শিবাংশু দে
‘‘... রেখতা কে তুমহি উস্তাদ নহি হো ‘গালিব’,
কহতে হ্যাঁয় অগলে জমানে মেঁ কোই ‘মীর’ ভী থা।’’
(মির্জা গালিব)
বছর চল্লিশ হল। সারারাতের অনুষ্ঠান মিলনী'তে। রাজন-সাজন তখন সদ্য আলোকিত হচ্ছেন। শেষরাতের দিকে আভোগী-কানাড়া শেষ করলেন রোয়াবের সঙ্গে। ঠুমরি দিয়ে শেষ করবেন। ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তেমনই। হঠাৎ একজন অতি উৎসাহী শ্রোতা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘পণ্ডিতজি, এক গজল হো জায়’’! হাতের স্বরমণ্ডলটি থামিয়ে স্মিত হেসে রাজনজি বললেন, ‘‘হম গজল আদি গানা নহি গাতে হ্যাঁয়। উওহ হমারে সঙ্গীত বিরাসত মেঁ নহি আতা। এক টুটাফুটা আসাওয়রি পেশ করতা হুঁ আপকে খাতির। হমেঁ উতনা হি আতা হ্যাঁয়।’’
সময়টা সাতের দশকের শুরুর দিক। বম্বের তলপেট থেকে ক্রমাগত মন্থিত হচ্ছে একের পর এক ‘মসালা’ ফিল্ম। মঞ্চ থেকে সরে গেছেন অনিল বিশ্বাস, নৌশাদ আলি, রোশনলাল নাগরথ, মদনমোহন কোহলি, ওমকারপ্রসাদ ন্যইয়র, হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায়, শংকর জয়কিশন, রামচন্দ্র চিতলকর, বক্স-অফিস কাঁপানো নাম সব। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন সলিল চৌধুরী, শচীন দেববর্মণ, রবিশঙ্কর শর্মা, মহম্মদ জহুর খ্যইয়াম, আরো অনেকে। পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, খেমচাঁদ প্রকাশের তৈরি করা প্লেব্যাক গানের মডেলটা এঁদের হাতে বদলে গিয়েছিলো অনেকটাই। কিন্তু ভিত্তিটি মোটামুটি একই ছিলো। মেলোডির চূড়ান্ত মহিমা। গড়নটির মধ্যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আসাযাওয়া করে মতলা, রদীফ, কাফিয়া, কসীদার নির্ধারিত ছাঁচটি। অর্থাৎ দিনের শেষে গজলই রাজা। মুম্বাইগানের প্রথম সুপারস্টার কুন্দনলাল সায়গল নিজে আশিরনখর গজলিয়া। রবীন্দ্রসঙ্গীতও গা’ন যখন, গজলের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে গানে গানে। অন্তত চারদশক জুড়ে শ্রোতার কান তৈরি হয়েছে এইসব কম্পোজিশন শুনে। ভারতীয় গান মানেই মেলোডির শেষ কথা। যদিও এই ঐতিহ্যটি প্রায় হাজার বছরের পুরোনো, কিন্তু রূপান্তরিত হয়েছে বিচিত্রভাবে। গোটা নির্মাণটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে একধরনের নিমীলিত সামন্ততন্ত্রী ফুরিয়ে যাওয়া সুবাস। জানি, থাকবে না শেষপর্যন্ত। কিন্তু তাকে ছেড়েও দেওয়া যাচ্ছেনা। গানের ক্ষুধাতৃষ্ণা মেটানোর জন্য আম-আদমির সম্বল বোম্বাই গানা। দিনের পর দিন বেড়ে ওঠা মারধাড়, অ্যাকশন ফিল্মি পরিসরে গজলের আর জায়গা নেই। খিদে আছে, জোগানও আছে। কিন্তু থালা নেই। ভারতীয় গজল নামক গীতধারাটি এইসময় সমান্তরাল গতিপথ খুঁজে নিতে বাধ্য হল।
