Advertisment

প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত (পর্ব ৯)

প্রত্যেক শনি ও রবিবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত হচ্ছে প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস অনাবৃত। প্রতি পর্বের সঙ্গে লিংক থাকছে আগের পর্বগুলির। পড়ুন ও পড়ান।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito part 2

অলংকরণ- অরিত্র দে


মুকুর মিউজিক সিস্টেম বন্ধ করে ফোন নিয়ে সোফায় বসল। ফোনের সঙ্গে ডায়েরি। এই ডায়েরির একটা নাম আছে। সিক্রেট ডায়েরি। নামের কারণ আছে।
এখন আর কেউ ফোনের জন্য হাতে লেখা ডায়েরি ব্যবহার করে না। ফোনবুকেই সব রাখা থাকে। মুকুর ব্যবহার করে। সবসময় নয়, অনেক ফোন করতে হলে করে। তাছাড়া মুকুরের ডায়েরিতে একট মজার ব্যাপার আছে। কেউ জানে না। এমনকি তার বর সুনন্দও নয়। ডায়েরি থাকে কাবার্ডের একবারে নিচের তাকে। এখানে মুকুরের লেখাপড়ার বই আছে। বেশিরভাগই কলেজের বই। কেউই হাত দেয় না।
মুকুর এখন সিক্রেট ডায়েরির মজা হল এখানে নম্বর, ঠিকানার সঙ্গে নানা ধরনের নোট থাকে। কার সঙ্গে কী কথা হল, তার একটা বিশেষ কথা হয়তো লিখে রাখল। এতে পরের কথার একটা কিউ যেমন পাওয়া যাবে, তেমন জরুরি কিছু হলে লেখা থাকবে। তবে বেশিরভাগ সময়েই মুকুর উলটোদিকের মানুষটার মুড ধরবার চেষ্টা করে। কয়েকটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে।
মণিকা রায় (‌হেড মিসট্রেস)‌— কেমন যেন থমথমে গলা লাগল। হুঁ, হাঁ বলে ফোন রেখে দিল। কোনো কারণে চটে আছে নাকি?‌
বাবু (‌মামাতো ভাই)‌— ওর ধার চাওয়াটা বেড়েছে। সুনন্দর ইনডালজেন্সে হচ্ছে।
নির্মলদা (‌কলিগের স্বামী)‌— এখনও বউয়ের ফোন ধরে!‌
মধুসা (‌বন্ধু)‌— ফট করে রেগে গেল কেন?‌ আমার ওপর জেলাসিটা আজও গেল না। স্কুলে আমি ফার্স্ট হতাম এটা এই ধেড়ে বয়েসেও ভুলতে পারে না।
মেজোকাকিমা— খুব আশ্চর্যের ব্যাপার আজ আর বাচ্চা টাচ্চার কথা তুলল না।
নিতাইয়ের মা (‌কাজের মাসি)— একটুও জ্বর নয়। জোর করে কাশল। এই নিয়ে তিনদিন কামাই।
মিঠু (‌পরিচিত, বন্ধুর মতো)‌— সুনন্দ সম্পর্কে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কী বলতে চাইল?‌ কিছু দেখেছে।
কাঁকনদি (‌আত্মীয়)‌— উলের প্যার্টান বলতে হবে।
হৈমন্তী (‌কলেজের বন্ধু)‌— একটা মিথ্যে কথা বলেছে। মিথ্যেটা ধরতে পারছি না।
বাচ্চুকাকু (‌আত্মীয়)‌— খালি খারাপ খবর দেবে। আজ মেজদিদার মৃত্যুর খবর দিল।
সুনন্দ— সামথিং রং।
এইরকম সব নোট লেখা আছে।  অনেকটা কোডের মতো। সবটা বোঝাও যায় না।
