Advertisment

অনাবৃত ৩২: একটা খুন করতে গিয়ে দুটো খুন?

বিশ্বখ্যাত শিল্পী র‌্যনোয়ার বলেছেন, আমি তো নতুন কিছু করিনি, আমার পূর্বসুরীরা যে কাজ করেছেন তারই পুনরাবৃত্তি করেছি।’‌- প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাসের ৩২ তম পর্ব প্রকাশিত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito

অলংকরণ- অরিত্র দে

‘‌ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের ভিতর সবথেকে পরিচিতি, স্বীকৃতি ও সাফল্য পেয়েছিলেন ফরাসি শিল্পী পিয়ের অগুস্ত র‌্যনোয়ার। কী আঁকব এবং কেমন করে আঁকব এই বিষয় দুটিতে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র ও অনন্য। অথচ তাঁর ছবিগুলি ছিল যথেষ্ট জটিল। নতুন ভাবনাকে গ্রহন করবার জন্য সর্বদা তাগিদ অনুভব করতেন র‌্যনোয়ার। আবার পূর্বসুরীদের কাজকে আত্মস্থ করে, অনুভব করে, ধারা অনুসরণ করতে কখনও দ্বিধাবোধ করেননি। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী ক্লোদ মনে, আলফ্রেড সিসলি, এদগার দেগা, এদুয়ার মানে, ফ্রেদরিক বাজির কাজ তিনি ভাল করে লক্ষ্য করেছিলেন। নিবিষ্ট ভাবে দেখেছেন তাদের ড্রইং এর প্যাটার্ন, রঙের পদ্ধতি, আলো ফেলবার কৌশল, ব্রাশ স্ট্রোক। ছবিগুলি দেখতে দেখতে তিনি ছবির অন্তরে প্রবেশ করে যেতেন। বিষয় বাছাইয়ের জন্য অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পী ফ্রাঁসোয়া বুশের, আঁতোয়ান ওয়াতো, , জাঁ ওনারো ফ্রাগোনার, ইউজিন দোলাক্লোয়ারের মতো শিল্পীদের কাজেও প্রভাবিত হয়েছিলেন। শিল্পরসিকরা বলেছেন, অগুস্ত র‌্যনোয়ার চিত্রকলায় আধুনিক মন এবং ঐতিহ্যের মিলন ঘটিয়েছেন। আর তিনি নিজে কী বলেছেন?‌ বলেছেন, আমি তো নতুন কিছু করিনি, আমার পূর্বসুরীরা যে কাজ করেছেন তারই পুনরাবৃত্তি করেছি।’‌
‘‌স্যার, এই যে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।’‌

Advertisment

হাতের ম্যাগাজিন সরিয়ে মুখ তুললেন বসন্ত সাহা। মনে মনে ভাবলেন, এই এক বিপত্তি। যখন যেটা ঘাড়ে চাপে, কিছুতেই নামতে চায় না। একেবারে সিন্দ্‌বাদের ভূতের মতো বসে থাকে। কিছুদিন আগে চেপে বসেছিল ক্লাসিকাল মিউজিক, এবার এসেছে চিত্রকলা। সুযোগ পেলেই বই, ম্যাগাজিন ঘেঁটে জেনে নেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে, পেইনটিং ব্যাপরটা ঠিক কী?‌ এখন যেমন র‌্যনোয়ার ওপর একটা প্রবন্ধ পড়ছিলেন। কিছুদিন আগে র‌্যনোয়ার কিছু ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে যান বসন্ত সাহা। তারপর থেকেই যেখানে এই শিল্পীর ওপর কিছু লেখা দেখছেন আগে পড়ে নিচ্ছেন। আজও অফিসে এসে টেবিলে পড়ে থাকা একটা ম্যাগাজিনে চোখ পড়ল।  চিত্রকলার ওপর ম্যাগাজিন। অফিসে এসে ফাইল টেনে নেওয়ার কথা। সাধারণত সেটাই করেন বসন্ত সাহা। আজ ফাইলের বদলে ম্যাগাজিনটা টেনে নিলেন। চিত্রকলার ম্যাগাজিন বলেই টানলেন। দু’‌পাতা ওলটাতেই র‌্যনোয়ার লেখাটা চোখে পড়ল। ইদানিং এ ধরনের ম্যাগাজিন সংগ্রহ করছেন বসন্ত সাহা।

