১২
সুনন্দ এড়িয়ে চললেও মুকুর ছন্দার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। ছন্দাও রাখে। দুজনে টিচার বলে গল্প করবার কিছু কমন বিষয় থাকে। কলিগরা কে কেমন পড়ায়, কে কেমন ফাঁকি দেয়, স্কুলের ম্যানেজমেন্টকে কীভাবে সামালাতে হয়, সিলেবাসের চাপ —এইসব।
এছাড়া দুজনের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামও রয়েছে। ছন্দা রান্নার রেসিপি বলে, মুকুর গানের ইনফো জানায়।
যেমন এই তো সেদিন ইলিশ মাছের বিরিয়ানির একটা অন্যরকম রেসিপি বলল ছন্দা। মুকুর রান্না তেমন জানে না, এটা তো একেবারেই জানত না। ছন্দা টেলিফোনে বলেছে, মুকুর ওর সিক্রেট ডায়েরিতে নোট রেখেছে।
‘বাসমতী চালটাকে জলে ভিজিয়ে রাখবে। এই ধরো মিনিট আধঘন্টা–পঁয়ত্রিশ মিনিট। কেউ কেউ কুড়ি বাইশ ভিজিয়ে তুলে নেয়, এটা ঠিক করে না। এবার যে ভাতটা করছ তাতে এক চামচ মতো নুন ফেলবে। ছোটো এলাচ ফেলবে চারটে। বেশিও নয়, কমও নয়। ও বলতে ভুলে গিয়েছি, এই মাপটা তোমার আড়াইশো গ্রাম চালের জন্য। এবার পরিমাণ যেমন বাড়বে, সেই মত বাকি সব বাড়াবে। আমি ধরেই নিচ্ছি, তুমি আর সুনন্দ খাচ্ছো। সেরকম ধরেই এগোচ্ছি। মনে রাখবে ভাতের কোয়ালিটি এখানে খুব ইমপর্টান্ট। একটু শক্ত থাকতে থাকতেই জল ঝরিয়ে নেবে। এর মধ্যে দু’টুকরো মাছ ভাপিয়ে রেডি করে রেখেছো। ভাপানোটা যেন হালকা হয়। তারপর...।’
ঠিক তেমন ভাবে গানের তথ্য সাপ্লাই করে মুকুর। ছন্দাদের স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে ছোটো একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছিল ছন্দা। তিনটে গানের তথ্য তাল্লাশ করে দিয়েছিল মুকুর।
‘কোথা বাইরে দূরে যায়রে গানটার স্বরলিপি করেছিলেন অনাদিকুমার দস্তিদার। বয়স পঞ্চাশ বছর হওয়ার একটু আগেই গানটা লেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই ধর, আটচল্লিশ বা উনপঞ্চাশ হবে। রাজা নাটকের গান। খাম্বাজ রাগে...। পরের গানটা কী যেন বলেছিলে? দাঁড়াও খাতাটা দেখে নিই। হ্যাঁ, এই তো কতবার ভেবেছিনু আপন ভুলিয়া। এই গানের সুরটা ইংরেজি গান ড্রিঙ্ক টু মি ওনলি থেকে ফলো করা। বলা হয় পাশ্চাত্যের ভাঙা সুর।’
ছন্দা বলে, ‘বাবা, তুমি কত জানো !’
মুকুর বলে, ‘খেপেছো। সব সাপ্লায়েড বাই মাই কলিগ। ও আমার গানের সিধু জেঠিমা।’
বসন্ত সাহাও মেয়েটিকে পছন্দ করে। হাসিখুশি। ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কথা বলে না। পুলিশে কাজ করে অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সমস্যা। কিছু না কিছু করে দিতে বলে। সে পকেটমারি থেকে দোকানে জিনিস খারাপ দিলেও ফোন করবে। ডাক্তারদের এই সমস্যা। বসন্ত সাহার ডাক্তার বন্ধুরা বলে, ‘তুমি তো তাও চুরি ডাকাতির কমপ্লেন নিয়ে থাকো, আমাদের তো চোঁয়া ঢেঁকুর উঠলেও ফোন করে। মোবাইলে ট্রিটমেন্ট করতে করতে পাগল হয়ে যাই। বিয়েবাড়িতে গিয়েও রক্ষে নেই। বলে, ডাক্তারবাবু লিভারটা একটু দেখে দিন তো। বোঝো কাণ্ড।’ মুকুরের এসব ঝামেলা নেই। বরং একদিন ছন্দা বলল, ‘জানো, মুকুরদের স্কুলে বড় চুরি হয়ে গেছে। রাতে জানলা ভেঙে টাকা পয়সা তো নিয়েছেই, দরাকরি কাগজপত্রও গেছে।’
বসন্ত বললেন, ‘কই আমাকে তো কিছু বলেনি!’
