান দিয়েছে। সবাইকে সার্চ করতে হবে।’
সবথেকে বিশ্রী অবস্থায় পড়ল মুকুর আর সুনন্দ। তারা ওই মহিলার ঠিক পিছনের সিটে বসেছিল। যেভাবে মহিলা ‘গলায় কেউ টান দিয়েছে’ বলছে, তাতে তো তাদের দিকেও ইঙ্গিত করা হয়। এ তো আচ্ছা বিপদ! সব মিলিয়ে হলের ভিতর একটা বড় ধরনের কেওস বেঁধে গেল। এমন সময় একেবারে প্রথম সারি বসা একজন লম্বা চওড়া, সুদর্শন পুরুষ উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে স্টেজে উঠে পড়লেন। সেখানে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে নাটকের পরিচালক এবং বাকিদের সঙ্গে কী যেন কথা বললেন। তারা মাথা নাড়ল। এবার ভদ্রলোক স্টেজের সামনে এসে উঁচু গলায় বলতে শুরু করলেন। স্টেজের নিচে রাখা ক্যাচারে ধরা পড়ে তার গলা গমগম করে উঠল।
‘আপনারা শান্ত হোন। প্লিজ শান্ত হোন, আমার কথা মন দিয়ে শুনুন। আমার নাম বসন্ত সাহা। আমি একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার। গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করি। এই দেখুন আমার আইডেনটিটি কার্ড। আমি হল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি, পুলিশ না আসা পর্যন্ত আপনারা বেরোনার গেটগুলো বন্ধ রাখুন। আমি খবর দিচ্ছি পুলিশ এখুনি চলে আসবে।’
কয়েকজন দর্শক তেড়েফুঁড়ে উঠে বলল, ‘আমাদের কি সার্চ করা হবে? এই অপমানের মানে কী!’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘কী করব বলুন, এত টাকা দামের হার বলে কথা। তবে চিন্তা করবেন কাউকে অপমান করা হবে না।’
একদল বলে উঠল, ‘তবে?’
অফিসার ভদ্রলোকের পার্সোনালিটি দেখবার মতো। গোটা হলটা নিমেষে যেন গ্রিপে নিয়ে নিলেন।
বসন্ত সাহা বললেন, ‘হারটা খুঁজে বের করা হবে। আমিই নিজেই পারতাম, কিন্তু একজন লেডি পুলিশ ছাড়া তো সম্ভব নয়। আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী রয়েছেন, কিন্তু তিনি তো পুলিশ নন।’
এবার সেই মহিলা বললেন, ‘ততক্ষণে হার পাচার হয়ে যাবে।’
অফিসার ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি শেষ কখন হারটা দেখেছিলেন?’
মহিলা নিজের সিটে বসেই বললেন, ‘এই তো বললাম, ইন্টারভ্যালের আগে। হারটা খুললাম, ভাবলাম ব্যাগে রাখি। ও এত বার বলছিল... হারটা আমি খুলে রাখলামও। ইন্টারভ্যালের সময় আবার মনে হল, থাক পরেই থাকি। লোকে দেখুক। নাটক তো শেষ হয়ে যাবে। বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ব। ইস্ কী হবে এবার! আমি ভাবতেও পারিনা এমন ভদ্রলোকের জায়গায়...।’
অফিসার বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনি শান্ত হয়ে থাকুন।’
মহিলা এবার তেড়েফুঁড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমি শান্ত হয়ে থাকব মানে! আমার হার ছিনতাই হবে আর আমিচুপ করে থাকব? আপনি তো মনে হচ্ছে চোরেদের সমর্থন করছেন!’
বসন্ত সাহা এবার হেসে বললেন, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার হার কোথায় রয়েছে আমি জেনে ফেলেছি। মনে হয়, আমার অনুমান ঠিক হবে। একটু অপেক্ষা করুন। একজন লেডি অফিসারকে আসতে দিন।’
হল ভর্তি দর্শক যেন থিয়েটার দেখতে এসে ম্যাজিক দেখছে। লোকটা বলে কী! অতদূর থেকে বলছে হার কোথায় জেনে গেছে!
——————
প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত (পর্ব ১০)
প্রতি সপ্তাহের শনি ও রবিবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত হচ্ছে প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস। সব পর্বের সঙ্গেই পাওয়া যাবে এই উপন্যাসের সব কটি পর্বের লিংক, একত্রে। পড়ুন ও পড়ান।
New Update
Advertisment