Advertisment

প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত (পর্ব ১১)

'ম্যাডাম আপনি যদি ইচ্ছে করেন, স্টেজ পর্যন্ত আসতে পারেন। আমরা কোনো জোর করব না। শুধু বলব, হলের সব লাইট ভাল করে জ্বালিয়ে দিতে।'

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito part 2

অলংকরণ- অরিত্র দে

১১

Advertisment

মহিলা বললেন, ‘‌আপনি জানেন!‌ কোথায় আছে?‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌জানি বলছি না, অনুমান করছি।’‌
এবার আর মুকু্র পারল না। সে উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘‌কী অনুমান করছেন?‌ আমরা কেউ পিছন থেকে টেনে নিয়েছি?’‌
পাশে বসা সুনন্দ স্ত্রীর হাত ধরে টান দেয়। মুকুর বসে না। অফিসার ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, ‘‌আমি সে কথা তো বলিনি। তবে কোনো সম্ভবনাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পুলিশ যখন ডিটেকশনে যাবে তখন সবকটা দিকই বিচার করবে। বাধ্য হয়েই করবে।’‌
সুনন্দ আর পারে না। এবার সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?‌ থিয়েটার হলে ছিনতাইবাজ ঢুকেছে? ভুলে যাবেন না আমরা বাদল সরকারের নাটক দেখতে এসেছি। বাসে ট্রামে উঠিনি।‌’
অফিসার ভদ্রলোকে বললেন, ‘‌জানি আপানার নাটক দেখতে এসেছেন। আমিও তো এসেছি। তবে এখানে ক্রাইম হবে না এমনটা ভাবছেন কেন?‌ থিয়েটারে ক্রাইম হতে পারলে হলেও ক্রাইম হতে পারে। থিয়েটার হলে মার্ডারের মত ঘটনাও ঘটেছে। পৃথিবীতে সেরকম উদাহরণও রয়েছে।’‌ একটু থেমে ভদ্রলোক আবার বলতে থাকেন, ‘‌এখানেও হতে পারে। নাটকের নাম সারারাত্তির। ক্রাইম তো হতে পারে না?‌ তবে  সত্যি বলতে কী এটাও একটা প্রশ্ন। নাটকে দেখতে এসে ছিনতাই!‌’‌
একজন দর্শক পিছন থেকে চিৎকার করে বলল, ‘‌লেকচার থামান। আপনার লেকচার শুনতে আসিনি।’‌
হার হারিয়ে ফেলা মহিলার থেকে যারা দূরে বা সামনের সিটে বসেছিলেন তাদের মতো হইচই শুরু হল।
‘‌ভেবেছেনটা কী?‌ আমরা কি ভূত? অন্ধকারে‌ লম্বা হাত বাড়িয়ে গলা থেকে হার ছিনিয়ে নিয়েছি?‌’‌
সুনন্দ ফের উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তবে কি আমরা পিছন থেকে হার টেনে নিয়েছি বলছেন?‌’‌
সামনে থেকে একজনে বললেন, ‘আমরা তো বলিনি। যে বলছে তাকে বলুন। তবে যাদের সাসপেক্ট করবার প্রশ্নই ওঠে না, তাদের এভাবে বেইজ্জতি করবার মানে কী?‌’‌
এবার অনেকেই‌ উঠে দাঁড়িয়ে হইচই শুরু করল। নাটকের দলের একজন এসে হাতজোড় করে বলল, ‘‌দয়া করে আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন। একজন অনারেবল দর্শক গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। তার একটি মূল্যবান অলংকার খোয়া গেছে। এই অবস্থায় আমাদের তো কোনো না কোনো স্টেপ নিতেই হবে। আমরা হল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গেও কথা বলেছি। যদি জিনিসটা খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে কোনো আমরা এফোর্ট না নিই, তাহলে আমাদেরও রেসপনসিবিলিটি থেকে যায়। উই আর লাকি এনাফ, আজ আমাদের নাটক দেখতে এসেছেন বসন্ত সাহার মতো একজন বড় পুলিশ অফিসার।  তিনি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে রয়েছেন। তিনি যিনি নিজেই এগিয়ে এসেছেন। এই মিস্ট্রি সলভ করতে চান। আপনারা তাকে কো অপারেট করবেন এটাই আশা করি.‌.‌.‌।’‌