আদি গজল কিন্তু এদেশি গীতধারা নয়। দশম শতক নাগাদ ইরানে তার প্রথম খবর পাওয়া যায়। অবশ্য শিকড়টা ইরানেও নয়, ছিলো আরবদেশে। সেখানে ‘কসীদাহ’ নামক একধরনের রাজস্তুতির ধারা ছিলো। ইরানে এসে কসীদাহ’র বিবর্তন শুরু হয়। ইসলামপূর্ব কাল থেকেই কসীদাহ গাওয়া হতো। কসীদাহ’র তিনটি প্রকার আছে। নসীব, রহীল আর বিবিধ শৈলী, যেমন ফখ্র, হিজা বা হিকম। নসীব অংশটিই পরবর্তীকালে গজল নামের একটি পৃথক গীতধারা হয়ে যায়। নবম শতকের এক কবি ইবন কুতয়বাহ রীতিমতো নস্টালজিক হয়ে বলেছিলেন, কবিরা বিশ্বাস করেন কসীদাহ শুরু হবে তাঁদের একান্ত আশ্রয়, তাঁদের পিতৃভূমির কথা স্মরণ করে। ফেলে আসা জন্মভূমি, বিদায় নেওয়া স্বজন সবার স্মৃতি যখন তাঁকে কাতর করবে, তখনই তা কসীদাহ’য় রূপ পাবে। কবির ফেলে আসা স্বভূমি, স্বজনের প্রতি আবেগ বদলে গেলো দয়িতার প্রতি ভালোবাসায়। কারণ ঈশ্বর আশা করেন নারীর প্রতি পুরুষের এই প্রেমই শেষে রূপ পাবে ঈশ্বরপ্রেমে। তার নির্যাস ধরা থাকবে কসীদাহ’র নসীব অংশের শব্দবিন্যাসে। রহীল হল যাত্রাপথের প্রেমসঙ্গীত। এই সব মিলিয়ে গজল শুধু মাত্র মানুষী প্রেমগাথা নয়। তার অধ্যাত্মবিন্যাসটি লক্ষ্য করার মতো। যেন বঙ্গীয়কবির বৈষ্ণবকবিতার সারাৎসার। রহীল হল যাত্রাপথের প্রেমসঙ্গীত।
ইবন কুতয়বাহই প্রথম কসীদাহর একটা দার্শনিক ব্যাখ্যা দেবার প্রয়াস করেছিলেন। যদিও গজলের পরম্পরা শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রাক-ইসলামি পর্বে। সপ্তম শতকেই উম্মায়দ যুগে আরবদেশে এর সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা বিকশিত হয় অব্বাসিদ যুগে। এই সময় থেকেই গজলের মূলছাঁচটি মোটামুটি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। যুগলপংক্তি, যা আরবি ভাষায় বয়েৎ এবং ফার্সিতে শ্যের, তা একক অনুভব বা ইউরোপিয় মিটারের ধারাটিই অনুসরণ করেছে।
আরবি গজলের কয়েকটি প্রকার রয়েছে। একটি হলো ‘উধারী’। যেখানে অপূর্ণ প্রেমের কথা লেখা হয়। অন্যদিকে ‘হিসসি’, যার উপজীব্য ছিল শারীরপ্রেম। তৃতীয় প্রকারটি ‘তমহীদী’ বা প্রচলিত গজলের উপক্রমণিকা হিসেবে লেখা হত। গজলের এ জাতীয় অতি পরিশীলিত গঠনটি কিন্তু প্রাক-ইসলামি যুগেই রূপায়িত হয়ে যায়।
পারস্য সভ্যতা যখন প্রথম আরব সভ্যতার সংস্পর্শে আসে, আরবি গজল ছিল ফার্সি কবিতার প্রথম অবলম্বন। তার নিজস্বতা তৈরি হয়নি তখনও। ভাষাটি ফারসি হলেও রচনাগুলি ছিল বস্তুত আরবি। কিন্তু পরবর্তীকালে ফার্সিভাষাই গজলের মূল ধারক ও বাহক হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশে গজল এসে পৌঁছয় বারোশতকে ইসলাম প্রবেশের সঙ্গে। সুলতানি সংস্কৃতি ও সুফিসাধকদের হাত ধরে। হিন্দুস্তানি গজল প্রথম থেকেই ফার্সি ভাষানির্ভর। আরবি গজল থেকে ফার্সি গজল তিন-চারশো বছরে আমূল বিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষে আসার সময়ই ফারসি গজলে বিষয়, বিন্যাস, আঙ্গিক ও প্রকাশ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিপুণ পরিশীলনের চর্চা স্পষ্ট। বারো শতক থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত আমাদের দেশে গজলের বিবর্তন অব্যাহত ছিল।