আরও পড়ুন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: গয়ানাথের হাতি

সাগ্নিক আবার বলল, ‘‌স্যার, এই যে রিপোর্ট। সুনন্দ রায় এবং মেহুল সেন দুজনেরই রিপোর্ট রয়েছে।’‌
বসন্ত ‌‌‌সাহা এবার একটু লজ্জা পেলেন। গোয়েন্দা বিভাগের বস সকালে অফিসে এসে আর্ট নিয়ে প্রবন্ধ পড়ছেন এটা কিঞ্চিৎ লজ্জারই কথা। গোয়েন্দা অফিসার অফিসে ঢুকে খুন, জখম, রাহাজানি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তা না করে গান, ছবি নিয়ে সময় নষ্ট!‌‌ নেহাত অফিসের সবাই ‘‌স্যার’‌ এর এসব খেপামির কথা জানে তাই কিছু ভাবে না।

সাগ্নিক একটু আগেই ফোনে কথা বলে নিয়েছে। বসন্ত সাহা তখন গাড়িতে।
‘‌স্যার, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পেয়েছি।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌ভেরি গুড। আমি অফিসে ঢুকছি। তুমি এস।’‌
সাগ্নিক বলল, ‘‌স্যার, একটু দেরি হলে অসুবিধে হবে?‌ একটা ফাইল ছেড়ে দিতে হবে। মার্ডার কেস। ফাইলটা আগে না ছাড়লে হোম ডিপার্টমেন্টে রিপোর্ট পাঠাতে পারছে না। অ্যাসম্বেলিতে কোয়েশ্চন আছে।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌নো প্রবলেম। টেক ইওর টাইম। তারপর চলে এসো।’‌
‌সাগ্নিক বলল, ‘যাওয়ার আগে আপনাকে ইন্টারকমে বলে নেব স্যার।’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌কিচ্ছু করতে হবে না। সোজা চলে আসবে।’‌

সাগ্নিক এসে দেখে, বস ম্যাগাজিনে মগ্ন। একবারে ডুবে গিয়েছে।  কভার দেখে বোঝা যাচ্ছে, ম্যাগাজিনের বিষয় ছবি টবি কিছু একটা হবে। আর যাই হোক, পুলিশি কোনও বিষয় নয়। একটু দাঁড়িয়ে থেকে সে ডাকে।
বসন্ত সাহা লজ্জা পাওয়া হেসে বললেন, ‘‌বসো। আসলে একটা ইন্টারেস্টিং লেখা হঠাৎ চোখে পড়ে গেল। আমার এই এক সমস্যা তোমরা তো জানও সাগ্নিক। কোনও সাবজেক্টে একবার ঢুকে পড়লে চট কর বেরোতে পারিনা। যেখানে পাই নেড়েচেড়ে দেখতে ইচ্ছে করে। এখন যেমন ছবি আঁকা নিয়ে পড়েছি। অভ্যেস খুবই লজ্জার। পুলিশ হয়ে গানবাজনা, ছবি, সায়েরি নিয়ে ব্যস্ত হওয়া মোটে কাজের কথা নয়।’‌

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের সিরিজ মনে পড়ে কী পড়ে না

