/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/02/book-review-section.jpg)
অলংকরণ- অরিত্র দে
কোচবিহার স্টেশনে নামার কথা। ব্যাঙ্গালোর সিটি গৌহাটি এক্সপ্রেসে নবারুণ ভট্টাচার্যের শেষ সাক্ষাৎকার পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাই কোচবিহার পেরিয়ে এসে নামলেন আলিপুরদুয়ারে। অঝোর বৃষ্টির মধ্যে। নেমে দেখলেন, স্টেশনের ভিতর রেললাইন ধরে একটা মোটাসোটা লোক, পায়ে গামবুট, হেঁটে চলেছেন, তাঁর বাঁ কাঁধে একটা বাজপাখি। বঙ্কিমচন্দ্র বৃষ্টিকুয়াশার মধ্যেও লোকটিকে চিনে ফেললেন, তাঁকে কাছে ডাকলেন। লোকটি আর কেউ না, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। এবং তাঁর কাঁধের বাজপাখিটির নাম চে। মার্কেজ এখানে এসে উঠেছেন আলিপুরদুয়ারেই, সাদাত হাসান মান্টোর বাড়িতে। আর বঙ্কিমচন্দ্রের গন্তব্য, যা ইতিমধ্যেই তিনি টপকে চলে এসেছেন, আসলে কোচবিহার রাজবাড়ি। উদ্দেশ্য ১৮৬০ সালে কোচবিহারের মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণকে লেখা মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি চিঠির সন্ধান। মাইকেলের মনে হয়েছে, সেই চিঠিতে হয়তো কিছু সাহিত্যগুণ থেকে থাকতে পারে, সেই চিঠিটি এখন তাঁর চাই। বঙ্কিমচন্দ্র কোচবিহার চলেছেন।
আরও পড়ুন, যুদ্ধের দর্শন, যুদ্ধের রাজনীতি
এবং এ সবই ঘটে চলেছে ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ উপন্যাসটির নির্মাণের সমকালে, মানে আমাদের সমকালে। বেশ। কিন্তু এই নানান কালপর্বের মহা মহা কবি- ঔপন্যাসিকেরা একই কালপরিধির মধ্যে ঢুকে পড়লেন কী করে? এঁরা কি ছায়াচরিত্র? মৃত-কিন্তু- মুক্তি-না-পাওয়া আত্মা? নাকি ভূত? না, ভূতের মতো শোনালেও এ ভূতের গল্প নয়, ভৌতিকতা নয়। উপন্যাসের লেখক অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাবনাতেই এই উপন্যাসের আঙ্গিকটার একটা ধরতাই দিয়েছেন। সেটা এরকম — সময়ের ভেতর বোধহয় একটা অলিগলি পথ আছে কোনও। সেখান দিয়ে সুড়ুৎ করে কেউ কেউ দেশ কাল ভাষা টপকে যাতায়াত করে আসেন । এবং উপন্যাসের এক চরিত্র জাক দেরিদা ঘোষণা করছেন – এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, সময়ের মাঝখানে থাকা এক গুপ্ত দরজা, যার ভেতর দিয়ে এক কাল থেকে আর এক কালে আসা-যাওয়া সম্ভব; ফলত, ইতিহাস বইয়ের তারিখ-সন লেখা ক্যালেন্ডারের ক্রম ধরে আমরা (উপন্যাসের চরিত্ররা)আসি না। বস্তুত, কোনও কিছুই এখানে স্থির, নিশ্চল ও প্রাক-প্রদত্ত নয়। বুদ্ধ, চণ্ডীদাস, বঙ্কিম, মার্কেজ, রবীন্দ্রনাথ, কমলকুমার, ঋত্বিক, সন্দীপন, অরুণেশ, নবারুণ এমনকি স্বয়ং জাড্য ইতিহাস – সবাই ঢুকে পড়ছে এ ওর স্লটে । প্রশ্ন উঠবে, শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে আমাদের এই উত্তুঙ্গ প্রগতিসুনিবিড় সময়ে এসে ঘোঁট