একটা পেনসিল ড্রইং।
এক কিশোর সামান্য ঝুঁকে পড়ে একটি কিশোরীর গালে চুমু খাচ্ছে। দুজনেরই চোখ বোঁজা। কিশোরীর গালে ব্রন। চুলের কটা গোছা এসে পড়েছে কপালের ওপর। আর কিশোরটি চুল এলোমেলো। কেয়ারলেস ভাব, ওই বয়েসে যেমন হয়। মাত্র কয়েকটা টানে উজ্জ্বল নিজেকে খারাপ আঁকেনি। একবার দেখেই চেনা যাচ্ছে। বিশেষ করে কপালের কাটা দাগটা। ছেলেটার এটাই গুণ। কারও মুখের স্কেচ কররার সময় তার কোনো বিশেষত্বের ওপর নজর রাখে। নিজের কপালের দাগটাকেও ছাড়েনি।
সেদিন তাড়াতাড়ি ছবিটা গুটিয়ে ফেলেছিল মুকুর। বুক ধুকপুকানি সামলানোর পর রাগে, লজ্জায় কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল। বলা নেই কওয়া, নেই একেবারে চুমু! এই ছেলের প্রতি তার দুর্বলতা আছে বলে এতো দূর কল্পনা করে ফেলল! সে মনে মনে ঠিক করল, দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। উজ্জ্বলকে চেপে ধরল স্কুল ছুটির পর। নিচু গলায় বলে, ‘তোর তো সাহস খুব। কালই আমি প্রিন্সিপালকে বলে দেব।’
উজ্জ্বল নির্বিকার ভাবে বলেছিল, ‘বলিস।’
মুকুর চাপা গলায় বলে, ‘ভাবছিস ছাড়্ পেয়ে যাবি?’
‘একেবারেই ভাবছি না। আমার ছবি সবাই চেনে। ছবি দেখে দুজনকে চিনতে পারবে। ছবির নিচে তো সই করেছি। সুতরাং পালিয়ে যাব কী করে?’
মুকুর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘স্কুল থেকে যখন তাড়িয়ে দেবে, সই করা বেরিয়ে যাবে।’
উজ্জ্বল যেন মজা পায়। মুচকি হেসে বলল, ‘তাড়ানোর আগে নিজেই ছেড়ে যাব। তুই যদি বলিস, কাল থেকে আর স্কুলে আসবি না উজ্জ্বল, তাই হবে। আগে বল এবারের ছবিটা তোর পছন্দ হয়েছে? নাকি এটাও ছিঁড়ে ফেলেছিস?’
মুকর জবাব দেয় না। মনে মনে ঠিক করে, প্রিন্সিপালকে কমপ্লেন না করলেও একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতেই হবে। উজ্বল ভেবেছেটা কী? সে গটগটিয়ে চলে যায়। বাড়ি ফেরবার পরই ঘটনা গোলমেলে হয়ে গেল। সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসে, লুকিয়ে ছবিটা বের করে মুকুর। উজ্জ্বলের মাথা নামিয়ে চুমু খাওয়ায় দৃশ্যটা দেখে এবার আর রাগ নয়, মাথা টলমল করে ওঠে। শিরশির করে ওঠে শরীর। ধুকপুকানির বদলে বুকের মধ্যে কেমন যেন করতে থাকে। একেই কি উথালপাথাল বলে? উজ্বলকে কী সুন্দরই না দেখাচ্ছে! ছেলেটাকে এতো সুন্দর! কই আগে তো এভাবে নজর পড়েনি। নিজের অজান্তে গালে হাত দেয় মুকুর। নিজেকে স্পর্শ করে ? নাকি উজ্জ্বলের ঠোঁট? কেমন গরম! তার কি জ্বর এলো? তাড়াতাড়ি ছবিটা ভাঁজ করে ফিজিক্স বইয়ের ভিতর লুকিয়ে ফেলে মুকুর। নিজেকে সামলায়।
পরপর তিনদিন স্কুলে আসে না উজ্বল। ছটফট করে মুকুর। ‘পাজি’টা আসছে না কেন? শরীর খারাপ? মন? নাকি ভয় পেয়ে সত্যি সত্যি স্কুল ছেড়ে দিল? বন্ধুদের জিগ্যেস করতেও কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। এরা সবসময় সন্দেহ করবার জন্য বসে আছে। বয়সটাই এরকম। এর ওর পিছনে লাগাবার বয়স। পাঁচদিনের মাথায় এক বিকেলে উজ্জ্বলের বাড়ি গিয়ে হাজির হল মুকুর। উজ্জ্বলের কিছুই হয়নি। সে নিজের ঘরে বসে দিব্যি পা নাচিয়ে নাচিয়ে ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস করছে। বাড়িতে কেউ নেই।
‘কী হয়েছে? অ্যাবসেন্ট করছিস কেন?’