সাগ্নিক চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘‌কোনটা কাজে লাগবে তা কি স্যার আগে থেকে বলা যায়?‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌এইটা ঠিক বলেছ। আমাদের পেশায় কোনটা কাজের কোনটা ফেলে দেওয়ার কেউ বলতে পারে না।‌ আমি তখন একেবারেই জুনিয়র, পোস্টিং হয়েছে নর্থ বেঙ্গলে। দশটা থানা এলাকা জুড়ে কাজ করতে হয়। এর মধ্যে একটা থানা‌‌য় ওসি সাহেব খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারতেন। আমি তো একাট খুনের কেসে ওখানে গিয়ে হাজির। পাবলিক দেখি খুব খেপে রয়েছে, আমাকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাল। তাদের বক্তব্য হল, পুলিশ যদি বাঁশি বাজায় তাহলে এরকম খুনখারাবি নাকি চলতেই থাকবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। শুধু পাবলিক নয়, ওপরতলা থেকেও আমাকে বলা হল, ওসির বাঁশি বিষয়টা একবার খোঁজ নিয়ে আসবে। আমি তো পড়লাম অথৈ জলে। খুনের তদন্ত করতে এসে বাঁশি নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবে আমি ভাবতেও পারি। বাঁশির তো আমি কিছুই জানি নারে বাবা। শেষ পর্যন্ত কী হল জানো?‌’‌

কথা থামিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসলেন বসন্ত সাহা। সাগ্নিক উৎসুক হয়ে বলল, ‘‌কী হল?‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌শুনলে তুমি আশ্চর্য হবে সাগ্নিক, সেবার বাঁশিই মার্ডার কেসটা সলভ করে দিয়েছিল।’‌
সাগ্নিক বলল,‌ ‘‌বাঁশি!‌ বাঁশি দিয়ে খুনী ধরলেন?‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌ধরিনি, তবে বুঝতে পেরেছি। তোমাকে একটু বাঁশির স্বরগমটা একটু বলে নিই। বাঁশির ছটা ছিদ্র দিয়ে সংগীতের সাতটি স্বর, সা, রে  গ, ম, প, ধ ও নি বাজানো হয়। বাঁশিতে সমস্ত ছিদ্র যখন বন্ধ করা থাকে, তখন তার মূলসুর নির্গত হয়। এটা ‘‌‘‌প’‌’। বাঁশির বন্ধ দিকের প্রান্ত থেকে সবচেয়ে দূরের ছিদ্রটি শুধু খোলা রাখলে, "ধ" সুরটি বের হয়। একই ভাবে ওই ধারেরই দুটো ছিদ্র খুললে "নি", ধারের তিনটি ছিদ্র খুললে "সা" আর যদি চারটেই খুলে দাও তুমি, "রে" শুনতে পাবে। আর পাঁচ নম্বর ছিদ্র উন্মুক্ত হলে "গ" শুনবে। আর যদি সব ছিদ্র খোলা হয়?‌ বেরোবে "ম" সুর। প্রত্যেক বাঁশিরই একটি মাত্রা বা স্কেল থাকে। বাঁশির দৈর্ঘ্য, ভিতরের ব্যাস এবং ছিদ্রের মাপের ওপর এই মাত্রা ঠিক হবে। বংশীবাদক তাঁর পছন্দমতো বাঁশি বেছে নানা মাত্রায় সুর তৈরি করতে পারেন। যে বাঁশি দৈর্ঘ্যে ছোট, তার সবগুলি ছিদ্রই প্রায় সমান আকৃতির। এগুলি হল জি স্কেলের। আবার তুলনায় লম্বা বাঁশি সি স্কেলের। যিনি বাঁশি বাজান তিনি ঠোঁট থেকে বের করা বাতাসের বেগ কমিয়ে বা বাড়িয়ে যথাক্রমে মন্দ্র সপ্তক অথবা তার সপ্তক সৃষ্টি করতে পারে।’‌

