Advertisment

প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত (পর্ব ৮)

উইকেন্ডে, অর্থাৎ প্রতি শনি ও রবিবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত হচ্ছে প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস অনাবৃত। প্রতি পর্বের সঙ্গে লিংক থাকছে আগের পর্বগুলির। পড়ুন ও পড়ান।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito part 2

অলংকরণ- অরিত্র দে

Advertisment

‘‌এ মোহ আবরণ খুলে দাও, দাও হে।
সুন্দর মুখ তব দেখি নয়ন ভরি,
চাও হৃদয়মাঝে চাও হে।’‌
সুবিনয় রায় গাইছেন। এমনিতেই সুবিনয় রায়ের গলা গমগমে। ভাল মিউজিক সিস্টেমে গলা আরও গমগম করছে।
টুকটাক্‌ ঘরের কাজ সারতে সারতে মুকুর গান শুনছে। ছুটির দিন সকালে মুকুর খানিকক্ষণ গান শোনে। নির্দিষ্ট কোনো গান নয়, যখন যেরকম ভাল লাগে। বাংলা আধুনিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত, হিন্দি ফিল্ম। বাছবিচার কিছু নেই। পুরোনো গান নিয়ে যেমন আদিখ্যেতা নেই, নতুন গান নিয়ে তেমন  হ্যাংলামোও নেই। তবে গানের ব্যাপারে তার একটা মজার স্বভাব আছে। কোনো গান শুনে যদি ভাল লেগে যায়, বারবার সেই গানটাই শুনতে থাকবে। শুধু এখানেই থামবে না। সেই গানটা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ারও চেষ্টা করে। কার লেখা, কে সুর দিয়েছিল, কবে গাওয়া হয়েছিল এইসব। এর জন্য তার একজন ফেলুদার মতো ‘‌সিধু জ্যাঠা’‌ আছে। না, ‘‌সিধু জ্যাঠা’‌ নয়, ‘‌সিধু জেঠি’‌। মুকুরের কলিগ শ্রাবস্তী। ওর গানের গলা ভাল নয়, তবে গানবাজনা, সিনেমা, থিয়েটার নিয়ে খোঁজ খবর রাখে। এই বিষয়ে ওর স্টকে প্রচুর বই, ম্যাগাজিন রয়েছে। শ্রাবস্তীর বাবা একসময়ে গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অভিনয় করতেন। থিয়েটারে গানও গাইতে হতো। সম্ভবত সেই কারণেই মেয়ের মধ্যে এইসব গান বাজনার নেশাটা রয়েছে গেছে । ‘‌এ মোহ আবরণ’‌ গানটা নিয়ে একটু আগেই শ্রাবস্তীকে ফোন করেছিল মুকুর।
শ্রাবস্তী বলল, ‘এ তো রবীন্দ্রনাথের গান।’‌
‘‌সে তো জানি, তুমি একটু ইনফর্মেশন দাও।’
শ্রাবস্তী বলল, ‘ইনফর্মেশন দেওয়ার কী আছে?‌‌ ‌যাকে জিগ্যেস করবে সে–‌ই বলে দেবে। এই ভদ্রলোকের গান নিয়ে তিন হাজার তিনশো তিপান্ন রকমের গবেষণা হয়েছে। বেশিও হতে পারে। অজস্র বইও তো রয়েছে।’‌
মুকুর বলল, ‘তুমি কি আমাকে এখন তিন হাজার তিনশো তিপান্নটা বই ঘাঁটতে বলছো শ্রাবস্তী?‌’‌
শ্রাবস্তী বলল, ‘‌ঠিক আছে, কী জানতে চাও বলো। ‌দেখি পাই কিনা।’‌
মুকুর বলল, ‘‌স্পেসিফিক কিছু নয়। যেটুকু পাবে। আমি তো কিছুই জানি না। গানটা এতো সুন্দর!‌ সুন্দর একটা গান সম্পর্কে কিছু না জানলে গান শোনাটা কেমন ইলকমপ্লিট লাগে। মন হয়, পুরোটা বোঝা হল না।’
‌শ্রাবস্তী হেসে বলল, ‘তোমার যত রাজ্যের খেপামি মুকুরদি। ঠিক আছে, ‌একটু সময় দাও। শান্তিনিকেতনে কল্যাণকাকুকে ফোন করছি। একসময়ে উনি সঙ্গীতভবনের শিক্ষক ছিলেন। রবিঠাকুরের গানের ডিরেক্টরি।’‌
খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুকুরের ওয়াটসঅ্যাপে শ্রাবস্তীর মেসেজ চলে এলো