ছন্দা বলল, ‘তোমাকে বলবে? খেপেছো? উলটে আমাকে বলল, দাদাকে এসব বলতে যেও না। ছোটোখাটো ব্যাপারে ওনাকে ব্যস্ত করবার কোনো মানে হয় না।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘বাঃ, খুব কম লোকেই এটা বোঝে।’
বাইরে পার্টি করবার প্রস্তাব শুনে ছন্দা বারণ করল।
‘এটা কী বলছো মুকুর! এই পার্টি কখনও বাইরে হতে পারে? অসম্ভব। তোমার ফ্ল্যাটেই হবে।’
মুকুর বলল, ‘ছন্দাদি, আমি ভাবছিলাম, ওইটুকু ফ্ল্যাটে অতজনের অসুবিধে হবে না তো?’
ছন্দাদি বলল, ‘হলে হবে। তাছাড়া তোমাদের ফ্ল্যাটটা মোটেও ছোটো নয়। আর অতজনই বা কোথায়? তুমিই তো বললে অল্প কয়েকজনকে বলেছো। তোমার স্কুলের কেউ আসছে?’
মুকুর বলল, ‘সেটা তো গৃহ প্রবেশ, সরি ফ্ল্যাট প্রবেশের সময় হয়ে গেছে। এটা একেবারেই নিজের মধ্যে। যারা কোনো না কোনো ভাবে কনসার্ন, সেদিন আমাদের উৎসাহ দিয়েছিল, মজা করে খেতে চেয়েছিল... অথবা যারা কখনও আসেনি...সুনন্দর অফিসের দু–একজনকে বলতে হয়েছে।’
ছন্দাদি হেসে বলল, ‘আমিই তো খেতে চেয়েছিলাম।’
মুকুর বলল, ‘এবারে একেবারে জনা বারো।’
সুনন্দ অবশ্য এতেও আপত্তি করেছিল।
‘এই ঝামেলা নিতে পারবে?’
মুকুর বলেছিল, ‘ঝামেলার কী আছে? কয়েকজনকে নিয়ে একটু হইচই করা।’
সুনন্দ বলল, ‘বাইরে কোথাও করতে পারও তো। কোনো রেস্টুরেন্টে চলে যাব। বাড়িতে ফ্যাচাং থাকবে না।’
মুকুর বলল, ‘আমিও সেরকম ভেবেছিলাম। ছন্দাদি আপত্তি করল। বলল, না ফ্ল্যাটেই হবে। মজার কথা কী জানো, ছন্দাদি নিজে রান্নাও করতে চেয়েছিল। অত বড় পুলিশ অফিসারের বউ হলে কী হবে, রান্নায় এক্সপার্ট।’
কথাটা ঠিক। ছন্দা সাহা রান্নায় অতি এক্সপার্ট একজন মহিলা। রোজকার রান্নাও যেমন জানে, শখের রান্নাতে ভাল। বড় গোয়েন্দা অফিসার বসন্ত সাহার স্ত্রীকে বাড়িতে রান্না করতে হয় না। কুক রয়েছে। তারপরেও নিজের চাকরি সামলে রোজ একবার রান্না ঘরে ঢোকা চাই। দুপুরে স্বামীর ঘরে পাতা দই খাওয়া অভ্যেস। সেই দই ছন্দা নিজের হাতে পাতে। তবে স্বামীকে বকাবকি করতেও বাদ রাখে না।
‘রোজ রোজ দই খাওয়া কী আছে? আর খেলেও বাড়িতে খাও। অফিসে নিয়ে যাওয়ার কী হয়েছে? এতো বড় অফিসার হয়েছো এখন কি অফিসে গিয়ে রোজ দই খাওয়া সাজে?’