আরও পড়ুন, সাদাত হাসান মান্টোর গল্প: লাইসেন্স
গজল শৈলীর কয়েকটা অঙ্গ আছে। ন্যূনতম পাঁচ আর অধিকতম পনেরটি স্তবকের মধ্যে বেঁধে রাখা হয় তার শরীর। সাধারণভাবে সাতটি স্তবকই প্রচলিত পন্থা। প্রতিটি স্তবকই স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু সবগুলি মিলে একটি কেন্দ্রীয় ভাবই প্রকাশ করে। তবে পর পর স্তবক সাজান থাকলেই তা গজল হয়ে যায়না। গজলের কিছু নিজস্ব নিয়ম রয়েছে। প্রথম স্তবকটিকে বলে ‘মতলা’। গজলের মূলভাবটি মতলার মধ্যেই ধরা থাকে। বাকি স্তবকগুলি তাকেই অনুসরণ করে। শেষ স্তবকটির নাম মকতা। সেখানেই তখল্লুস বা কবির কাব্যিক নামটি উল্লেখিত থাকে। এছাড়া থাকে ছন্দ ও মিলের দুটি জরুরি কৌশল। নাম রদীফ আর কাফিয়া। গালিবের একটা অতি প্রচলিত গজলকে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।
‘‘হাজারোঁ খ্বাহিশেঁ অ্যায়সী কি হর খ্বাহিশ পে দম নিকলে ।
বহুত নিকলে মেরে অর্মান লেকিন ফির ভী কম নিকলে ।।’’
এই শ্যেরটি গজলের মতলা। এখানে ‘নিকলে’ শব্দটি রদীফ এবং ‘দম’ ও ‘কম’ শব্দদুটি কাফিয়া।
মাঝখানের একটি স্তবক পড়া যাক,
‘‘নিকলনা খুদ সে আদম কা সুনতে আয়ে থে লেকিন।
বহুত বে-আবরু হোকর তেরে কুচে সে হম নিকলে।।’’
লক্ষ্যণীয়, কাফিয়া ‘হম’ আর রদীফ ‘নিকলে’ পুনরাবৃত্ত হয়েছে।
শেষ স্তবক বা মকতাটি এরকম,
‘‘কহাঁ ময়খানে কা দরওয়াজা ‘গালিব’ অউর কহাঁ ওয়াইজ।
পর ইতনা জানতে হ্যাঁয় কল উওহ জাতা থা কে হম নিকলে ।।’’
এখানে তখল্লুস, রদীফ ও কাফিয়া, তিনটি লক্ষণই দেখা যাবে।
এদেশের নিজস্ব গজল শৈলী প্রবর্তনের ক্ষেত্রে আমির খুসরুর নাম আসে। আসলে এই নামটি মধ্যযুগ থেকে ভারতের সঙ্গীতসংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনায় শীর্ষস্থানে দেখা যায়। মনে হয় আমির খুসরু আসলে কোনও ব্যক্তিনাম নয়। এটি একটি প্রতীকের নাম হতে পারে। সত্য যাই হোক, তাঁর নাম নিয়ে ভারতীয় সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যে অসংখ্য তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। গজলও তাঁর অভিনিবেশ পেয়েছিল। এদেশে যখন গজল প্রথম আসে, তখন তা একান্তভাবে ফার্সিভাষার অনুগত ছিল। কিন্তু তেরো-চোদ্দ শতকে সুলতানি আমলে দিল্লিকেন্দ্রিক লোকভাষা দেহলভিতে তুর্কি, আরবি, ফার্সি শব্দসমূহ অবারিতভাবে এসে যায়। ক্রমশ তার সঙ্গে আরও লোকভাষা যেমন হিন্দভি, গুজরি, দক্কনি, রেখতা ইত্যাদি ভাষা মিলে উত্তরভারতের প্রধান দুটি ভারতীয় ভাষা হিন্দি ও উর্দুর ক্রমবিকাশ হয়। আঠার শতক পর্যন্ত দিল্লির স্থানীয় ভাষাটিকে ‘হিন্দি’ বলা হত না। তার নাম ছিল ‘রেখতা’। মীর তকী মীর পর্যন্ত এই ভাষাটিকে রেখতা'ই বলেছেন। মজার কথা, পরবর্তীকালে যে উর্দু গজল উত্তরভারতের একটি প্রধান গীতধারা হয়ে উঠেছিল তার উন্মেষ কিন্তু দিল্লিতে নয়, হয়েছিলো গোলকোণ্ডায় কুলি কুতব শাহের পোষকতায় ষোল শতকে।
