Advertisment

ধুলামাটির বাউল: সন্মাত্রানন্দের জীবনপথ

সন্মাত্রানন্দের জীবন ও চলন নিয়ে আগ্রহের অন্ত নেই বহুজনের। তাঁর নানা রকম দেখা, দেখা থেকে তৈরি হওয়া দর্শন, টুকরো টুকরো করে তিনি লিখতে শুরু করলেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Dhula Matir Baul, Sanmatrananda

ছবি- মধুমন্তী চ্যাটার্জি, গ্রাফিক্স- অভিজিত বিশ্বাস

Advertisment

তার নাম ছিল মনুবাউলানি। আষাঢ়ী পূর্ণিমার মেলাফেরৎ সন্ধ্যাবেলায় সে আমাদের মাটির ঘরের জোছনাথইথই দাওয়ায় আয়েস করে পা ঝুলিয়ে বসে আমার দিকে চেয়ে আধোহেসে বলেছিল, ভাল মানুষের ছেলে! তুমি আমার বাউল হবে?

আমার তখন দশ-এগারো বছর বয়স। দুষ্টুমি করে তার চাঁদের মতন ছোট্টো কপাল আর নাকের উপর আঁকা রসকলির দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে বলেছিলাম, যদি হই... তবে তুমি আমায় কী দেবে?

সুরেলা কণ্ঠস্বরে হাসির ঢেউ মিশিয়ে দিয়ে বাউলানি উত্তর দিয়েছিল, স-ব দেব তোমাকে। আমার যা আছে।

তোমার কী আছে গো বাউলানি?

সে বলে চলে, গহিন গাঙের ঢেউ আছে, ভাঙা পথের ধুলো আছে, নীল আকাশের তারা আছে, মৌরি ফুলের সুবাস আছে, একতারার সুর আছে, নামের ঝুলি আছে, অচিনপুরীর মানুষ আছে...কত কী আছে। বলো, তুমি আমাকে ভালবাসবে? কথা দাও!

আরও পড়ুন, প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত

কথা দিয়েছিলাম। সে আমাকে এই পথের মন্ত্র দিয়ে হারিয়ে গেল কোথায়। আমি দেখলাম, ফসলের খেতের বুক চিরে যে লাল মাটির পথটা দিগন্তের দিকে চলে গেছে, বাবলার হলুদ ফুলে ভরা আনত শাখা থেকে ধুলার অঙ্গনে খেলা করতে নেমেছে খঞ্জন, সেই পথের ধুলা গায়ে মেখে বাউলানি চলে গেল তার খঞ্জনীতে সুর তুলে। অনেক দূরে যেখানে আকাশটা নীচু হয়ে চুম্বন করছে মাটিকে, যেখানে ঝাপসা হয়ে এসেছে নিসর্গের দৃশ্যাবলী, ধীরে ধীরে সেইখানে সে একটা অচিনে গাছের মতো মিলিয়ে গেল।

মনুবাউলানির কাছ হতেই আমি ঘর ছাড়ার মন্ত্র পেয়েছিলাম। তার পর থেকে পথে বিপথে সারা জীবন কতই যে ঘুরলাম, গায়ে মাখলাম কত দেশের ধুলারেণু, কত মানুষ আমাকে বুকে টেনে নিল, কত সুধারসে কানায় কানায় ভরে উঠল আমার জীবনের পাত্র, তার আর ইয়ত্তা নেই। ঘর বাঁধিনি কোথাও; পথেই চলি, ক্লান্ত হলে পথের পাশে ঝরাপাতার স্তূপের ভিতর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, চোখ বুজলেই মনের আলোছায়া-ক্যানভাসে ফুটে ওঠে কত মুখ, কত ছায়া, কত ছবি...কত বিচিত্র ভালবাসাবাসির উপাখ্যান...

এই তো সেদিন। মেদিনীপুর শহরের বাইরে আবাসগড়ের শালবনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটা মাজার। কাছেই গোরস্থান। দুপুরের রোদ ঝিমঝিম করছে। ক্লান্ত হয়ে সেই মাজারের বারান্দায় উঠে এলাম। কেউ কোত্থাও নেই। জলতেষ্টা পেয়েছে, জল নেই কাছে। বসে থাকতে থাকতে রোদ ঘুরে গেল। অতিদীর্ঘ শালগাছের ছায়া মাজারের সামনের খোলা প্রাঙ্গণে কবিতার যতিচিহ্নের মতো পড়ে আছে। অপরাহ্ণ আসছে। দুয়েকটা শালিখ নেমেছে কবরের উপর। ঘুমের ঝোঁক আসছে, এমন সময় কার যেন পায়ের শব্দে সেই তন্দ্রাবেশ কেটে গেল। চেয়ে দেখি, নানা রঙের তালি দেওয়া জোব্বা গায়ে এক ফকির-দরবেশ।

সে আমাকে সেলাম জানাতে আমিও প্রতিনমস্কার জানালাম। নাম-পরিচয় বিনিময় হল। ফকিরের নাম ফজর আলি। তার কাছে জল ছিল, চেয়ে খেলাম। তেষ্টা মিটল। আহ, শান্তি!

