Advertisment

অনাবৃত ২২: কে বারবার বুথ থেকে ফোন করছে হৈমন্তীকে?‌

প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস: হৈমন্তীর একাধিক পুরুষসঙ্গী। কারও সঙ্গে বেড়াতে যায়, কারও সঙ্গে যায় রেস্টুরেন্টে খেতে , কারওকে বিছানায় ডেকে নেয়। তিনজনই ভাবে ভালবাসা। হৈমন্তী জানে, এটা তার খেলা। নির্মম খেলা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito

অলংকরণ- অরিত্র দে

হৈমন্তী বাথরুমে পা রাখতে না রাখতে খাটের ওপর ফেলে রাখা মোবাইলটা আবার বেজে উঠল।

Advertisment

‘‌ধরব না’‌ ভেবেও ফিরে এল হৈমন্তী। আবার অচেনা নম্বর। এটাও ল্যান্ড ফোন। ফোন কানে নিল। গলা চিনতে পারল।

‘আবার কী হল?‌’
ওপারের পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘‌বাদ‌‌ দাও হৈমন্তী। আমার কেমন ভয় করছে।’‌
হৈমন্তী বলল,‘‌তোমার ভয় লাগার কী হয়েছে?‌ তুমি তো কনসার্নড নও। কাজটা তো তুমি করবে না।’
‘‌তা হোক। এভাবে.‌.‌.রিস্ক থেকে যাচ্ছে।’‌

হৈমন্তী বলল, ‘‌রিস্ক তো থাকবেই। এরকম একটা ঘটনায় রিস্ক থাকবে না তো কী থাকবে। এটা তো কোনো নতুন কথা নয়। যখন ভেবেছিলাম, তখন রিস্ক আছে জেনেই ভেবেছিলাম। তুমিও জানতে।’‌
‘‌অন্য কোনোদিন.‌.‌.‌অন্য কোনোভাবে।’‌
হৈমন্তী বিরক্ত গলায় বলল, ‘‌না, এবারই। সব সাজানো হয়ে গেছে। হৈমন্তী কখন পিছিয়ে যায়নি। আর কী ভাবে কাজটা করব তুমি জানলে কী করে?‌’‌

ওপাশের পুরুষকণ্ঠ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,‘‌আমি নেই।’‌
হৈমন্তী মুচকি হেসে বলল, ‘নো নিড। তুমি থাকা না থাকায় কী আসে যায়?‌ তোমাকে নিয়ে তো আমি ভাবিনি। ফোন রাখছি, আমি স্নানে ঢুকব।’

পুরুষকণ্ঠ গলায় ‌আকুতি এনে বলল, ‘হৈমন্তী, প্লিজ শোনো, বিষয়টা বোঝবার চেষ্টা কর। ওখানে অনেকে থাকবে। আমরা সবার চোখে ধুলো দিতে পারবে না। ই‌মপসিবল।’‌

হৈমন্তী কড়া গলায় বলল, ‘আমার আসছে কোথা থেকে? আর‌ আলোচনাটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?‌ ফোনে এই ধরনের আলোচনা করা ঠিক হচ্ছে কি?‌ বিপদ তোমারই হবে।’‌

‘চিন্তা নেই, পোস্টাপিস থেকে করছি।’‌

হৈমন্তী খানিকটা অবাক হয়েই বলল,  ‘কলকাতার ‌পোস্টাপিস থেকে এখনও ফোন করা যায়?‌ ওসব তো প্রাচীনকালে হত। তুমি দেখছি আজ শহরের কোনো বুথ বাকি রাখবে না।’‌

‘‌ওসব কথা বাদ দাও। তুমি প্ল্যান ক্যানসেল কর হৈমন্তী। যত সময় যাচ্ছে আমার মনে বলছে, ভুল হচ্ছে।’‌

হৈমন্তী সামান্য হেসে বলল,‘তুমি প্ল্যানটাই তো জানও না। তার আবার ঠিক ভুল কী করে বুঝবে?‌’‌
‘‌কী প্ল্যান?‌’‌
হৈমন্তী একটু ভেবে বলল, ‘‌ফোনে বলা যাবে না।’‌
‌পুরুষকণ্ঠ উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘আমি তোমার কাছে যাচ্ছি। তোমার হোটেলের কাছেই আছি আমি।’‌
‌হৈমন্তী ব্যঙ্গের হেসে বলল, ‘হোটেলের ‌সিসিটিভি?‌ তোমার ফটো তোলা থাকবে যে।’‌
পুরুষকণ্ঠ আরও উত্তেজিত ভাবে বলল,  ‘‌নিকুচি করেছে তোমার সিসিটিভি। আই ডোন্ট কেয়ার।’
হৈমন্তী ঠাট্টার গলায় বলল, ‘এই তো সাহসী প্রেমিকের মতো কথা।‌‌’
‘‌আমি সবসময়ই সাহসী।‌’‌

