১৩
মুকুরের মুচকি হাসবার কারণ আছে।
এই তেরো নম্বর গেস্টই তার এই নতুন ফ্ল্যাটের নামকরণ করেছে। যদিও সে ইংরেজি শব্দ চায়নি। বাংলাই চেয়েছিল। মুকুরই জোর করে ইংরেজি রেখেছে। মুকুর বলেছিল, ‘নাম চাই।’
‘কার নাম!’
মুকুর বলল, ‘আমার ফ্ল্যাটের নাম।’
‘ফ্ল্যাটের নাম!’
মুকুর বলল, ‘কেন খারাপ হবে? থ্রি বাই টু, ফোর বাই টু তো থাকছেই, কার সঙ্গে একটা নামও থাকুক।’
‘গুড আইডিয়া। তা আমাকে কী করতে হবে?’
মুকুর বলল, ‘নাম বেছে দিতে হবে।’
‘আরে! আমি কী নাম বাছব! আমি কি লেখক? কাঠখোট্টা সাবজেক্টের লোক।’
মুকুর বলল, ‘আমি লেখক টেখক চাই না, কোনও ভাবের দরকার নেই, একটা স্ট্রেটকাট নাম চাই।’
তেরো নম্বর গেস্ট দুদিন সময় নিয়ে জানালো।
‘স্বপ্ন নাম দিলে কেমন হয়? বাড়ি তো আসলে স্বপ্নই। সবাই একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখে। শুধু কাঠ খড়, সিমেন্ট বালি দিয়ে তৈরি বাড়ি নয়, যারা সঙ্গে থাকে তাদের নিয়েও বাড়ি। যদি কেউ না থাকে তবে নিজেই নিজের সঙ্গী হবে।’
মুকুর টেলিফোনেই লাফ দিয়ে উঠে বলেছিল, ‘খুব ভাল হয়। স্বপ্ন। কোনো কায়দা নেই। একেবারে স্ট্রেট। ঠিক যেমনটা আমি চাইছিলাম। তবে বাংলায় নয়, ইংরেজিতে করব। ড্রিম...।’
‘ইংরেজি! কেন ইংরেজিতে কেন! স্বপ্ন শব্দটা তো খুব সুন্দর। বাঙালির বাড়ির নাম বাংলায় হবে।’
মুকুর বলেছিল, ‘বাড়ি ঠিক নয়, ফ্ল্যাট। আর স্বপ্ন দেখতে সুন্দর, শব্দে সুন্দর কিনা জানি না। হলেও কিছু করবার নেই। এই নামটা ইংরেজি রাখাই ভাল। আসলে আমাদের এই ফ্ল্যাটবাড়িটার নাম তো বাংলায়। কবিতা টাইপ নাম। তরণী। কে নাম দিয়েছিল জানি না। আমরা তো কেনবার সময় থেকেই দেখছি। যে আসে সেই বলে, তোমাদের এই বাড়িতে নিশ্চয় কবি থাকে? এর ওপর যদি ফ্ল্যাটের নামও স্বপ্ন রাখি তাহলে তো হয়েছে। এত কবিতার ধাক্কা সামলাতে পারব না বাপু।’
‘এটা কোনো যুক্তি হল? স্বপ্ন’র মতো শব্দ হয়? পৃথিবীর তিনটে সেরা শব্দের একটা হল বাংলায় স্বপ্ন।’
মুকুর হেসে বলল, ‘তাই নাকি!’
‘অবশ্যই তাই। স্বপ্ন কথাটা উচ্চারণ করলেও মন ভাল হয়ে যায়।’
মুকুর বলল, ‘আর দুটো শব্দ কী?’
‘একটা হল অ্যামোর। উচ্চারণের সময় আর সাইলেন্ট। বলতে হবে অ্যামো।’
মুকুর অবাক হয়ে বলেছিল,‘অ্যামোর মানে কী?’
‘অ্যামো হল ফরাসি শব্দ। মিনস লভ। ভালবাসা।’
মুকুর বলল, ‘বাপ্রে! আর তিন নম্বর সুন্দর শব্দটা কী শুনি?’
‘ওটা ইংরেজি শব্দ। রিভেঞ্জ।’
মুকুর আঁতকে উঠে বলেছিল, ‘রিভেঞ্জ! মানে প্রতিশোধ? এটাও সুন্দর শব্দ! প্রতিশোধ কখনও সুন্দর হয়?’