প্রথম থেকেই, আমাদের দেশে শ্যায়রি, মানে গজলের মূল এককের তিনটি প্রধান ধারা সমান্তরাল বেড়ে উঠেছিল। দক্কন, দেহলি আর লখনউ। অষ্টাদশ শতকে শ্যায়রির মাঠে দুজন সুপারস্টার অবতীর্ণ হলেন। মীর তকী মীর আর মির্জা আসাদুদ্দিন খান ‘গালিব’। শ্যায়রি, বৃহদর্থে গজল, আর একরকম থাকল না।এইসময় বেশ কিছু দিগগজ কবিও আসরে নেমে পড়লেন। যাঁদের মধ্যে গজলের বাদশা ছিলেন দেহলি'র মির্জা মহম্মদ রফি ‘সউদা’, খ্বাজা মীর ‘দর্দ’, নওয়াব মির্জা খান ‘দাঘ’। নাদির শাহ দিল্লি ধ্বংস করার পর শ্যায়রদের আস্তানা হয়ে দাঁড়াল লখনউ। ঘুলাম হমদানি ‘মুশাফি’, ইনশাল্লাহ খান ‘ইনশা’, খ্বাজা হায়দর আলি ‘আতিশ’, ইমাম বখস ‘নাসিখ’, মির বাবর আলি ‘অনিস’, মির্জা সলামত আলি ‘দবির’ প্রভৃতি শীর্ষস্থানীয় কবিরা অওয়ধের নবাবের আশ্রয়ে শরণ নিলেন। এই সময় থেকেই লখনউয়ের গজল ধীরে ধীরে দিল্লির গজলের গরিমা ম্লান করে দিতে শুরু করেছিল। যদিও এই সব কবিই গজল রচনা করেছেন, কিন্তু গজলের দেবতা ছিলেন মীর আর গালিব। এঁদের সময় অবশ্য গজলকে সাধারণভাবে ‘রেখতা’ই বলা হত। এঁরা দুজন ছাড়া বাকি নক্ষত্ররা ছিলেন, ‘মোমিন’, ‘জওক’, ‘ওয়ালি’, ‘হালি’, ‘হসরত’। পরবর্তীকালে গজলকে কাব্যধারার এক শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছিলেন ‘জিগর’, ‘ফিরাক’, ‘ফানি’, ‘ফয়েজ’, ‘কাজমি’, ‘সাহির’, ‘আজমি’, ‘ইকবাল’, ‘মুরাদাবাদি’, মখদুম মহিউদ্দিন, জান নিসার অখতার, ‘মজরুহ’, ‘রজা’ আরো অনেকে। অনেকে গজল পড়ার আগে তখল্লুসটা দেখে নিতে চান। কিন্তু গজলের মজা তার মতলায়। অনেক তথাকথিত অল্পখ্যাত শ্যায়রও স্ফুলিঙ্গের মতো মতলা, রদীফ, কাফিয়া শুনিয়ে দিয়ে যান, ভিতরের বারুদ তৈরি থাকলে চকিতে ছড়িয়ে যায় আগুন।
আরও পড়ুন, প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস ও এক বিস্মৃত বই
আগে শ্যায়র নিজেই নিজের লেখা গজল আসরে বা মুশায়রায় গেয়ে শোনাতেন। তবে স্বাধীন গীতশৈলী হিসেবে গজল বিকশিত হতে শুরু করে তওয়াইফদের দৌলতে। দিল্লি, লখনউ বা দক্কনের সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সম্পন্ন, অর্থশালী মানুষদের বিনোদনের একটা প্রধান বিকল্প হিসেবে কোঠেওয়ালি তওয়াইফদের কণ্ঠে গজল গান দ্রুত লোকপ্রিয়তা অর্জন করে। সংযোগবশত দিল্লি এবং লখনউয়ের অভিজাত সমাজে খোদ বাদশাহ এবং নওয়াব দুজনেই নিজেরা গজলস্রষ্টা ছিলেন। তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গুণিজনদের আদর ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই রকম অনুকূল পরিবেশে স্বাভাবিকভাবেই রচনা ও গায়নের ক্ষেত্রে গজলের উৎকর্ষ বিশেষ ভাবে বিকশিত হয়। তওয়াইফরা সচরাচর প্রতিষ্ঠিত উস্তাদদের থেকে তালিম নিতেন। