উজ্জ্বলের কথায় মনে মনে খানিকটা হাসল মুকুর। তবে তার সিক্রেট ডায়েরিতে নোটও রাখল। নোটটা একটু বড় হল। চার লাইনের-
‘উজ্জ্বলের পাগলামি এখনও গেল না। এত বছর কেটে গেল তারপরেও পুরোনো কথা ভুলতে পারে না। নাকি মজা করে? এরপর ওকে সাবধান করতে হবে। মজা বাড়াতে গিয়ে যেন হাত ফসকে বেরিয়ে না যায়। নয়নিকা এসব জানলেই বা কী ভাববে? তবে আমিও কি পুরোনো দিন ভুলতে পারিনি?’
শুধু উজ্জ্বলের নয়, মুকুর নোট রাখল কঙ্কনাকে নিয়েও।
‘ফোন নো রিপ্লাই বলছে। আর একবার কল করতে হবে। কে জানে বাবা, ওরা আসবে তো? কঙ্কনার মাথা থেকে বরের ওপর সন্দেহ কি গেছে? নাকি এখনও ধারণা বিষ খাইয়ে ওকে মারবে? পলাশকেও একটা মেসেজ দিয়ে রাখতে হবে।’
এবার প্রতীকের নম্বর টিপল মুকুর। একটু আগে ক্যাটারিং –এর অফিসে ফোন করা হলেও, মালিককে করা হয়নি। মন্দার আর তার বর প্রতীক সুনন্দর গেস্ট। প্রতীক সুনন্দর এক সময়ের পাড়ার বন্ধু। ঠিক ‘বন্ধু’ না বলে পরিচিত বলাই ভাল। লেখাপড়া বিশেষ করেনি। বাবার ক্যাটারিং–এর বিজনেসে ঢুকে পড়ে। লেখাপড়ায় চোস্ত না হলেও বিজনেসটা ভালই করে। নামও হয়েছে। কাজ করতে করতেই সুনন্দর সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরিচয়ের সূত্রেই কাজ চায়। সুনন্দ অফিসের কিছু কাজ দিয়েছিল। প্রতীক ভাল করেছে। খাবার–দাবার, সার্ভিসিংয়ের প্রশংসা হয়েছে। বাড়ির এই কাজটা সুনন্দই ওকে দিতে চেয়েছিল।
মুকুর বলেছিল, ‘ভাল তো হয়। চেনা লোক হলে কাজ ভাল হবে।’
সুনন্দ বলল, ‘তা হবে। তবে একটা কথা, আমার বাড়ির ফাংশন তো ওকে কিন্তু নেমন্তন্ন করো। অনেকদিন থেকে চিনি। ছোটোবেলায় ওর বাড়িতে খাওয়া দাওয়াও করতাম। শুধু সার্ভিস নিতে ডাকলে খারাপ ভাবতে পারে। প্রতীকের সঙ্গে ওর স্ত্রী মন্দারকেও বলবে।’
মুকুর অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তুমি ওর স্ত্রীকেও চেন!’
সুনন্দ বলেছিল, ‘চিনব না? বাপ্রে ওই ছেলে বিয়ে নিয়ে যা কাণ্ড করেছিল। পাড়ায় একেবারে তুলকালাম হয়ে গিয়েছিল।’
মুকুর বলেছিল, ‘বিয়ে নিয়ে কাণ্ড! সে আবার কী?’
সুনন্দ বলেছিল,‘আরে বাবা, ওর বউ মন্দার আমাদের পাড়ারই মেয়ে। স্কুলে পড়তে পড়তে প্রতীকের সঙ্গে পালালো। হুলুস্থূলু ব্যাপার। তখন প্রতীক আবার সঙ্গে পড়ছে। মন্দারের বাবা ছিলেন ডাকসাইটে লোক। পুলিশে চেনাজানা ছিল। সোজা কমপ্লেইন। ওই যে বলি না, পুলিশ থেকে যতদূরে থাকা যায়? সাধে কি আর বলি? পুলিশ তো প্রতীকের বন্ধুদের ধরে টানাটানি শুরু করল।’
মুকুর নাক মুখ সিঁটকে বলল, ‘এমা! স্কুলে পড়া মেয়েকে নিয়ে পালালো!’
সুনন্দ বলল, ‘আরে বাবা, ছেলেবেলার প্রেমে এসব ভুল হয়। তখন আর কি কেউ ভেবেচিন্তে কিছু করে? যা করে সবটাই ভুল হয়ে যায়। যাই হোক সেসব অনেক কষ্টে সামলানো হল। মেয়েকে ফেরত আনিয়ে মামাবাড়িতে পাঠানো হল। তারও অনেক পরে ওদের বিয়ে। আমরা গিয়ে খেলাম।’
মুকুর বলেছিল, ‘বাবা এতো ঘটনা! কই আগে তো বলোনি।’
সুনন্দ বলেছিল, ‘তোমাকে কি আমারক সব বন্ধুর কথা বলেছি? তুমি বলেছো? এখন প্রসঙ্গ উঠল তাই বলছি।’
কথাটা হালকা খোঁচা থাকলেও এড়িয়ে গিয়েছিল মুকুর। ভুরু কুঁচকে বলল,‘ওরা আমাদের এই পার্টিতে ফিট করবে তো? ওদের অসুবিধে হবে না?’