উজ্জ্বল হেসে বলল, ‘তোকে চুমু খাওয়ার অপরাধে শুনে স্কুল ছেড়ে দিচ্ছি।’
মুকুর অবাক হয়ে বলল, ‘মানে!’
উজ্জ্বল বলল, ‘চুমু খাওয়ার পানিশমেন্ট। নিজেই নিজেকে শাস্তি দিলাম।’
মুকুর চিন্তিত হয়ে বলল, ‘বাজে কথা ছাড়। কী হয়েছে বল।’
উজ্জ্বল বলল, ‘বাবার ট্রান্সফার হয়েছে। হায়দরাবাদ চলে যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হব। মাঝপথে স্কুল বদলে ঝামেলা আছে। কিন্তু যেতে হবে। ওখানে একটা বড় স্কুলের সঙ্গে কথাও হয়ে গেছে। বাবার অফিস থেকেই ব্যবস্থা করেছে। শুধু একটা এক্সাম দিতে হবে। অঙ্কের এক্সাম। ভাল করলে নিয়ে নেবে বলেছে। ভাল তো করবই। তাই বাড়িতে বসে প্রিপারেশন নিচ্ছি। বাবা–মা, দিদি সবাই বেরিয়েছে মার্কেটিং করতে। জায়গা ছাড়তেও তো অনেক আয়োজন লাগে।’
মুকুর ধপাস্ করে উজ্জ্বলের পাশের চেয়ারে বসে বসল। তার ভিতরটা কেমন ফাঁকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সামনে পিছনে কিছু নেই। উজ্জ্বল হাত বাড়িয়ে তার ডান হাতটা ধরে হেসে বলল, ‘ভালই তো হল। তোর ছবি নিয়ে আর জ্বালাতন করবার কেউ থাকবে না।’
মুকুর কাঁপা গলায় বলল, ‘আমার কী হবে?’
উজ্জ্বল ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, ‘খুব ভাল হবে। তুই লেখাপড়ায় ভাল। এডুকেশন শেষ করে চাকরি করবি। বাড়ি, গাড়ি করবি। ভাল বিয়ে হবে। অ্যাই বাড়ি করলে দেখাবি, গাড়ি কিনলে চড়াবি কিন্তু। এই বলে রাখলাম। ফাঁকি দিবি না।’
মুকুর ছলছল চোখে বলল, ‘চুপ কর, একদম চুপ। কিচ্ছু করব না। স্বার্থপর ছেলে একটা। বাজে ছেলে।’
উজ্জ্বল ঝুঁকে পড়ে তার ভাঙা গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘তোকে খুব সুন্দর লাগছে। ইচ্ছে করছে, একটা চুমু খাই।’
মুকুর আর পারল না। চোখ দিয়ে কয়েকটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সেই বয়েসের ক্রাশ যা করতে পারে। সে মুখ নামাল।
উজ্জ্বল বলল, ‘নারে, চুমু খাব না। সত্যি চুমু খেলে, ছবির চুমুটা নষ্ট হয়ে যাবে। সত্যি চুমুর রেশে কতক্ষণ আর থাকবে? ছবির চুমু অনেকদিন থেকে যাবে। আমি একজম আর্টিস্ট না? আমরা ছবির চুমুটাই ঠিক।’
মুকুর আর নিজেকে সামলাতে পারে না। সে উজ্জ্বলকে জড়িয়ে ধরে।