হৈমন্তী বলল,‌ ‘‌সে তোমার সঙ্গে শোওয়ার সময়েই বুঝতে পারি।’‌
‘‌এসব বাজে কথা বাদ রাখ। আমি আসছি। এসে তোমাকে বোঝাচ্ছি।’‌

হৈমন্তী ফিসফিস করে বলল, ‘‌এস আমি বাথটাব রেডি করছি। তুমিও আমার সঙ্গে জলে শোবে। তারপর না হয় বুঝব।’

ফোন ছেড়ে দিয়ে হৈমন্তী বাথরুমে গেল। বাথটাবের কলগুলো খুলে দিল।‌ বাথটবে শুয়ে না থেকে পুলে গেলে ভাল হত। অনেকদিন সাঁতার কাটা হয়নি। যে কোনও টেনশনের আগে খানিকটা এক্সারসাইজ ভাল। অ্যাড্রিনালিন রিলিজ হয়। যদিও এখন আর তার কোনো টেনশন হয় না। টেনশন করবার জীবন হৈমন্তী আগেই শেষ করে এসেছে। কর্মজীবন অভ্যেসের, অভিজ্ঞতার। মেধা, লেখাপড়া তাকে কাজ শিখিয়েছে। তাই সে জীবনে ভাবনা থেকেছে, টেলশন থাকেনি। নোংরা মানুষের প্রতি কেমন করে কঠিন আচরণ করতে হয় তা যেমন শিখেছে, তেমনই শিখেছে গুণের কদর করতে।

টিম নিয়ে চলতে গিয়ে সমস্যা হয়েছে, আবার টিমই সমাধান করেছে অনেক জটিলতার। তাই এসব হৈমন্তীর কাছে কোনো ভাবনাই নয়। ঐন্দ্রিল এবং তুষারের ধাক্কাই তাকে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত করে তুলেছে। সহজ, সরল অথচ গভীর ভালবাসার সুযোগ নিয়ে তাকে যেভাবে প্রতারণা করা হয়েছে সেই অপমান হৈমন্তী সারাজীবন বহন করে চলেছে। ভুলতে চেয়েছে বারবার। পারেনি। উলটে অপমান ক্রোধে পরিণত হয়েছে। সেই ক্রোধের চরিত্র বড় অদ্ভুত। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, সুযোগ পেলেই ভিতরে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।

ঐন্দ্রিল আর তুষার তাকে যেমন প্রেমে অবিশ্বাসী হতে শিখিয়েছে, তেমনই ভিতর থেকে শক্তও করেছে। বিশেষ করে ঐন্দ্রিল। কিশোরীবেলা থেকে যত্নে লালন করা ভালবাসাকে পায়ে ফেলে পিষেছে যেন। সরল মুগ্ধতার সুযোগ নিয়েছে। রেপ ছাড়া তাকে আর কী–‌ই বলা যায়?‌ হ্যাঁ, রেপই তো। শরীরে যেমন, মনকেও চরম অপমান। তু্ষারও কম কিছু নয়। সিরিয়াস প্রেম করেছে। ঘর পোড়া হৈমন্তী সতর্ক থাকায় শরীর পায়নি, কিন্তু ভালোবাসা পেয়েছে। বাবা–‌মায়ের শর্তে সেই ভালবাসাকে তুচ্ছ  করতে একটুও সময় নেয়নি তুষার। শিক্ষিত, মেধাবী প্রেমিকা কাজকর্ম ছেড়ে বাড়ির ‘দাসী’ বানানোর প্রস্তাব দিতে গলা কাঁপেনি তার। সারাদিন রান্নাঘরে বসে বাবা–‌মায়ের সেবা করবে, রাতে আমার সেবা করতে আসবে বিছানায়—এটাই যেন তার কথা ছিল। ঘরের বৌ বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারবে না। পরিবারে নাকি এমনটাই নিয়ম। এও ভংয়কর অপমান। এরপর পুরষমানুষকে ঘেন্না করলে হৈমন্তীকে কি দোষ দেওয়া যেত?‌ মনে হয় না।  হৈমন্তী কি তাই করে?‌ মুখ দেখে বোঝবার উপায় নেই। এখনও তার একাধিক পুরুষসঙ্গী। অন্তত তিনজন বটেই। ইচ্ছে হলে কারও সঙ্গে বেড়াতে যায়, কারও সঙ্গে যায় রেস্টুরেন্টে খেতে, কারওকে বিছানায় ডেকে নেয়। তিনজনই ভাবে ভালবাসা। হৈমন্তী জানে, ভালবাসা হোক অথবা না হোক, আসলে এটা তার একটা খেলা। নির্মম খেলা। এই খেলা সে নিজেই তৈরি করেছে। তিনজনই তার কাছে নিচু হয়ে থাকে। কেউ তার বুদ্ধি আর শিক্ষা, কেউ আবার বড় চাকরি, কেউ বা তার রূপের কাছে বশ্যতা মেনেছে।