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শ্রমসাপেক্ষ অনুশীলন করাটা আবশ্যিক ছিল। ফলে গজল গায়নের শৈলী ক্রমশ ঠুমরির মতো একটা উপশাস্ত্রীয় চেহারা নিতে শুরু করে। তওয়াইফদের সঙ্গে সমান্তরালভাবে দীক্ষিত কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যেও গজল গাওয়ার রীতি শুরু হয় উনিশ শতকের একেবারে শেষদিক থেকে। উপযুক্তভাবে শিক্ষিত ও সাধিত শিল্পীরা যখন গজল গাইতে শুরু করেন তখন থেকে ‘সঙ্গীত’ হিসেবে গজলের একটা ভিন্ন ধারা বিকশিত হয়। সেই গানগুলির সুরকার ও গায়ক হতেন আলাদা মানুষ। শ্যায়ররা শুধুমাত্র লিখেই খালাস। যদিও বিভিন্ন আসরে তাঁরা নিজের গজল গেয়ে শোনাতেন, কিন্তু তা দীক্ষিত গায়কদের মত সম্পন্ন বা শ্রুতিমধুর হয়ে উঠত না।
নওয়াব-বাদশাহ, আমির-উমরাহদের দহলিজ, নাচঘরে সর্বদা প্রতিধ্বনিত গজল সাধারণ শ্রোতাদের নাগালের বাইরে ছিল। গ্রামোফোন কোম্পানি এসে আম আদমিদের বৈঠকখানায় গজলকে পৌঁছে দিয়েছিল বিশ শতকের গোড়ার দিকে। লোকে নানা সূত্রে এই ধারার গানের কথা শুনেছিল। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রোতাদের তওয়াইফ বা খানদানি উস্তাদদের কাছে পৌঁছোনর ধক বা সুযোগ, কোনওটাই ছিল না। নজরুল মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে এসে বাংলায় কিছু গজল শৈলীর গান সৃষ্টি করেন। যার মধ্যে ‘‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’’ আদত উর্দু গজলের নিয়ম মেনে রচনা করেছিলেন। বাঙালি শ্রোতাদের মধ্যে এই গানটি বিশেষভাবে লোকপ্রিয় হয়েছিল।
আরও পড়ুন, এবার মায়ের নামেই পরিচিত হোক সন্তানেরা
অনভিজাত ভারতীয় শ্রোতাদের কাছে গজলকে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব দুজন বিরাট মাপের শিল্পীর। তাঁরা হলেন কুন্দনলাল সায়গল আর বেগম অখতার। কুন্দনলাল ছিলেন ছায়াছবির মস্তো স্টার। গজল গানে তাঁর একটা সহজাত নৈপুণ্য ছিল। বস্তুত তাঁর গায়নের বা সুর লাগানোর কৌশলটিই ছিল বনেদি গজলের গায়কি অনুসারী। সিনেমায় গাওয়া তাঁর গজলগুলি হয়ত সঙ্গত কারণেই খুব একটা ভারি অঙ্গের হত না। কিন্তু শ্রোতাদের কাছে গজলগানের নির্যাসটি পৌঁছে দিতে পেরেছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে গজলের লোকপ্রিয়তা বেড়ে ওঠে। প্রায় একই সময়ে গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে সমঝদার মধ্যবিত্ত শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে শুরু করেন অখতারি বাই বা পরবর্তীকালের