সেই ডায়েরি খুলে এখন পরপর ফোন করবে মুকুর। হাতে মাত্র একটা দিন। গেস্টদের রিমাইন্ডার পাঠাতে হবে। শুধু গেস্ট নয়, কেটেরারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ঠিক সময়ে যেন ওরা রান্নাবান্না নিয়ে চলে আসে। এখন সুবিধে হয়েছে। কম লোকের কাজ হলে, কেটেরার একেবারে রান্না–‌খাবার নিয়ে চলে আসে। খাবার সার্ভ করবার আগে গরম করে নিলেই হল। এমনকী গরম করবার গ্যাস সিলিন্ডার, ওভেনও ওরা আনে। বাকি খাবার রান্না করা হলেও, ভাজাভুজির আইটেমগুলো নিয়ে এসে ভাজে। সেদিক থেকে কোনো চিন্তা নেই। গরম করার জন্য ছাদের একপাশে ব্যবস্থা হয়েছে। মাথার ওপর চাঁদোয়া মতো একটুকরো কাপড় টাঙিয়ে দিলেই হবে। ডেকরেটরকে বলা আছে। কাল সকালে এসে টাঙিয়ে দেবে। আজ ফোন করে বলতে হবে ক'টা চেয়ারও চাই। নিউমার্কেটে ফুলের অর্ডার দেওয়া আছে। তাদেরও মনে করিয়ে দিতে হবে। বিকেলের মধ্যে এসে সাজিয়ে দেবে। কাল আর সময় পাওয়া যাবে না। গাদাগুচ্ছের ফুল নয়, শুধু সদর দরজাটা খুব ঝলমলে করে সাজানো হবে। নেমপ্লেটের ওপর একটা ফুলের পর্দা থাকছে। নেমপ্লেটটা কালকের প্রোগ্রামে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাকি সব ঘরে ফুলদানিতে ফুল থাকবে। সুনন্দর সঙ্গে গিয়ে ফুল পছন্দ করে এসেছে মুকুর। ফুলের দোকানদার অনুষ্ঠানের কথা শুনে বলল, ‘‌আরে বাঃ, এমন অকেশনের কথা তো আগে শুনিনি!‌ ম্যাডাম, একেকটা ঘরে একেকরকম ফ্লাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট করি?‌’‌
মুকুর বলেছিল, ‘‌নানা, বেশি কিছু নয়। শুধু ফুলদানিতে ফুল দিলেই হবে।’‌
দোকানদার বলল, ‘‌তাই তো বলছি। চারটে ঘরে চার রকমের ফুল।’‌
সুনন্দ পাশ থেকে বলল, ‘সেটাই ভাল হবে।’‌‌
এখন সবই মেকশিফটে করা যায়। নেমন্তন্নের জন্য হোস্টকে কিছু ভাবতে হয় না। খাওয়া দাওয়া, সাজগোজ, আপায়্যন সব আউট সোর্সিং। নানা ধরনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ হয়েছে। তারা যে কী পারে না!‌ বিয়ে, শ্রাদ্ধ, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন সব তুলে দিচ্ছে। কিচ্ছু ভাবতে হয় না। এই তো কিছুদিন আগে সুনন্দর এক বসের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিল মুকুর। সেখানে সবটাই বাইরের লোকের হাতে ছাড়া ছিল। বিয়ে আর খাওয়াটুকু যা নিজেদের। রিসেপ্‌শনে যে ছেলেময়েরা ছিল, তারা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন অনেকদিনের পরিচিত। এমনকী গেস্টেদের সম্পর্কে তাদের হাতে ছোটোখাটো তথ্যও ছিল। কার অফিস থেকে বেরোতে দেরি হয়, কার বাড়িতে  অসুস্থ মানুষ রয়েছে, কার ছেলে এবছর হায়ার সেকেন্ডারিতে ভাল রেজাল্ট করেছে—সব। মুকুর অবাক হয়েছিল। মিলিয়ে মিলিয়ে বলছে কী করে!‌
‘আসুন স্যার, মেসোমোশাই কেমন আছেন?‌’‌
‘‌ম্যাডাম আপনাদের নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। উল্টোডাঙা ব্রিজে হেভি ট্রাফিক হচ্ছে। আপনাদের তো ওই রুটটাই সুবিধেজনক।’
‘‌স্যার কনগ্রাচুলেশন। ছেলে এতো ভাল রেজাল্ট করছে.‌.‌.‌উই ফিল প্রাউড ফর হিম।’‌‌
এসব শুনে খানিকটা যেন ভড়কেই গিয়েছিল মুকুর। সুনন্দ বলেছিল, ‘এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। হোমওয়ার্ক করেছে। এর জন্য ওরা পেমেন্ট পায় মুকু।’‌
মুকুর চাপা গলায় বলল, ‘‌পেমেন্ট পায় তো জানি, কিন্তু মিস্টার রায়, মিসেস সেনকে আলাদা করে চিনছে কী করে!‌‌’‌
সুনন্দ বলল, ‘তুমি খেয়াল করনি। ‌ওদের কানে ব্লু টুথ আছে। কেউ আড়ালে বসে চিনিয়ে দিচ্ছে।’‌