হৈমন্তী এই খেলায় পুরুষমানুষকে নেড়েঘেঁটে দেখতে চায়। অপমানও করে, ঘেন্না করে বুঝতে দেয় না। নিজের ভিতরে সে প্রতিশোধের তৃপ্তি পায়। এই খেলা সে মন দিয়ে খেলে। তারপরেও কখনও ক্লান্ত লাগে, লাগে একা। আয়নার সামনে দঁাড়িয়ে কথা বলে নিজের সঙ্গে। ভিতর আর বাইরের হৈমন্তী।
বাইরে থাকা হৈমন্তী জিগ্যেস করে, ‘‌কেমন আছ হৈমন্তী ?‌’
আয়নার ভিতরে থাকা হৈমন্তী উত্তর দেয়, ‘‌ভাল নেই হৈমন্তী।’
বাইরের হৈমন্তী বলে, ‘‌কেন?‌ কেন ভাল নেই? কত সুন্দর দেখতে তোমাকে!‌ পুরুষমানুষরা তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে থাকে।‌ তুমি কেন ক্লান্ত হবে?‌‌

আয়নার হৈমন্তী ভিতর থেকে বলে ওঠে, ‘অসহ্য লাগে। এই অভিনয়, এই খেলা অসহ্য লাগে। ঠকতে ঠকতে আমি ক্লান্ত হৈমন্তী।’
যাই হোক, এই তিন পুরুষের একজন সমস্যা করছে। বিবাহিত এই পুরুষের সমস্যা একটু জটিল। সে হৈমন্তীকে বিয়ে করবার জন্য পাগলামি শুরু করছে। এটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল, বিয়ের জন্য সে তার স্ত্রীকে ডিভোর্সও করতে পারছে না। যেদিন সেই পুরুষ এই কথা বলে ‌হৈমন্তী খুব অবাক হয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যেবেলা হৈমন্তীর পুনের ফ্ল্যাটে সে এসেছিল। হৈমন্তীই তাকে থেকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। এই লোক অন্যদিন তাও একটু আধটু গাঁইগুঁই করে। পরদিন মিটিং, সাইট ভিজিট, অডিট—এইসব ফ্যাকড়া তোলে। সেদিন এককথায় রাজি হয়ে গেল।

হৈমন্তীও সেদিন শরীর চাইছিল। একটু হাত ধরা, একটু চুমু খাওয়া, অথবা একটু বুকের ছোঁয়া নয়, উন্মাদের মতো শরীর চাই। বাঁধ ভাঙা শরীর। যেন পুরুষের আদরে সোহাগে নিজেকে দুনিয়ার সেরা মানবীর মতো নয়, লাগে সেরা মানুষের লাগবে। ঘামে, ক্লেদে, নিঃশ্বাসে শরীরে শরীর মিশিয়ে যেন চিৎকার করে উঠতে পারে।

‘স্কাউন্ড্রেলের দল, তোমরা দেখে যাও। আমি কী পারি তোমরা দেখে যাও। হে পুরুষ, হাঁটু মুড়ে বস আমার সামনে। হাত তুলে আমার কাছে সোমরস ভিক্ষা কর।’‌

বিয়ার খেতে খেতে সেদিন সেই লোককে হৈমন্তী বলেছিল, ‘জামা কাপড় খুলে ফেল। তোমাকে নগ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে। আই ওয়ান্ট টু সি ইউ ন্যুড।’
‘‌তুমি?‌’‌
‘‌না। আমি পোশাক পরেই থাকব।’‌
——————‌‌

এই উপন্যাসের সব পর্ব একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Anabrito
Advertisment