‘অবশ্যই সুন্দর হয়। যদি প্রতিশোধ বলে কোনো শব্দ না থাকত, জীবনটাই কমপ্লিট হতো না। প্রতিশোধ সবসময় বাইরের মানুষের ওপর হবে তার তো কোনো মানে নেই, নিজের ওপরও হতে পারে। থাক্ এসব ফিলসফি, তাহলে ফ্ল্যাটের নামে দ্য ড্রিমই থাকুক। ফ্ল্যাটের মালকিন যেমন চাইবেন।’
নেমপ্লেটের ডিজাইন নিজে গিয়ে পছন্দ করে এসেছে মুকুর। পিতলের ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো দিয়ে কারসিভ হরফে লেখা থাকছে।
মুকুর ডায়েরি খুলল। ভাল করে লিস্টে চোখ বোলালো। নাম এবং তার সঙ্গে দু–এক লাইনের নোট রয়েছে।
কঙ্কনা বসু আর পলাশ সান্যাল। পাশে নোট লেখা, আসবে তো?
কঙ্কনা পলাশ স্বামী–স্ত্রী। কঙ্কনার বয়স তেত্রিশ, পলাশ ছত্রিশ। আগে যে বাড়িতে একসময় মুকুর সুনন্দ ভাড়া থাকত, তার কটা বাড়ি পরে প্রতিবেশী ছিল। প্রথমে সামান্য আলাপ। তারপর চেনাজানা বাড়ে। কাছাকাছি বয়স হওয়া সত্ত্বেও কঙ্কনা মুকুরকে ‘দিদি’ ডাকে। পলাশের মুকুরের প্রতি একধরনের মুগ্ধতা ছিল। মুকুরের নাকি সব ভাল। রূপ, গুণ, লেখাপড়া। কোনো কোনো সময়ে মুকুরের মনে হত, স্বামীর এতো পছন্দের কারণে কঙ্কনা অল্প হলেও তার ওপর জেলাস। মনে মনে চাইত, মুকুর ওই পাড়া ছেড়ে চলে যাক। মাঝেমধ্যে বলত, ‘মুকুরদি, আর কতদিন ভাড়া থাকবে? এবার একটা ফ্ল্যাট কিনে নাও।’
মুকুর বলত, ‘এখানে কিছু আছে নাকি? কোনো খোঁজ খবর তুমি জানো?’
কঙ্কনা বলত, ‘এখানে থাকবে? নানা, এসব কোনো জায়গা নাকি? ঘিঞ্জি, আনপ্ল্যানড। সাউথে কোথাও দেখ।’
পরে মুকুরের মনে হয়েছে, তার এই ধারণা হয়তো ভু্লই ছিল। একটু বেশিই ভেবে ফেলেছিল। ঘন ঘন না হলেও এখনও যোগাযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে দেখাও হয়। টুকটাক ফোন, মেসেজও হয়। সেদিন সাউথসিটি মলে কঙ্কনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
‘কী গো মুকুরদি ভুলেই গেলে।’
মুকুর বলল, ‘ভুললাম কোথায়? এই তো গতমাসে ফোনে কথা হল।’
কঙ্কনা বলল, ‘নতুন ফ্ল্যাটে গেলে, ডেকে একদিন খাওয়ালেও না।’
মুকুর একটু লজ্জাই পেয়েছিল। কঙ্কনা মুচকি হেসে বলল, ‘আমি আর কে বল, এই যদি পলাশ বলতো তুমি লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ডেকে নিতে।’
মুকুর হেসে বলেছিল, ‘আচ্ছা তাই করব, পলাশকেই খাওয়াব। তুমি বাদ। খুব তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাট সেলিব্রেশন পার্টি দিচ্ছি।’
কঙ্কনা বলল, ‘ভেরি গুড। হেভি সেজেগুজে যাব। মুকুরদি, খবর জানও? পলাশ চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ব্যবসা করছে।’
‘তাই নাকি! কীসের ব্যবসা করছে?’
কঙ্কনা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তুমি জানো না?’
মুকুর অবাক গলায় বলল,‘আমি কী করে জানব?’
কঙ্কনা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তোমাকে জানায় নি। বিশ্বের সবাইকে ফোন করে বলে, আমি এখন স্বাধীন। আই অ্যাম ফ্রি।’
মুকুর বলল, ‘ভাল তো। তোমার সুনন্দদাও সর্বক্ষণ বলে। চাকরি ছেড়ে দেব। তা পলাশের ব্যবসা কীসের?’
কঙ্কনা মুচকি হেসে বলল,‘বিষের।’
মুকুর বলেছিল, ‘অ্যাঁ! বিষের! সে আবার কেমন ব্যবসা?’
‘আমাকে মারবে বলে এই ব্যবসা নিয়েছে।’
মুকুর বলেছিল, ‘তোমাকে মেরে পলাশের লাভ কী?’