মুকুর আরও নিচু গলায় বলল, ‘‌আড়ালে বসা লোকটা কে?‌ তোমার বস ?‌’‌
সুনন্দ বলল, ‘‌হতে পারে। বসের কোনো চেলাচামুন্ডাও হতে পারে। আগে থেকে ছবি টবি হয়তো জোগাড় করে রেখেছে। এখন ইনফর্মেশনের যুগ মুকুর। সব ডেটা নিয়ে কারবার। কে কীভাবে ডেটা সাপ্লাই করেছে কে বলতে পারবে?‌’‌
মুকুরের মনে হয়েছিল, এ এক আশ্চর্য পৃথিবী তৈরি হচ্ছে। মানুষ–‌রোবটের পৃথিবী। মানুষের ভিতরে কিছু ডেটা ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, সেই ডেটা অনুযায়ী সে হাসবে, হ্যালো বলবে, বাতের ব্যথা কেমন আছে জিগ্যেস করবে।
মুকুরদের অনু্ষ্ঠান অবশ্য বিরাট কিছু নয়। ছোটো একটা পার্টি। পার্টি না বলে গেট টুগেদার বলা যায়। মোটে তেরোজন আসছে। তেরো নম্বর মানুষটি অবশ্য প্রথমে লিস্টে ছিল না। হঠাৎই ঢুকেছে। সে সুনন্দর জন্য সারপ্রাইজ হবে। এই মানুষটির কথা সুনন্দ তার মুখে শুনেছে কিন্তু ‘‌মুখোমুখি’‌ দেখা হয়নি। অন্তত এমনটাই জানে মুকুর। সুনন্দও কি তাই বলবে?‌
মুকুর ভেবেছিল, বাইরে কোনো হোটেলে পার্টি করবে। অনেকেই আপত্তি করল। সবথেকে আপত্তি করল ছন্দাদি। ছন্দা সাহা। বলল, ‘‌এরকম একটা ইন্টারেস্টিং অনুষ্ঠান কেউ বাইরে করে?‌’‌
কথাটা ঠিক। নিউমার্কেট থেকে ছন্দা সাহা সকলেই অকেশনটা নিয়ে মজা পেয়েছে। পাওয়ারই কথা। নিউটাউনে আটতলার ওপর এই ফ্ল্যাট মুকুররা কিনেছিল এক বছর তিন মাস আগে। সেই অর্থে ফ্ল্যাটের বর্ষপূর্তিও বটে। এক বছরের জন্মদিন। মুকুর কিছুদিন ধরে ভাবছিল, এই এক বছর উপলক্ষ্যে একটা কিছু করবে। যাদের গৃহপ্রবেশ, মতপার্থক্যে ফ্ল্যাট প্রবেশের দিন ডাকা হয়নি, তাদের মধ্যে থেকে কজনকে ডাকবে। একদিন রাতে শোবার সময় সুনন্দকে বলেও ফেলল।
সুনন্দ বলেছি, ‘‌যা খুশি করো, আমাকে টানা হেঁচড়া করবে না।’‌
মুকুর ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছিল, ‘‌তুমি থাকবে না!’‌
‘‌থাকব না তো বলিনি। কাজ না থাকলে অবশ্য থাকব।’‌
মুকুর বলল, ‘‌ছুটি নেবে।’‌
সুনন্দ বলল, ‘‌তুমি জানো তো ছুটি নেওয়া আমার কত ঝামেলা।’‌
মুকুর স্বামীর ঘনিষ্ঠ হয়ে বলেছিল, ‘‌ওসব শুনব না।’‌
সুনন্দ বলে, ‘‌আচ্ছা সে হবে। অকেশনটা কী?‌’‌
মুকুর সুনন্দ গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘‌এখন বলব না। একটা দারুন আইডিয়া এসেছে।’‌
বলতে বলতে মুকুর সুনন্দর জামার বোতাম খুলতে থাকে।
‘‌ভেবেছি ইউনিক। তবে একজনের হেল্প নেব ঠিক করেছি ।’‌
সুনন্দ বলে, ‘‌খুবই রহস্যজনক পার্টি মনে হচ্ছে।’‌
সুনন্দর নগ্ন রোমশ বুকে নাক ঘষে মুকুর বলেছিল, ‘করতে পারলে তাই হবে। নাও আমার জামা খোল দেখি। বাপ্‌রে কতদিন পরে তোমাকে পেয়েছি।’
সুনন্দ একটু থেমে মুকুরকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘‌সরি ডার্লিং আজ খুব টায়ার্ড।’‌‌

Advertisment

——————

এই ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসের সব পর্ব একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
Anabrito
Advertisment