‘‌এ মোহ আবরণ—রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান। ২৩ বা ২৪ বছর বয়েসে লিখেছিলেন। সম্ভবত ২৩ বছর বয়েসে। গানের রাগ ইমন। গানটি তৈরি করা হয় আদি ব্রাহ্মণ সমাজ মন্দিরে মাঘোৎসব উপলক্ষে। স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন ইন্দিরা দেবী। আপাতত এইটুকু। পরে আরও পাওয়া গেলে জানাব।’‌
এই মেসেজ পাওয়ার পর মুকুর গানটা আবার শুনছে। মনে হচ্ছে, তথ্য জানাবার পর গানটা যেন একটু বেশি গম্ভীর গম্ভীর লাগছে। কোনো গান সম্পর্কে তথ্য জানবার এটাই মজা। জানবার পর একটু হলেও গান অন্যরকম হয়ে যায়। মহম্মদ রফির গাওয়া একটা গান নিয়ে একবার এরকম হয়েছিল। গানটা আগে একরকম লেগেছে, পরে যখন জানা গেল, আর্টিস্ট গায়ে জ্বর নিয়ে এই গান গেয়েছিলেন, তখন আরেক রকম মনে হল। মনে হল, শরীর ভাল থাকলে গানের ভিতরের প্রেম ভাবটা আরও ভাল ভাবে ফুটত। না জানলে এমন মনে হতো না।
আজ কিন্ত সবার ছুটি নয়, শুধু মুকুরের ছুটি। তার স্কুলের ‘‌ফাউন্ডেশন ডে’‌। পরপর তিনদিন ছুটি পাওয়া গেল। কাল শনিবার কী একটা পরব আছে। পরশু তো রবিবার। ফলে তিনদিন ছুটি। ছুটির কথা জানবার পর টিচার্সরুমে মিটিঙ হয়েছিল। দল বেঁধে  বেড়াতে যাওয়া হবে। দীঘা, তালসারির মতো কোথাও একটা টুক্‌ করে ঘুরে আসা যায় না?‌ এই ধরনের বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে টিচারদের মধ্যে মুকুরের উৎসাহ সবথেকে বেশি। তার ছেলেপুলে নেই। বরকে নিয়ে একার সংসার। সেই অর্থে ঝাড়া হাত পা। তারওপর সুনন্দ মানুষটা চমৎকার। বউয়ের কোনো উৎসাহে বাধা দেয় না। তার অবশ্য একটা অন্য কারণও আছে। বিয়ের পাঁচ বছর পরেও তাদের এখনও বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। ফলে মুকুর খানিকটা একা। যদিও মা হবার বয়স এখনও অনেকটা পড়ে আছে। ডাক্তারও সেরকম বলেছে। তাও চিন্তা তো থাকে। যদিও মুকুর বিষয়টা নিয়ে একেবারে আলোচনা চায় না। চিন্তা নিজের ভিতরে রাখে। আত্মীয়রা বিরক্ত করে বেশি। এটা সেটা বলার পর, বাচ্চার কথা জিগ্যেস করে বসে।
‘‌কী রে, অনেকদিন তো হল, এবার ভাল ডাক্তার দেখা।’‌
‘‌ভাল ডাক্তারই দেখাচ্ছি কাকিমা।’
‘‌রাগ করিস না, মাথা ঠান্ডা করে শোন। এসব অসুখ শুধু ডাক্তাকে সারে না।’‌
মুকুর রাগ সামালে ঠান্ডা গলায় বলে, ‘কী লাগে ?‌’‌
‘‌আমি একজনকে চিনি, খুব‌‌ ভালো মাদুলি দেয়। একদিন শনিবার করে আমার সঙ্গে চল।’‌
মুকুর আত্মীয়দের অ্যাভয়েড করতে শুরু করেছে। তবে তার ‘‌একা’‌ হওয়ার কারণ শুধু এটাই নয়, সুনন্দর চাকরিও একটা কারণ। সুনন্দ ইঞ্জিনিয়র। বড় চাকরি করে। কলকাতায় অফিস হলেও বড্ড ট্যুরে যেতে হয়। মাসে তিন চারবার করে মুম্বাইতে ছোটে। পুনের কাছে কোথায় যেন কাজ চলছে। কোনো কোনোবার দশ–‌বারো দিন পর্যন্ত থাকতে হয়। সাউথ ইন্ডিয়াতেও কাজ পড়ে। গতমাসেই চেন্নাই ছুটতে হল। এই সময়গুলো মুকুরের একাই থাকতে হয়। তবে ব্যস্ত থাকবার মতো তার কাজ অনেক। তার মধ্যে একটা অংশ বাধ্যতামূলক। চাকরির জন্য করতেই হয়। আর একটা অংশ সে নিজেই তৈরি করে নিয়েছে। স্কুলের গাদাখানেক খাতা দেখা থাকে। পড়ানোর জন্য