ফজর আলি আমার পাশে এসে বলল। সঙ্গের ঝুলি থেকে একটা ছোটো আরশি আর একটা কাঠের কাঁকুই বের করে লম্বা চুল-দাড়ি যত্নসহকারে আঁচড়াতে লাগল। তারপর শুধালো, কোথায় বাড়ি?

আমি বললাম, বাড়ি নেই। চব্বিশ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছি। এখন এই পথে পথেই...

ও আমারই মতো? তা বেশ, তা বেশ! তা মুর্শিদ কে?

মুর্শিদ মানে গুরু। হাত জড়ো করে প্রণাম জানিয়ে গুরুর নাম বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, আর আপনার?

আমার মুর্শিদের এন্তেকাল হয়েছে। তবে এখানেই আছেন। এই মাজারের পেছনেই শুয়ে আছেন।

কই আমাকে দেখাবেন?

দেখবেন? তবে আমার সঙ্গে আসুন।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না

আমাকে ফজর আলি মাজারের ভিতর দিয়ে নিয়ে গেল। সাদা চুনকাম করা সমাধিস্থল ধপধপ করছে। মাজারের অলিন্দে কবুতর গলা ফুলিয়ে ডাকছে। দুপুরের নীরবতা অন্তঃসত্তা নারীর মতো গভীর হয়ে আছে। মাজারের ভিতর দিয়ে গিয়ে আরেকটা দরোজা দিয়ে বেরিয়ে খোলা আকাশের নীচে বড় বড় সবুজ ঘাসের জঙ্গলের মাঝখানে  অলঙ্কৃত একটি কবরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে ফজর আলি বলল, মহম্মদ মুস্তাফা ফিরোজ!

এদিকে ওদিকে তাকাতেই ছোটো আরেকটি কবর চোখে পড়ল। আমি প্রশ্ন করলাম, আর উনি?

ফজর আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, সে অনেক কথা। এদিকে আসুন। একটু বসি।

মাজারের নিটাল নীরব বারান্দায় ফজর আলির মুখোমুখি হয়ে বসে আমি বললাম, বলুন।

ফজর বলল, আমার মুর্শিদ ফিরোজসাহেব আমারই মতন ফকির ছিলেন। আমার বাল্যকালেই আমার মা-বাবার এন্তেকাল হয়, আমি ছিলাম এতিম। এতিম বাচ্চাকে দুনিয়ায় কে আদর করে বলুন? চাচার সংসারে অযত্নে বড় হচ্ছিলাম। ফিরোজসাহেব আমার চাচাকে বলে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। রেখে দেন। ফকিরীর মন্ত্র দেন।

আপনারা থাকতেন কোথায়?

কোথায় আবার থাকব? আল্লাহর দুনিয়ায় আসমানের নীচে যেখানেই জমিন আছে, সেখানেই ফকিরের বাসস্থান। কখনও এখানে, কখনও ওখানে। আমার মুর্শিদ ফিরোজসাহেব বলতেন, ওরে বান্দা! দিলের ভিতর যদি মহব্বত থাকে, তবে ফকিরই আমির। তা মুর্শিদে-মুরিদে দিব্বি চলে যাচ্ছিল। আমাদের মধ্যে দমের সাধনা আছে, জানেন তো?

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমাদের প্রাণায়ামের মতো, না?

হ্যাঁ, ওইরকম। ওই সাধন-ভজন করি দুইজনে। কোনোদিন তিনি ভিক্ষায় যান তো কোনোদিন আমি। জলপড়া, তেলপড়া, কবচ-মাদুলি দিই। লোকে ভালবেসে দুটো খাবার, একটা পয়সা দেয়, দিন-গুজরান হয়ে যায়। কিন্তু সে সুখের কাল বেশীদিন আর চলল না।

কেন, কী হল?

কী আর হবে? পাঁচখুরির হাটে তেনার সঙ্গে দেখা হল ফিরোজসাহেবের।

তিনি কে?

তাঁর নাম সালমা। তিনিও এক ফকিরনি। দেখি, তাঁদের দুজনের খুব ভাব। ফকির-ফকিরনিতে কত কিসিমের যে আলাপ! আমি দূর থেকে দেখি আর খুব রাগ হয়। কিন্তু কিছু বলতেও পারি না। মুর্শিদ বলে কথা! তারপর তাঁকে নিয়ে ফিরোজসাহেব আবাসগড়ে এলেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে এলাম। মসজিদপট্টির খোলার ঘরে আমরা উঠেছি। ফকিরসাহেব আমাকে একদিন ডাকলেন -

কী বললেন?