পাকাচ্ছেন যাঁরা, তাঁরাও যদি ভূত না হন, তবে ভূত কারা? ভূত যে নন, তার একটা বড় প্রমাণ হল, এঁরা কেউই নিজ নিজ ব্যক্তিত্বের বা বয়ানের জের টেনে টেনে এতদূর এসে পৌঁছচ্ছেন না। নাম বা পদবী বলে দিলে চেনার উপায়ই নেই যে এই চরিত্রটি বঙ্কিমচন্দ্র, এইটি রামপ্রসাদ বা এইটি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। চরিত্রেরা আপন আপন মতাদর্শ মাফিক ইতিহাসের বিভিন্ন জ্ঞানতাত্ত্বিক মুহূর্তগুলোকে বয়ে এনে, একালের চালু প্রতর্কের সঙ্গে একটা নিরন্তর কথোপকথন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই যেন নামরূপ ধরেছেন। সেটুকু ব্যাতিরেকে উপন্যাসে তাঁদের আর পৃথক অভিজ্ঞান বা গুরুত্ব নেই। ফলে, তাঁরা যেন কান্টের ন্যুমেননের মতন – ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল, শাঁস, জগতের জ্ঞানতত্ত্বের ইতিহাসে তাঁদের রেখে যাওয়া দাগগুলোর উত্তরাধিকার।
অতএব একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উপন্যাসটি একরৈখিক নয়। অনেক বাঁকবদল আছে, অনেক কার্ভেচার তৈরি করা হয়েছে। কাহিনির ফাঁকে ফোকরে চোরাগোপ্তা হানায় ঢুকে পড়তে থেকেছে সমকালীন বাস্তবতা, জঙ্গলমহল সমাচার থেকে শুরু করে রকমারি দৈনিক খবরের কাগজে একই ঘটনার বহুমুখী ভাষ্য। ইতিহাসের-বাঁক-ফেরানো চমকপ্রদ সব ঘটনাবলীর কালাতিক্রম ভাঙা ধারাভাষ্য। আর তার চেয়েও বড় উপাদান হল নানান কবিতার লাইন, নানান দার্শনিক সন্দর্ভের অংশবিশেষের আনুষ্ঠানিকতার বালাই না রেখেই লেখাটির পরতে পরতে ঢুকে পড়তে থাকা। কিন্তু তবু এক অর্থে এ কাহিনি একরৈখিক। পাঠকের সুবিধার জন্য লেখক কিছু ক্লু দিয়েছেন। যে, এই কাহিনি অনেকটা বল্লমের মতো, বল্লমের হাতলটি পর্বে পর্বে বিভক্ত। এক পর্ব শেষ করে নতুন পর্বে পৌঁছে গেলে, পুরানোটিতে ফেরার আর কোনও সম্ভাবনা নেই । অর্থাৎ, পরিশিষ্ট ভাগের কোনও অংশেই এর পূর্ববর্তী অংশের রেফারেন্স বস্তুগতভাবে ফিরে আসবে না । কেন নেই? কেন ফিরে আসে না? তবে কি পর্বগুলি পরস্পরবিচ্ছিন্ন? কিছু পরস্পরবিচ্ছিন্ন প্রতর্কের আলগা কোলাজ? সেগুলো কি অন্তত ভাবগতভাবে অর্থাৎ থিম্যাটিক্যালিও একে অপরকে অনুসরণ করে না? শিল্পীর কাজটাই তো ক্যাকোফোনাস বাস্তবতার ভিতর থেকে একটা শ্রাব্য হার্মনি তৈরি করা। ‘সুখপাঠ্য’-র সংজ্ঞা পাঠক অনুযায়ী বদলে যেতেই পারে, গদ্যের ভাষা বিরিয়ানির ভাতের মতো সর্বত্রই ঝরঝরে হতে হবে এমনও নয়। কিন্তু তা বলে পর্বে পর্বে লেখ্য বিষয়ের মধ্যে অন্তর্লীন একটা সামঞ্জস্য তৈরি না করতে পারলে তো পাঠকের সংবেদী ধৈর্যের মূলে কুঠারাঘাত। না, ভাবসম্মিলন একেবারেই অনুপস্থিত, এমন নয়। মেলানোর একটা চেষ্টা অবশ্যই আছে। কিন্তু তার থেকেও বড় হয়ে উঠেছে বাংলা তথা ভারত ইতিহাসের অসংখ্য চমকপ্রদ দ্বন্দ্বকে এক কড়াইতে ফেলে জ্বাল দেওয়ার লোভ সম্বরণ করতে পারার অপারগতা।
