নদীজলে দাঁড় টানার ‘চোল্ চোল্’ শব্দ উঠছিল। সবেমাত্র কুয়াশা কেটে সকালের রোদ দেখা দিয়েছে। শীতকাল। কবোষ্ণ সূর্যের আমেজ গায়ে মেখে নৌকার পাটাতনে বসে ওই দূরের তীররেখার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
নৌকা আরও একটু এগোতে জলছবির মতো ফুটে উঠল পরপার। সবুজ বনঝোপে ঘেরা সিঁদুরমাটির গ্রাম প্রসাদপুর। যেতে হবে ওখানেই বিশেষ একটা কাজে।
করোনাভাইরাস ও রবীন্দ্রনাথ (রোদ্দুর রায় ছাড়া)
মিনিট দশেক পর নৌকা তীরে এসে লাগল। মাঝি কাঠের তক্তা পেতে দিল নৌকা থেকে পাড়ের উপর। তক্তায় পা রেখে সাবধানে পাড়ে উঠে এলাম।
দুপাশে পাকুড় আর হিজল গাছের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা ধুলার পথ। এই পথ গিয়েছে গ্রামের দিকে। কোথাও বা চাষের ক্ষেত। শীতের রুক্ষতা এখন মাঠময়। কোথাও ধান আছে, কোথাও মিষ্টি আলু, কোথাও বা কিছুই নেই—ফাঁকা। কেবল ধানের নাড়া পড়ে আছে। মাকড়সার জাল শেষ শীতের শিশির মেখে রোদের আলোয় ঝলমল করছে।
অবশেষে হলুদ ফুলে ভরা সর্ষে ক্ষেতের ধারে ঘুমন্ত গ্রামটি এসে পড়ল। ছাড়া ছাড়া কতগুলি ঘর। খড়ের চাল, টিনের চাল, টালির চাল। প্রায় সব ঘরই মাটির। একজন শীর্ণকায় লোক—কোমরে একফালি কাপড়, মাথায় একটা ভেজা গামছা, হাতে একটা ছিপ—এদিকেই আসছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শীতল মণ্ডলের ঘর কোনখানে?’
সে বলল, ‘আরেকটু এগিয়ে পাঁচপোতার পুকুর পড়বে, তারই পূর্বদিকে শ্যাতলা মণ্ডল থাকে।’
আমি লোকটির কথামতো কিছুদূর হেঁটে একটি মজা পুকুর পেলাম। এইটিই তাহলে হবে পাঁচপোতার পুকুর। এখন পূর্বদিকটা কোন দিক? খানিক ভেবেচিন্তে ঠাহর করতে পারলাম। একখানি খোড়োঘর মেহেন্দির বেড়া দেওয়া। আগড়ের কাছে দাঁড়িয়ে গলা তুলে বললাম, ‘বাড়িতে কে আছেন?’
—কে বট-অ?
—আজ্ঞে, আমি শহর থেকে আসছি। এখানে কি শীতল মণ্ডল থাকেন?
আগড় ঠেলে পরনে লুঙ্গি, খালি গা একজন বছর ষাটেকের লোক বেরিয়ে এসে বলল, ‘আমিই শেতল। তা আমাকে খোঁজখবর কচ্চেন ক্যানে এজ্ঞে?’
—নমস্কার। আপনার ভাইপো দিবাকর আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে। দিবাকর আমার বন্ধু।
লোকটি আমাকে আপাদমস্তক দেখে বলল, ‘অ। দ্যাবাকর পেটিয়েচে? ভিতরে এসে বসুন না ক্যানে। অ ভুচু- উ-উ, দ্যাবাকরের বন্দু এয়েচে। পিঁড়া দে। আর দ্যাক্, ঘরে জলবাতাসা আচে নাকি রে?’
রঙজ্বলা ম্যাক্সিপরা একটি বছর একুশের মেয়ে একটা পিঁড়ি নিয়ে এসে দাওয়ার উপর রেখে চট করে ভেতরে চলে গেল। আমি উঠানের চালতেগাছ, তুলসীমঞ্চ পার হয়ে দাওয়ায় এসে বসলাম। শীতল মণ্ডল বাঁশের খুঁটিটি ধরে দাঁড়িয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করছে মনোযোগ সহকারে। চালতেগাছের ডালের ফাঁকে কী একটা লেজঝোলা পাখি চিড়িক চিড়িক করে ডাকছে।
ভুচু নামের মেয়েটি আবার তড়িঘড়ি একটি রেকাবিতে করে বাতাসা, নারকেল কোরা, সত্যনারায়ণের সিরনি আর একটা ফুলকাটা কাঁচের গেলাসে জল নিয়ে এসে আমার সামনে ধরল। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই সে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।
—তা বলুন এজ্ঞে কী উদ্দেশ্যে আগমন?