পঁয়তাল্লিশ বছরের বসন্ত সাহা যিনি পুলিশ মহলে বি.সাহা নামে পরিচিত মানুষটি যেমন বুদ্ধিমান তেমন ঠান্ডা মাথার। পেশায় অতি যোগ্য। লম্বা পেটানো চেহারা। সম্প্রতি বিদেশ থেকে বিশেষ একটা ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন। কিন্তু মানুষটার চোর-ডাকাত, খুনির বদলে সাহিত্য, শিল্প, গান বাজনায় অনেক বেশি ইন্টারেস্ট। একেকটা সময় একেকটা জিনিস মাথায় চেপে বসে। কিছুদিন আগে রাগ–রাগিণী নিয়ে মেতেছিলেন। কোন রাগে কী এফেক্ট। রাগের শাখা প্রশাখা কেমন থাকে। কানাড়া রাগ নিয়ে তিনি ডায়েরিতে একটা প্রবন্ধ মতো লিখেছিলেন। তবে সেটা স্ত্রীকে ছাড়া কাউকে পড়াননি। এখন আবার মাথায় ঢুকেছে ছবি আঁকা। নিজে আঁকা নয়, ছবি নিয়ে লেখাপড়া। ছবি দেখা, ছবির বিশ্লেষণ, ছবির অর্থ—বোঝবার চেষ্টা। স্ত্রীর দই খোঁচার উত্তরে সেদিন বলেছিলেন, ‘কী বলছো ছন্দা! আমাকে দেখে অফিসে কতজন দই খেতে শুরু করেছে জানো? বাড়িতে খাওয়ার সময় কোথায়? লাঞ্চের পর খানিকটা গ্যাপ দিতে হবে তো।’
ছন্দা বলল, ‘বাপ্রে এমন ভাবে বলছো যেন দই নিয়ে বিরাট বিশেষজ্ঞ।’
বসন্ত সাহা লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সেদিন স্ত্রীর হাতে ধরে টেনে পাশে বসিয়েছিলেন। তারপর জ্বলজ্বলে চোখে বললেন, ‘দইয়ের গুণকীর্তন রয়েছে সর্বত্র। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত বইতে রয়েছে চাঁপাকলা দধি সন্দেশ কহিতে না পারি।/ সঘৃত পায়েস নব—মৃৎকুণ্ডিকা ভরি। আমি দই কেন খাই জানো ছন্দা? বাড়িতে পাতা সাদামাঠা দই খেলে বু্দ্ধির গোড়ায় জল দেওয়া হয়। দইতে কী থাকে না? ভিটামিনস্, মিনারেলস্, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট। মস্তিস্কের কোষকে একেবারে সতেজ, টানটান করে দেয়। জটিল ক্রিমিনাল কেসগুলো একেবারে জলের মতো হয়ে যায়।’
ছন্দা উঠে পড়ে বলেছিল, ‘ঠিক আছে এবার থেকে কৌটোর বদলে, অফিসে তোমাকে হাঁড়ি করে দই দেব। তুমি গোটা ফোর্সকে বিলোবে।’
ছন্দাদি ছাড়া আরও কয়েকজন হোটেলে যেতে আপত্তি করেছে। বলেছে, ‘এই অকেশনে বাইরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’ পরে মুকুর ভেবে দেখল, এটা ঠিকই বলেছে। এই পার্টি ফ্ল্যাটেই হবে। শুধু খাওয়াদাওয়া নয়, আরও একটা মজা রযেছে। সেই মজাটা একেবারে গোপন। কাউকে বলা হয়নি। শুধু সুনন্দ জানে। তাও জেনেছে মাত্র দুদিন আগে। মুকুরের কাছে শুনে অল্প হেসে বলেছে, ‘যতসব ছেলেমানুষি। যাক, তুমি যা ভাল বোঝো করো।’
মুকুর বলেছিল, ‘কেন তোমার পছন্দ হয়নি?’
সুনন্দ বলেছিল, ‘খুব হয়েছে। নামটা কার দেওয়া? তোমার?’
মুকুর মুচকি হেসে বলল, ‘এখন বলব না। সেদিন জানতে পারবে। কারপেন্টারকে বলা আছে। সেদিন সকালে এসে দরজার পাশে লাগিয়ে দেবে।’
সুনন্দ বলল, ‘গুড।’
মুকুর এই ফ্ল্যাটের একটা নাম রেখেছে। দ্য ড্রিম। নামটা রেখেছে তার এক বন্ধু। দরজার পাশে নেমপ্লেটটা থাকবে। ফুলের পর্দা থাকবে তার ওপর। মুকুরের সেই বন্ধু পর্দা সরিয়ে নাম উদ্বোধন করবে।
ক্যাটারার, ডেকরেটরের ফোন সেরে ডায়েরি খুলে গেস্টদের লিস্ট বের করল মুকুর। প্রথমেই চোখ পড়ল একেবারে নিচে। তেরো নম্বরে। মুচকি হাসল মুকুর।
————
এই ধারাবাহিক উপন্যাসের সব পর্ব একসঙ্গে পাওয়া যাবে এখানে