আরও পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিনের কথা: কালধ্বনি
আর একটা বড় সমস্যা ভাষার প্রয়োগ। কথা ছিল, উপন্যাসের চরিত্রেরা নিজের কথা নিজে বলবেন। নাটকের সংলাপের মতন। ফলে, ন্যারেটরের কাজ নাটকেরই সূত্রধরের অধিক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্য কোনও কারণে দেখা যায়, চরিত্রেরা কথা বলছেন ন্যারেটরের বয়ানে, ন্যারেটরের ভাষায়। একমাত্র কবি অরুণেশ ঘোষকে বাদ দিলে ইতিহাসের বাঘা বাঘা ঔপন্যাসিকেরা কথা বলে চলেছেন একালের খবরের কাগজের বাংলায়! দেউলটির মাঠে জ্যোৎস্নারাতে মদমুর্গির আড্ডাতেই হোক বা লেবুবাগানস্থিত বাংলা মদের ঠেক ও বেশ্যাপল্লীর ভিতর বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, বা কমলকুমার উদ্ধৃতাংশগুলো বাদ দিলে সবাই একই ভাষায় কথা বলে চললে সম্ভাবনার আদৌ সদগতি করা হয় না।
বঙ্কিমকে দিয়ে বেশ্যাখানায় ভয়্যারিজম করানোর কারণটা অবশ্য স্পষ্ট নয়। বাংলা সংস্কৃতির মহাপরিমণ্ডলে রিপ্রেসড ডিজায়ারের দায়ভাগ একা কেন বঙ্কিমকেই বইতে হবে, এটা স্পষ্ট নয়।
প্রীতিলতা ও সেই সংক্রান্ত নাশকতার উপাখ্যানে নবারুণ এসে উঁকি দেন। সমকালের প্রতর্ক থেকে নবারুণ নামক এই অত্যুজ্জ্বল আতসবাজি বাইরে রাখা মুশকিল। শেষ করার অন্য সম্ভাবনা ছিল না বুঝি? না ভেঙে, গড়ে তোলার দর্শন এখনো উজিয়ে উঠল না!
সাহিত্য ও সাহিত্য সম্পর্কিত লেখালিখি পড়তে ক্লিক করুন এখানে
তাই, খুব অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে ঋত্বিক-নবারুণ সংলাপের শেষ অংশটা।
ঋত্বিক: তাহলে কী দাঁড়াল? ইতিহাস তো আমাকে ভুল প্রমাণ করে ছাড়ল-----আমি ভেবেছিলাম, ভয়ঙ্কর ভাবেই ভেবেছিলাম নদী শুকিয়ে গেলেও সেখানে চর উঠবে---সেখানে ধানক্ষেত হবে। গ্রাম থেকে জেলে মালোরা হারিয়ে গেলেও সে জায়গায় চাষিরা আসবে। কিন্তু আদতে দেখা গেল সভ্যতা একটা জায়গায় গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলল---মানুষের বাচ্চাকে হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে একটা সময় সে ব্যাটাচ্ছেলে নিজেই হারিয়ে গেল।--------
নবারুণ: আসলে আমরা দুজনেই বোধহয় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে---আপনি একটা কাল্পনিক চরের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন----আমি কাল্পনিক ফ্যাতাড়ু চোক্তারদের ঠ্যাং ধরে ঝুলছি----
নিঃসন্দেহে ছাঁচ-ভাঙা আঙ্গিক। বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অতি সুন্দর পুনরুদ্ধার ও প্রয়োগ। যাঁরা ভাঙা-গড়ার খেলায় মেতে উঠতে রাজি, এবং গা ভাসাতে চান অস্তিত্বের গভীরে নিমজ্জিত এক যৌগিক প্রতর্কে, এ উপন্যাস তাঁদের পড়ে দেখা দরকার।
বঙ্কিমচন্দ্র
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
বৈভাষিক প্রকাশনী