—দিবাকর বলল, আপনার যা যা কাগজপত্র আছে, সব আমার হাতে দিতে। বলল, আপনি সব জানেন।
‘কী কাগজ?’-লোকটির চোখে সতর্ক সন্দিগ্ধ দৃষ্টি।
—এই আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, জমির দলিল দস্তাবেজ...। শহরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে সব ঠিকঠাক আছে কিনা। জানেন তো, নতুন নিয়ম পাস হয়েছে...
—জানি, জানি। গেরামে পড়ে থাকলেও ইসব জানতে আমাদের বাকি নাই। দ্যাবাকর চেয়েচে, নে যান। তবে তিনপুরুষ এই গেরামে এই ভিটায় বাস কচ্চি। অ্যাতোদিনে সরকারবাহাদুরের খ্যাল হল, ইখানকার লোক আমি, নাকি উড়ে এসে জুড়ে বসিচি! বলিহারি যাই! নে যান, কাগজ নে যান। আমি মুড়োবন্দী করেই সব রেকিচি। দ্যাবাকর বলিচিল লোক পাটাবে। তাই আপনাকে পেটিয়েচে। দাঁড়ান, একটু বসুন।
শীতল মণ্ডল ঘরে ঢুকে কয়েক মিনিট খোঁজাখুঁজির পর একটা পলিথিনের প্যাকেট বের করে এনে আমার হাতে দিল। বলল, ‘সব দেকে নিন এজ্ঞে। ঠিকঠাক দিইচি কিনা। পরে বলতে পারবেন না, শ্যাতলা মণ্ডল কাগজ দ্যায়নি।’
আমি দেখে নিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে। সবই আছে। দিবাকরকে আজকে সন্ধেয় ফিরে গিয়েই দেব। আচ্ছা, আসি তাহলে?’
—উঁহুহুহু! উটি হবার লয়। অতিথ মানুষ মুকে অন্নজল না দিয়েই যাবেন? সি হবে না। চান করুন, দুটিকিচু মুকে দ্যান, বিশ্রাম করুন, গেরাম দ্যাখেন, তারপর বিকালবেলায় পাঁচটার খেয়া ধরে ঘরের ছেল্যা ঘরকে ফিরবেন।
শীতল মণ্ডলের ঘরের ভিতর মোবাইলের টাওয়ার পাচ্ছিলাম না। মেহেন্দির বেড়া পার হয়ে এসে পাঁচপোতার পুকুরের ধারে টাওয়ার পেলাম। দিবাকরকে বললাম, ‘কাজ হয়ে গেছে রে। কিন্তু তোর কাকা এবেলা ছাড়বে না। বিকেলে নদী পার হয়ে বাস ধরব।... আরে, আজই রাতে ফিরে কাল সকালে তোকে কাগজপত্র দিয়ে আসব... কী বললি? তুই এখন অফিসে? আচ্ছা, পরে কথা হবে যদি টাওয়ার পাই... রাখি?’
ভুচু একটা গামছা আর একটা বাটিতে করে সর্ষের তেল দিল। রোদে বসে তেল মেখে পাঁচপোতার পুকুরে চান সারলাম। দুপুরে শীতল মণ্ডলের ঘরের দাওয়ায় আমার আর শীতল বুড়োর পাত পড়ল। ভাত, গন্ধরাজ লেবু, নিমপাতা ভাজা, সজনে ফুলের তরকারি, মুসুর ডাল আর ট্যাংরা মাছের ঝাল। ভুচু পরিবেশন করছিল। খেতে খেতে অনেক কথা হচ্ছিল বুড়োর সঙ্গে। বুড়োই বলছিল বেশি। আমি কম।
‘এই যে ভুচু, ওর ভালো নাম ঈশানী। ওর মা এই নাম রেখেছিল। তা মা মরে গ্যালো মেয়াঁর ছ্যানাবেলায়। মেয়াঁটার কপাল পুড়া। ল্যাকাপড়া করলনি। বুদ্দি নাই। বিয়া দিলাম, বচর ঘুরতে না ঘুরতে ব্যাধবা হয়ে ঘরে ঢুকল। অ্যাকন দ্যাবাকর বলচে, আবার বিয়া দাও। তা লয় দিলাম। যুদিও কাজটা সুজা লয়। তবু লয় দিলাম। কিন্তু কপাল না খুললে হবেটা কী? হবে এই হঁপা!’—এই কথা বলে শীতল মণ্ডল বুড়ো আঙ্গুল দেখালো।
আমার ভারি খারাপ লাগল। এত অল্প বয়সে মেয়েটি বিধবা হয়েছে। বাপের ঘর সামলাচ্ছে অক্লান্ত পরিশ্রম করে। তার ভাগ্যে কিছু নেই, একথা জানছে কী করে বুড়ো? এই ভাগ্য, দৈব আর নিয়তির জেরে কুসংস্কারাচ্ছন্ন গাঁঘরের মানুষগুলো আমাদের দেশে শেষ হয়ে গেছে। শিক্ষা নেই, দীক্ষা নেই, সহায়সম্বল, বাস্তববুদ্ধি কিচ্ছু নেই। অথচ সরল, আন্তরিক, অতিথিবৎসল এরা। কথাগুলো বলছিল যখন বুড়ো, ভুচু মুখ কালো করে ঘরের ভিতর চলে গেল।