সাগ্নিক অবাক হয়ে বলল, ‘‌এসবের সঙ্গে মার্ডার কেসের সম্পর্ক কী ছিল?‌’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌মার্ডারটা হয়েছিল একটা ঘরের ভিতর। লম্বা সরু একটা গোডাউনের ঘর। আমাদের দেখে মনে হল, ঘরের একপ্রান্তে শুধু একটা দরজাই রয়েছে। সেই দরজাটা ছিল ভিতর থেকে বন্ধ। তাহলে খুনি ঢুকল  কোন পথে?‌ বেরোলই বা কী করে?‌ এদিকে কে খুন করেছে মোটামুটি আমাদের কাছে পরিষ্কার। ওই গোডাউনেরই এক কর্মীর কীর্তি। কিন্তু তাকে ধরব কী করে?‌ লোকাল পুলিশ অথৈ জলে পড়েছে বলেই আমাকে পাঠানো হয়েছে। আমি অনেক কষ্ট করে একজন সাক্ষীকে খুঁজে বের করি। সেই লোক ওই গোডাউনের পিছন থেকে খানিকটা তীক্ষ্ণ, খানিকটা আর্তনাদের আওয়াজ পেয়েছে। দরজা বন্ধ ঘর থেকে এই আওয়াজ এলও কীভাবে?‌ সেই বংশীবাদক ওসি সাহেব আমাকে পথ দেখাল। তার লম্বা আড় বাঁশিটি এনে তিনি আমাকে সরগম শোনালেন। আমিও মজা দেখছিলাম। এই ওসি  সাহেব কি তবে বাঁশি নিয়েই তদন্ত করে বেড়ান!‌ কিন্তু মজা বেশিক্ষণ করতে পারলাম না। তিনি দেখালেন, বাঁশির বন্ধ দিকের প্রান্ত থেকে সবচেয়ে দূরের ছিদ্রটি শুধু খোলা রাখলে, সরগমের‌ ‘‌ধ’‌ সুরটি বের হয়। তার মানে গোডাউন ঘরের পিছনে কোনও ছিদ্র রয়েছে। আওয়াজ বের হওয়ার কোনও পথ। তখনই আমরা গোডাউনে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। চারটে বড় বড় আলকাতরার ড্রাম সরিয়ে আমার একটা ছোট জানলা খুঁজে পাই। গরাদবিহীন সেই জানলা দিয়ে অনায়াসে কেউ যাতায়াত করতে পারে। সেই রাতেই আমার খুনিকে অ্যারেস্ট করি।’‌
সাগ্নিক বলে, ‘‌ইউনিক ডিটেকশন।’‌

বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌অবশ্যই। বাঁশি না থাকলে আমি বুঝতেও পারতাম। এবার পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা দাও।’

‌বসন্ত সাহা হাতে রিপোর্ট নিয়ে ওল্টাতে ওল্টাতে মুখ শক্ত করে ফেললেন। রিপোর্ট বলেছে, দুজনের মৃত্যু একই বিষে হয়েছে। সেই বিষ খাবার বা জল থেকে আসেনি, আলাদা করে ঢুকেছে শরীরে। বিষে যেসব কেমিক্যালস্‌ ছিল তিনরকম। ডি.‌স্ট্র‌্যামেনিয়াম, ওপিয়ম এবং সালফিউরিক অ্যাসিড। তিন কেমিক্যালসই কনসেনট্রেটেড অবস্থায় ছিল। ফলে পরিমান খুব অল্প হওয়ায় কাজ করতে সময় নিয়েছে। একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যৌগিক বা মালটিপিল্‌ ফাংশন করেছে। নার্ভাস সিস্‌টেমে ধাক্কা দিয়েছে, ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধিয়েছে, হার্ট অকেজো করেছে।

বসন্ত সাহা থমথমে মুখে বললেন, ‘রিপোর্ট দেখে কী মনে হল সাগ্নিক?‌’‌
সাগ্নিক বলল, ‘‌স্যার দিজ পয়েজন ওয়াজ মেড। বানানো হয়েছে। স্যার, এটা একটা পরিকল্পিত মার্ডার।’‌
বসন্ত সাহা চিন্তা ঘন মুখে বিড়বিড় করে বললেন, ‘‌একটা না দুটো?‌ নাকি একটা করতে গিয়ে দুটো খুন হয়েছে?‌ হু ওয়াজ দ্য টার্গেট?‌ কে লক্ষ্য ছিল?‌ তার থেকে বড় কথা কীভাবে বিষ দিল?‌’
————‌
‌‌‌এই ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসের সব পর্ব এক সঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Anabrito
Advertisment