কঙ্কনা বলেছিল,‘ওমা! লাভ নেই? কী বলছো মুকুরদি! আমি মরলেই তো সবথেকে লাভ। নিজের পছন্দ মতো কোনো মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে। ওর কাছে দুনিয়ার সবথেকে খারাপ মেয়ে তো আমি। থাক, ওসব কথা। কেমিক্যাল সাপ্লাইয়ের বিজনেস করছে ও। ইনড্রাস্টিয়াল কেমিকালস্। এক বন্ধু পার্টনার।’
মুকুর বলল, ‘খুব ভাল। বিষ লাগলে তোমার বরকে ফোন করব।’
মুকুর রিমাইন্ডার দেওয়ার জন্য মোবাইলের নম্বর টিপল। ফোন বেজে গেল। একবার, দু’বার, তিনবার। নো রিপ্লাই। মুকুর ভুরু কুঁচকে মেসেজ টাইপ করল—কাল সন্ধেবেলা আসছো কিন্তু।
এরপর উজ্জ্বল-নয়নিকা
স্কুলের বন্ধু উজ্জ্বল। এক ক্লাসে পড়ত। বলেছিল, ‘বাড়ি করলে দেখাবি, গাড়ি কিনলে চড়াবি।’ মাঝখানে হারিয়ে গেল। বহু বছর পর ফেসবুকে দেখা। আবার চেনাজানা হয়েছে।
এই ছেলে একসময়ে মুকুরের জীবনে ‘সামথিং স্পেশাল’ ছিল। তখন কোন ক্লাসে পড়ছে দুজনে? টুয়েলভের শেষের দিক। কোএডুকেশন স্কুলে পড়লে যেমন ছেলেমেয়েদের মন খোলামেলা হয়, তেমন টপাটপ্ প্রেমও হয়। কিশোর প্রেম। ইনফ্যাচুয়েশন, ক্রাশ। বেশিরভাগ সময়েই এই প্রেম টেঁকে না। বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। ব্যতিক্রম নেই এমন নয়, তবে তা একেবারেই হাতে গোনা। মুকুরেরও ক্রাশ হয়েছিল। একটু বেশিই হয়েছিল। উজ্জ্বল লেখাপড়ায় খুবই ভাল। তার থেকে বড় কথা, ছেলেটা ছবি আঁকত বড় চমৎকার। স্কুলে ছবি এঁকে নাম করে ফেলল। লেখাপড়ার থেকেও বেশি নাম। টিচাররা খুব হই হই করত। মুখের স্কেচ করতে পারত। কটা লাইনে ফটাফট্ একজনকে মোটামুটি চিনিয়ে দিত। মুখের বিশেষত্বটা দেখতে পেতে। কতজনের যে মুখ আঁকত। বন্ধুরা ছিলই, চিচার, পিওন, গার্ড তারাও বাদ যেতেন না। অনেকে আবার নিজে থেকে বলত। মুকুরের ছবি এঁকেছিল। কপালে এসে পড়া কটা চুল, বাঁ গালে ব্রন। মুকুর রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘ব্রনটা আঁকলি কেন?’
উজ্জ্বল বলল, ‘আছে বলে।’
মুকুর চোখ পাকিয়ে বলল, ‘দুদিন পরেই তো চলে যাবে।’
উজ্জ্বল বলল, ‘দুদিন পরে তো ছবিটাও চলে যাবে।’
মুকুর বলল, ‘এখনই চলে যাবে।’
বলে ফস্ফস্ করে ছবিটা ছিঁড়ে ফেলেছিল।
এর কদিন পরে ফিজিক্স ক্লাস শেষে একটা পাকানো কাগজ এনে মুকুরের হাতে ধরিয়ে দিযেছিল উজ্জ্বল।
মুকুর রাগ রগা বলল, ‘কী এটা? আবার ছবি? বলেছি তো তুই আমার ছবি আঁকবি না। বলিনি?’
উজ্জ্বল গম্ভীর মুখে বলল, ‘পরে খুলে দেখিস। তবে সবার সামনে নয়, একা খুলবি।’
মুকুর ক্নাসের কোণে বসে সেই কাগজ খুলল। বুকটা ধড়াস্ করে উঠল।
——————এই ধারাবাহিক উপন্যাসটির সব পর্ব পরপর পড়তে ক্লিক করুন এখানে
প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস অনাবৃত (পর্ব ১৩)
মুকুর বলল, ‘বাপ্রে! আর তিন নম্বর সুন্দর শব্দটা কী শুনি?’ ‘ওটা ইংরেজি শব্দ। রিভেঞ্জ।’ মুকুর আঁতকে উঠে বলেছিল, ‘রিভেঞ্জ! মানে প্রতিশোধ? এটাও সুন্দর শব্দ! প্রতিশোধ কখনও সুন্দর হয়?’
New Update
Advertisment