খেয়েদেয়ে একটু গড়িয়ে নিলাম। দাওয়ায় মাদুর, বালিশ দিয়েছিল ভুচু। শুয়ে শুয়ে দেখছি, বেলা পড়ে আসছে। ঘরের ভিতর খাটে শীতল মণ্ডল ঘুমোচ্ছে। তার নিঃশ্বাসের শব্দ। চালতের ফলের উপর সাদা ডানা কালো ছিট ছিট প্রজাপতি উড়ে উড়ে এসে বসছে। রান্নাঘরে খাওয়া সাঙ্গ করে এঁটো বাসনপত্তর নিয়ে ভুচু গেল পাঁচপোতার পুকুরে বাসন মাজতে। ভাবলাম, একটু উঠে গ্রাম ঘুরে আসি।
দুপাশে নিমগাছের সারি, নিমফুলের রেণু ছড়ানো মাটির রাস্তা। একটি ক্লাবঘর, সামনে সাইনবোর্ড টাঙানো—‘নবীন সঙ্ঘ’। কদম গাছ। দুয়েকটা পুকুর। খড়ের চাল, টিনের চাল। অন্ধকার বাঁশবন। কালীমন্দির। সামনে একটা আটচালা। শীতলা মন্দির। বড়ো একটা দীঘি। টানা বারান্দা সমন্বিত একটি ইস্কুল। আজ রবিবার, তাই বন্ধ আছে। কতগুলো দোকানঘর। কোনোটায় ঝাঁপ নামানো। কোনোটা বা খোলা। মাটির কলসির উপর ডুমো ডুমো নীল মাছি ঢনঢন করছে। একটা মিষ্টির দোকানে বড়ো কাঠের বারকোসে একজন মোটাসোটা লোক অনেক কসরৎ করে ময়দা মাখছে। আরেকটা বাচ্চা ছেলে ভেজা কাপড়ে বাঁধা ময়দার ভার নিয়ে এসে লোকটার পেছনে উনুনের ধারে রাখল।
হাঁটতে হাঁটতে চাষের ক্ষেতের ধারে নয়নতারার জঙ্গল পেরিয়ে একটা আমগাছের নীচে শুকনো পাতাখড় জুটিয়ে আধশোয়া হয়ে বসেছিলাম। এখান থেকে নদী বেশ দেখা যায়। একটা নৌকা ওই তীরে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে স্রোত কেটে, দেখলাম।
শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লা যেদিন হেরে যান, এ গ্রাম সেদিনও এমনই ছিল। যেদিন ভাস্কর পণ্ডিতের মারাঠি বর্গী সেনার দল গঙ্গাতীরবর্তী গ্রামগুলিকে তছনছ করছিল, সেদিনও গঙ্গা থেকে অনেক দূরের এই লালমাটির গ্রাম নদীর পাড়ে অলস তন্দ্রাভরে ঝিমোচ্ছিল। যেদিন তুর্কীদের আক্রমণে রাজা লক্ষণ সেন গৌড় বঙ্গের সিংহাসন ফেলে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেদিনও এ গ্রামের শান্তির ঘুম ভাঙেনি। তারও আগে যেদিন টিলার উপর পাতার কুটিরে বসে শবরপাদ চর্যাগীতি লিখছিলেন তাঁর প্রিয়া নৈরামণিকে বুকে ধরে কিংবা সেইদিন, যেদিন প্রভাতবেলায় অতীশ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন বিক্রমশীল বিহার থেকে সুদুর্গম পথ বেয়ে তিব্বতের উদ্দেশে, সেদিন সেই সময় এ গ্রাম হয়ত ছিল না। এখানে শুধু বনভূমি ছিল। সেই নির্জন অরণ্য থেকে দাঁতাল হাতির পাল হয়ত ওই নদীতে নামত স্নান সেরে নিতে। কতোদিন আগের কথা সেসব কেউ জানে না...ওই দূরের আকাশটা তবু দেখেছে সব... সেদিনের হস্তীযূথের জলক্রীড়ার আনন্দ থেকে আজকের শীতল মণ্ডল আর তার মেয়ে বুঁচুর জীবনের দুঃখসন্তাপ পর্যন্ত সব—স-অ-ব! মূক আকাশ তবু জানাতে পারে না কিছুই আমাদের। ভাগ্যিস জানাতে পারে না! জানাতে পারে না বলেই তো অপরিজ্ঞাত ইতিহাসের সেই অন্ধকার সমুদ্রের ভিতর থেকে সৃজনশীল কল্পনা তার আলো ফেলে ফেলে মননের মুক্তা তুলে আনতে পারে...
রোদ পড়ে এলে বিকেলের দিকে খেয়া ধরে সেদিন প্রসাদপুর থেকে ফিরে এসেছিলাম।
এই সিরিজের সব লেখা একত্রে