বললেন, বান্দা রে! আমি তো সালমার আশিকীতে বাঁধা পড়েছি। ভাবছি, তাকে নিয়েই থাকব। তুই অন্য মুর্শিদ দেখ। আমি বললাম, তাই কখনও হয়? আমি আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাব? আর তাঁকে আমি আমার মা'জানের মতো দেখি। তবে এ মহল্লায় আপনাদের নিয়ে খুব কথা হচ্ছে। চলুন আমরা তিনজনে বহরমপুর চলে যাই।

ফকির কি সালমাকে সাদি করলেন নাকি?

আরে না, না। ওই একসঙ্গে ছিলেন। লোকে ভাবত, খসম-জরু। আর আমি ওই ফকিরি করে বেড়াতাম। মাঝেমাঝে তাঁদের কাছে আসতাম। মুর্শিদের উপদেশ নিতাম। একদিন ফকিরসাহেব ঘরে নেই, সালমা বিবি তাঁর কাজললতার মতো চোখ তুলে আমাকে বললেন, ও ফজর! ফিরোজ তোমাকে কী শিখায়?

আপনি কী বললেন?

আমি বললাম, দিল কীভাবে বেঁধে রাখতে হয়, আমার মুর্শিদ আমাকে তাই শিখায়। শুনে সালমাবিবি হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বললেন, আর তার নিজের দিল? তার নিজের মনই তো সে আমাকে দিয়েছে। আমিই তাকে বেঁধে রেখেছি। আমি বললাম, আমি একথা বিশ্বাস করি না। আপনি তাঁর সঙ্গে থাকতে পারেন, কিন্তু ফকিরসাহেব তাঁর নিজের মন বেঁধে রাখতে জানেন।

তখন?

সালমাবিবি খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর চোখে জল নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, ফজর! মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি তার দিলের হদিস পেয়েছি। কিন্তু তারপরেই তিনি কেমন যেন আনমনা হয়ে যান। আমাকে এত ভালবাসেন, তবু তার দিলের নাগাল আমি পেলাম না। তুমি ছেলেমানুষ ফজর, আমাকে মায়ের মতো দেখো, তোমাকে কী আর বলব? আমি তাঁকে কত কথা বলি, কতোরকম যে করি। তিনি কিন্তু চোখ বুজে নিজের মনে বলতে থাকেন, রোব্বে জিদনে ইলমা...রোব্বে জিদনে ইলমা...

কথার মাঝখানে আমি জিজ্ঞেস করলাম, এর মানে কী, ফজরভাই?

ফজর আলি বলল, ও আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার মন্ত্র। সালমাবিবি যখনই ফকিরসাহেবের বুকে আশিকীর তুফান তুলত, তখনই নিজেকে সামলানোর জন্য ফকিরসাহেব এই মন্ত্র স্মরণ করতেন।

তবে কি তাঁদের মধ্যে ভালবাসা ছিল না?

খুব ছিল। কিন্তু সে তাঁদের বেহেস্তের প্যার। ভালবাসলেও ফকিরসাহেব শরীরের চোরাটানে ভেসে যাননি, মনে হয় আমার। সে যাই হোক, পরে আবার দুজনেই এই আবাসগড়ে ফিরে এসেছিলেন। আমি রয়ে গেছিলাম বহরমপুরেই। তাঁরা তখন বুড়ো হয়েছেন। কয়েকবছর পর একদিন শুনলাম, ফকিরসাহেবের এন্তেকাল হয়েছে। খবর পেয়ে আমি বহরমপুর থেকে এখানে তখনই চলে এলাম। দেখলাম, সালমাবিবি অন্নজল ত্যাগ করেছেন। তিনদিন পর তিনিও গেলেন। ফকিরসাহেবের কবরের পাশে ওই যে ছোটো কবর দেখছেন, ও কবর সালমাবিবির কবর।

ফজর আলি চুপ করে গেল। আমিও কথা বলছিলাম না। বারান্দার ভিতর যেন ঝুপ করে নেমেছে গভীর নিস্তব্ধতা।

একটু পরে নীরবতা ভেঙে উঠে দাঁড়িয়ে ফজর বলল, যাই এখন। আমাকে আবার আজ মির্জাবাজার যেতে হবে।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে... ফজর আলি চলে গেছে কতক্ষণ। আমিও যাব। যাবার আগে আরেকবার ফকির-ফকিরনির কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম...

অস্পষ্ট অন্ধকার ভেঙে মায়াবী জ্যোৎস্না উঠছে। উদাসীন বাতাস বহে যায়। কতগুলো বুনোফুল দুজনের নির্জন কবরের উপর ছড়িয়ে দিতে দিতে মনে হল, সালমা বিবি একপাশে কাত হয়ে শুয়ে তাঁর সুরমা-পরা চোখদুটি তুলে ফকিরসাহেবের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছেন। আর ফকিরসাহেব চোখ বুজে অস্ফুট স্বরে নিজের মনে বলে চলেছেন, রোব্বে জিদনে ইলমা...রোব্বে জিদনে ইলমা...

dhula matir baul
Advertisment