রোজ রেডি হতে হয়। সে ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভের সায়েন্স টিচার। কেমিস্ট্রি পড়ায়। সাবজেক্ট হিসেবে কেমিস্ট্রি একবারেই ইজি নয়। ছাত্রীদের সহজ করে বোঝানো আরও কঠিন। সিলেবাস দিন দিন কঠিন হচ্ছে। তাই রোজই প্রিপারেশন নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। এছাড়াও মুকুর গান বাজনা শোনে, বই পড়ে, থিয়েটার দেখতে যায়। মাঝে মধ্যে শপিং মলে ঘোরে। কিছু স্কুল -‌কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। বহ্নিশিখা, অত্রিনা, হৈমন্তী। কলেজের ব্যাচমেট সব। এদের মধ্যে হৈমন্তীর সঙ্গে সম্পর্কটাই সবথেকে বেশি হয়েছে। তাও মাঝখানে যোগাযোগ ছিল না, তিন বছর হল রিনিউড্‌ হয়েছে। ঘনিষ্ঠও হয়েছে। হৈমন্তী মজার, খেপুটে ধরনের মেয়ে ছিল। স্টুডেন্ট হিসেবে ব্রিলিয়ান্ট। দেখতেও মিষ্টি। কলেজে সবাই ‘‌‌মিস্‌ কেমিস্ট্রি’ বলে ডাকত। পরে মেয়েটার ওপর দিয়ে মারাত্মক সব ঝড় বয়ে গেছে। ভিতরের উচ্ছ্বাসটা কমে গেছে। এখন পুনেতে ভাল চাকরি করছে। যে কোনো সময় বিদেশে চলে যাবে। কলকাতায় কাজে এসে দু’‌বার দেখা করে গেছে। একবার ফ্ল্যাটেও এসেছিল।
আড্ডার একটা পর্যায়ে মুকুর বলছিল, ‘খুব গম্ভীর হয়ে গেছিস হৈমন্তী।‌’‌
‘আমাদের চাকরিতে গম্ভীর থাকাটাই শর্ত। অফিসে ঢোকবার আগে ষখন ফর্ম ফিলাপ করেছিলাম, তখন একটা পয়েন্ট ছিল—কোনটা পছন্দ?‌ হাসিখুশি না গম্ভীর?‌ যারা হাসিখুশিতে টিক দিয়েছিল, তাদের সবাই আউট। কারও চাকরি হল না। আমার মতো যারা রামগড়ুরের ছানা তারা কেবল চাকরি পেলাম।’‌
দুজনে হেসে উঠল। মুকুর বলল, ‘‌এই তো চমৎকার মজা করতে পারিস।’‌
‘‌তোর কাছে এসে পারছি মুকুর। ’‌
‘‌তাহলে এরপর থেকে কলকাতায় এলে হোটেলে না উঠে আমার  ফ্ল্যাটে উঠবি।’‌
হৈমন্তী হেসে বলেছিল, ‘‌ফ্ল্যাটের ভাগ নিচ্ছি বলে তোর বর মারবে।’‌
‘‌ওমা!‌ কেন?‌ মারবে কেন!‌ সুনন্দ খুব ভালোমানু্ষ।’‌
হৈমন্তী শুকনো হেসে বলেছিল, ‘ভালোমানু্ষরা আমাকে সহ্য করতে পারে না। আমার পাস্ট দেখলেই বোঝা যাবে। সবাই আমাকে কোনো না কোনোভাবে বিট্রে করেছে।’
মুকুর হৈমন্তীর গায়ে হাত রেখে বলল, ‘‌ওভাবে বলিস না।’‌
হৈমন্তী লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, ‘‌আর বলব না। তোর বর কেমন ভাল শুনি? রোজ আদর করে?‌’‌
‌মুকুর ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘‌রোজ তাকে পাই কই?‌ ট্যুরে ঘুরে বেড়ায়।’
‌‌হৈমন্তী বলল, ‘‌ভেরি গুড। রোজ রোজ আদর করলে আদর একঘেয়ে হয়ে যায়।’‌
ছুটিছাটা থাকলে মুকুর কলিগদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে বেড়াতে যায়। সব মিলিয়ে হইচইয়ের মধ্যেই থাকতে চেষ্টা করে মুকুর।
মুকুর বলল,‌ ‘‌তোমরা যাও এবার আমার হবে না।’‌
মধুমিতাদি বলল, ‘‌কেন?‌ তোমার হবে না কেন?‌’‌
মুকুর বলল, ‘একটা অনুষ্ঠান আছে।’‌‌‌
চন্দনা বলল, ‘‌কী অনুষ্ঠান?‌ পরে করলে হয় না?‌’‌
মুকুর হেসে বলল, ‘না। স্পেশাল অনুষ্ঠান। ডেট বদলানো যাবে না।’
—————‌‌

ধারাবাহিকের সব পর্ব একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
Anabrito
Advertisment