বহু বছর কেটে গেছে। উজ্জ্বল হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় মুকুরও। সেই কৈশোরের ইমোশনকে খোলসের মতো সরিয়ে যে যার মতো জীবন তৈরি করে। তারপরেও আবার দেখা হয়। নাটকের মতো নয়, দেখা হয় স্বাভাবিক ভাবে, ফেসবুকে। এখন যেমন অজস্র হয়।। ততক্ষণে উজ্বল নয়নিকাকে বিয়ে করছে। বিদেশ, প্রবাস কাটিয়ে কলকাতায় এসেছে। মুকুরও সুনন্দর সঙ্গে জীবন সাজিয়ে নিয়েছে। পুরোনো মানুষ ফিরে আসে, পুরোনো ভালবাসার কথা ফিরে আসে, কিন্তু পুরোন প্রেম ফিরে আসে না। সে ফেলে আসা পথে পড়েই থাকে। দুজনেই চায়, কেউ একজন কুড়িয়ে নিক। তা আর হয়ে ওঠে না কারোরই। মনে পড়ে যায় মাত্র। সেই মনে পড়াকে কেউ ফেলে আসা প্রেম বলে ভুল করে। মুকুর সেই ভুল করেনি। নতুন করে যোগাযোগ হওয়ার পর সে উজ্বলের সঙ্গে নতুন করেই মিশেছে। ফোনে কথা বলে, দু’বার দেখাও করেছে। উজ্জ্বল মাঝমধ্যে মজা বলবার চেষ্টা করে।
‘হ্যাঁ রে প্রেম কি ফিরে এলো?’
মুকুর ভুরু কুঁচকে বলে, ‘ফিরে এলে কী করবি?’
উজ্জ্বল বলে, ‘ভেবে দেখব।’
মুকুর বলে, ‘কী ভেবে দেখবি?’
উজ্জ্বল বলে লম্বা করে শ্বাস টেনে বলে, ‘কীভাবে তোর বরকে স্যুইক্...’
ডান হাত দিয়ে তালু দিয়ে গলায় ছুরি চালানোর ভঙ্গি করে।
মুকুর হেসে বলে, ‘সুনন্দর গলা কেটে দিবি?’
উজ্জ্বল মুখটা দুঃখী দুঃখী করে বলে, ‘নারে পারব না। ছুরি দিয়ে মারতে পারব না, তবে খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারি।’
মুকুর বলে, ‘তারপর?’
উজ্জ্বল বলে, ‘তারপর আর কী তোকে ঘোড়ার পিঠে ছড়িয়ে ছুট লাগব।’
‘বাপ্রে এখনও এতো প্রেম!’
উজ্জ্বল একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘ধ্যুস্... মজা করছিলাম।’
সেই উজ্জ্বলকে পার্টিতে ডাকতে হয়েছে। নয়নিকাও আসবে। মুকুর উজ্জ্বলকে ফোনে ধরল।
‘ইয়েস মাই ফার্স্ট লাভ।’
মুকুর হেসে ফেলে বলল, ‘ওহে মাই লাস্ট লাভ, কালকের কথা মনে আছে তো? নয়নিকাকে আসতে হবে কিন্তু?’
উজ্জ্বল বলল, ‘মনে আছে মানে! হাজারবার মনে আছে আমাদের ড্রেস রিহার্সাল পর্যন্ত হয়ে গেছে। নয়নিকা নতুন লেহেঙ্গা চোলি কিনেছে। শালা তোর জন্য ফতুর হয়ে যাব মুকুর। নতুন করে পরিচয় হয়ে খরচটা বাড়ছে।’
মুকুর বলে, ‘আমার জন্য কী গিফট আনছিস?’
উজ্জ্বল হাসতে হাসতে বলে, ‘তোর জন্য গোলাপ ফুলের তোড়া, আর তোর বরের জন্য বিষ। আমার রাজকন্াযকে কেড়ে নেবার প্রতিশোধ নেব কাল।’
————
এই ধারাবাহিকের সব পর্ব একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এখানে