হার হারানো মহিলা বললেন, ‘‌এসব বাজে কথা রাখুন। হার কোথায় বলুন।’
হৈচৈ আরও বাড়ল। আবার অনেকে চেঁচামেচি শুরু করল। পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে নানা কথা বলতে লাগল।
‘‌আপনি এই ভাবে আমাদের আটকে রাখতে পারেন না। ’‌
‘‌আপনি ভেবেছেনটা কী?‌ এটা একটা থিয়েটার হল। কোনো অন্ধকার গলি নয়।’‌
‘আপনি ভদ্রলোকদের অপমান করছেন।’‌
‘‌সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া, আপনি কাউকে সার্চ করতে পারবেন না।’‌‌
অফিসার হাত দু’‌হাত তুলে বললেন, ‘আপনারা খামোখা উত্তেজিত হচ্ছেন।‌ আমি কি সার্চের কথা বলেছি! বলেছি পুলিশ আসতে দিন। যেহেতু এখানে অনেক মহিলা রয়েছেন, লেডি পুলিশও প্রয়োজন। এক্ষুনি খবর পেয়েছি  ফোর্স এসে গেছে।’‌
এতে উত্তজনা কমল না বরং বাড়ল। স্টেজে পুলিশ অফিসার, নাটকের দলের লোকজন নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করলেন। তারপর অফিসার ভদ্রলোক একটি সামনে এগিয়ে এলেন।
‘‌আপনাদের দাবি অনুযায়ী আমি একবার চেষ্টা করছি। জানি না পারব কিনা। শুধু ওই ভদ্রমহিলার কথা শুনে অনুমানের ওপর ডিটেকশন করতে হচ্ছে। মিলতে নাও পারে। তবে আমি শুধু ম্যাডামকেই বলে দিচ্ছি, হারটা কোথায়?‌ কে নিয়েছে?‌ আপনি কি একবার এখানে আসবেন?‌’‌
দর্শকরা হইহই করে উঠল, ‘‌আমরা জানব। আমাদেরও জানাবার অধিকার রয়েছে। আমরা এতক্ষণ হ্যারাসড হয়েছি।’‌
এত উত্তেজনার মধ্যেও পুলিশ অফিসার হেসে, ঠান্ডা গলায় কথা বলছেন। বোঝা যাচ্ছে তিনি উত্তেজনা কমাতে চাইছেন এবং সময় নিচ্ছেন।
অফিসার বললেন, ‘তবে সবটাই অনুমান নয়। অনুমানের একটা ভিত্তিও রয়েছে। ‌আসলে আমার কাছে একটা প্রিসিডেন্স রয়েছে। দু’‌মাস আগে ঠিক এই ভাবে একটা কানের দুলের কেস সলভ করেছি। ঘটনাটা ঘটেছিল সিনেমাহলে। সেখানও এরকম ভাবে একজন মহিলা.‌.‌.‌ম্যাডাম আপনি যদি ইচ্ছে করেন, স্টেজ পর্যন্ত আসতে পারেন। আমরা কোনো জোর করব না। শুধু বলব, হলের সব লাইট ভাল করে জ্বালিয়ে দিতে।’‌
এতক্ষণ পরে মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। নিজের আসন ছেড়ে বেরিয়ে, এগিয়ে এলেন।
বেশি নয়, কয়েক পা হেঁটে  যেতেই মহিলা লাফিয়ে উঠলেন।
‘‌এই তো হার। এই তো মাটিতে পড়ল। আমার কোলের ওপর ছিল।’
হল শুদ্ধ সবাই ‘‌রে রে’‌ করে উঠল।‌ সকলেই উঠে দাঁড়াল। হারটা দেখতে চাইছে। মহিলা নিচু হয়ে হার কুড়িয়ে নিলেন। এক হাত জিভ বের করে বললেন,‘‌ছিছি।’
অফিসার ভদ্রলোক স্টেজ থেকে বললেন, ‘‌ম্যাডাম, ল‌জ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এরকম ভুল সকলেরই হয়। আপনি একবার হারটা যদি তুলে দেখান, সবাই নিশ্চিন্ত হতে পারি।’‌
মহিলা মুহূর্তখানেক থমকে দাঁড়িয়ে ফের স্টেজের দিকে হেঁটে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠেও পড়লেন ওপরে। হাত জোড় করে বললেন, ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী। বারবার হারটা খোলা পরা করতে হয়, হুক্‌ আলগা হয়ে পড়ে যায়। আমার জন্য আপনাদের নাটক দেখায় বিঘ্ন ঘটেছে। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ মনে আঘাতও পেয়েছেন। আমার গলা থেকে কেউ হার টেনে খুলে নিয়ে গেছে কথাটা বলাটা আমার অন্যায় হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করবেন।’‌