বেগম অখতার। গজলের প্রধান লক্ষণ প্যাশন বা মাদকতা ছিল তাঁর কণ্ঠের সঙ্গে ওতপ্রোত। তার সঙ্গে যোগ হয় উচ্চকোটির তালিম। ভারতীয় উপমহাদেশে গজলের অবিসম্বাদিত সুপারস্টার ছিলেন তিনি। গত শতকের তিরিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত গজলের ক্রমবর্ধমান লোকপ্রিয়তার মূলে কিন্তু ছিল প্লেব্যাক গানে তার অনর্গল ব্যবহার। কয়েকজন শক্তিশালী সঙ্গীত পরিচালক হিন্দি ছায়াছবিতে এই ধারার গান নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে মদনমোহন, নৌশাদ, রোশন, রবি এবং খইয়াম অসংখ্য লোকপ্রিয় গজল সাধারণ শ্রোতাদের উপহার দেন। এঁদের সুরসৃষ্টির আধার ছিলেন মহম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের মতো দিগ্বিজয়ী শিল্পীরা। তাঁদের যুগলবন্দি থেকে ভারতীয় লোকপ্রিয় সঙ্গীতে গজলের যে জঁরটি তৈরি হয়েছিল তার স্বীকৃতি ও প্রাসঙ্গিকতা প্রায় অর্ধ শতক পরেও অম্লান। মূলত এঁদের এবং অন্যান্য সুরস্রষ্টাদের দৌলতে অদীক্ষিত শ্রোতাদেরও গজল সম্বন্ধে সচেতনতা তৈরি হয়। সত্তর দশকের শেষদিকে হিন্দি ছায়াছবির গানের জগতে ভাঁটার পর্ব শুরু হয়। আকাশছোঁয়া নামগুলি ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে সরে যেতে থাকে। মুগ্ধকর গানের যে ঐতিহ্য দীর্ঘ তিন দশক ধরে শ্রোতাদের নিয়মিত অভ্যাসের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল, তা স্তিমিত হয়ে আসে। এই সময়ে কয়েকজন উচ্চকোটির শিল্পী শ্রোতার প্রত্যাশা আর গানের জোগানের মধ্যের ব্যবধানটি পূর্ণ করার জন্য আসরে নেমে পড়েন। তাঁদের মধ্যে প্রধান নামগুলি, যেমন মেহদি হাসান, জগজিত সিং বা ঘুলাম আলি ভারতীয় সঙ্গীত ঐতিহ্যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হতে পেরেছিলেন। এঁরা ছাড়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বিশেষ নৈপুণ্য নিয়ে গজল পরিবেশন করেছিলেন হরিহরন। আরও কিছু শিল্পী আছেন, যাঁদের জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না, কিন্তু গুণগত সিদ্ধি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। অনুপ জলোটা, চন্দন দাস, পঙ্কজ উদাস, তালাত অজিজ প্রমুখ এঁদের মধ্যে অন্যতম। চার দশক আগে দেশে যখন গজল গানে জনপ্রিয়তার জোয়ার এসেছিল তখন বহু গায়ক, শিল্পীই এই গানে নিজেদের ছাপ রাখার প্রয়াস করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সকলে সফল হননি।
এই মুহূর্তে নতুন প্রজন্মের কাছে হয়তো গজল তেমন লোকপ্রিয় ধারা নয়। কিন্তু তা বলে মালকা-এ-গজলের বিখ্যাত উক্তিটি মিথ্যা হয়ে যায়না। বেগম অখতার একবার বলেছিলেন,
‘‘গজল সহি ঢঙসে গাই জায়ে তো উসকা নশা সর চঢ়কে বোলতা হ্যাঁয়।’’
বেশক বেগমজান। উওহ নশা লগে, পর কতই ছুটে নহি।
আরও পড়ুন, কবিতা থেকে মিছিলে