পুলিস অফিসার এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনি দুঃখ প্রকাশ করলেন এটাই যথেষ্ট। অত দামি একটা জিনিস হারিয়ে গেলে কারোর মাথার ঠিক থাকে না।‌ বিশেষ করে মহিলারা যদি গয়নাগাঁটি হারিয়ে ফেলেন.‌.‌.‌যাক হারটা যে পাওয়া গেছে, এটাই যথেষ্ট। আমরা সবাই খুশি। ফোর্সও পৌছে গেছে, তাদের ফেরত পাঠাই। আসুন সবাই আবার নাটক দেখতে বসে যাই।’‌
থিয়েটার শেষ হলে একরকম ছুটে গিয়ে বসন্ত সাহাকে ধরেছিল মুকুর আর সুনন্দ। নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলে, ‘আপনি ‌আমাদের বিরাট এম্‌ব্যারাস্‌মেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আমরাই সন্দেহের তালিকার প্রথমে ছিলাম। যতই মিথ্যে হোক, খুবই লজ্জার একটা পরিস্থিতি.‌.‌.‌ আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব.‌.‌.‌।’‌
বসন্ত সাহার সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ছন্দাও ছিলেন। বসন্ত সাহা ‌হেসে বললেন,‘‌খেপেছেন?‌ এখানে সব মানিগন্যিরা আসেন, এখানে কাউকে হ্যারাস করলে চাকরি থাকবে ?’‌
সুনন্দ বলেন, ‘‌আমরা যদি আপনাদের একটু কফি খাওয়াই আপনারা কি না বলবেন! জানি না বড় পুলিস অফিসাররা অচেনা বা সদ্য পরিচিত কারও কফির নেমন্তন্ন রাখেন কিনা।’‌
বসন্ত সাহা হেসে বলেছিলেন, ‘‌না রাখি না। কফির নেমন্তন্ন রাখি না, তবে চায়ের নেমন্তন্ন রাখি। চা খাওয়াবেন? সাধারণের নেমন্তন্ন না নিই, প্রাইম সাসপেক্টের নেমন্তন্ন তো নিতেই হবে। চল ছন্দা।’
মাটির ভাঁড়ে চা খেতে খেতে চারজনে মিলে কথা হল।‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌আসলে কী জানেন, হার ছিনতাইয়ের সম্ভবনাটা আমি প্রথমেই বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম। পিছনে বসে গলা থেকে কেউ হার টেনে নেবে এটা হতে পারে একমাত্র চলন্ত বাসে‌–‌ট্রামে। হার ছিনতাই করে কেউ পিছন বসে থাকবে না। এক হতে পারে খুব প্রফেশনাল কেউ। হারটাকে নিয়ে হাতসাফাই করে সিটের নিচে কোথাও যদি লুকিয়ে ফেলে। এর জন্য দুঃসাহস চাই। ধরা পড়বার চান্স একশো ভাগের মধ্যে একশো ভাগ।‌ তার মানে সেই লোককে জানতে হবে, কে হার পরে ঢুকছে, তার পিছনে টিকিট কেটে বসতে হবে, ধরে নিতে তার পাশে বসা কেউ ঘটনা দেখবে না। এটা খুবই কষ্টকল্পিত। আমাদের অপরাধ বিজ্ঞানে বলে ইমপসিবল ক্রাইম। এরপর মহিলা বারবার হার খোলা এবং পরবার কথা বলতে সবটা ক্লিয়ার হয়ে গেল। নিশ্চয় হুক আলগা হয়ে পড়ছে। কিছুদিন আগে আমার ম্যাডামও এই কীর্তি করেছিলেন। সিনেমা হলে কালের দুল নিয়ে কিছু একটা কেরামতি করতে গিয়ে জিনিসটা ফেলে দিয়েছিলেন। সিনেমা শেষ হলে সিটের কোনায় খুঁজে পাই।’‌
পাশে দাঁড়ানো ছন্দা সাহা বলে, ‘‌কেরামতি বলছো কেন?‌ কানে বিঁধছিল।’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌আহা রাগ করছো কেন। সেদিন ঘটনাটা ঘটেছিল বলেই তো আজকের অনুমানটা মিলে গেল। তবে লেডি পুলিশ ছাড়া তো ওঁর কাছে পৌঁছোনো যেত না। তাই সময় নিচ্ছিলাম।’
এরপরে খুব দ্রুত মুকুরদের সঙ্গে বসন্ত সাহাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা জমে উঠল। সুনন্দ অবশ্য এড়িয়ে চলে। বলে, ‘‌পুলিশের সঙ্গে বেশি গা ঘেঁষাঘেঁষি না থাকাই ভাল।’‌
——————

 অনাবৃত-র সব পর্ব একসঙ্গে, এখানে
Anabrito
Advertisment