এই প্রশ্নে সুনন্দ বিরক্ত হল। বলল, ‘অসুবিধে হলে আসবে না। তবে আমাদের বলাটা উচিত। পরে ভাববে সুনন্দর নতুন ফ্ল্যাটের খাওয়া, অথচ আমাকে একবার বলল না। আমার মনে হয় না আসবে।’
সেই মতো প্রতীককেও আসতে বলেছে মুকুর। স্ত্রী মন্দারকে নিয়েই আসতে বলেছে। প্রতীক বলেছিল,‘চেষ্টা করব ম্যাডাম। খুব চেষ্টা করব।’ এক সময়ের কাছের বন্ধুর স্ত্রীকে ‘ম্যাডাম’ ডাকবার কারণ কী মুকুর ঠিক বলতে পারবে না, তবে এই নিয়ে সে আপত্তি কিছু করেনি। বলছে বলুক। কথা বলবার সময়েও ছেলেটা খানিকটা জড়োসড়ো হয়ে থাকে। সম্পর্ক তো খুব লম্বা দিনের কিছু নয়। সুনন্দ চাইছে বলেই কথা বলা। ম্যাডাম ডাকুক আর যাই ডাকুক। তবে একদিক থেকে ভালই হল, খাবারের বিষয় কিছু নির্দেশ দেওয়ার আছে।
প্রথমবার রিং হতেই ফোন ধরল প্রতীক।
‘সব রেডি তো?’
‘নিশ্চয়। চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। বারোজনের কাজ আমাদের কাছে কোনো সমস্যা নয়।’
‘তা জানি, আপনারা অনেক বড় বড় অকেশন সামলান প্রতীকবাবু, কিন্তু আমার এই অল্প গেস্টরাই খুব স্পেশাল।’
‘কোনো চিন্তা নেই। প্রতীকের বাড়ির কাজ বলে কথা। কোয়ালিটি নিয়ে নো কম্প্রোমাইজ। কিচ্ছু ভাববেন না ম্যাডাম। তাছাড়া আপনাদের অকেশনটাও তো একেবারে স্পেশাল। আমি গৃহপ্রবেশের কাজ অনেক করেছি, ফ্ল্যাটের হ্যাপি বার্থ ডে কখনও করিনি।’
মুকুর সামান্য হেসে বলল, ‘ভালই বলেছেন, ফ্ল্যাটের হ্যাপি বার্থ ডে। আচ্ছা, ফ্রিশ ফ্রাইগুলো কিন্তু আটটার মধ্যে সার্ভ করতে হবে। ড্রিঙ্কসের সঙ্গে।’
প্রতীক বলল, ‘শুধু ফ্রাই কেন, পকোড়া, কাবাব, বেকড্ পনির সবই ড্রিঙ্কসের সঙ্গে থাকবে।’
মুকুর বলল, ‘তাই ফ্রাইটা দেখবেন যেন ঠিকমতো হয়।’
প্রতীক বলল, ‘হবে ম্যাডাম। লোকজন জিনিসপত্র নিয়ে ঠিক সময়ে চলে যাবে।’
মুকুর বলল, ‘থ্যাঙ্কু। আপনি দায়িত্ব নেওয়ায় অনেকটা ভরসা। তবে শুধু আপনার স্টাফেরা এলেই হবে, আপনি এবং মন্দারও কিন্তু আসছেন। নইলে আপনার বন্ধু খুব রাগারাগি করবে। ইন ফ্যাক্ট, এই ফোনটা আমি সেই জন্য করেছি। আপনাদের রিমাইন্ডার দিতে।’
প্রতীক একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘চেষ্টা করব ম্যাডাম।’
মুকুর বলল, ‘চেষ্টা নয়, আসতে হবেই।’
প্রতীক আবার একটু চুপ করে থেকে বলল,‘আচ্ছা।’
ফোন ছেড়ে মুকুর তার নোটখাতায় লিখল— ‘প্রতীকের গলার স্বর আজ কেমন থমথমে লাগল। তবে কথা শুনে বুঝতে পারছি, ক্যাটারিং এর ব্যাপারে কনফিডেন্ট। যাক, আমার সেটা হলেই চলবে। গলা থমথমে না গমগমে ভেবে আমার কী?’
পরের ফোনের জন্য তৈরি হতেই মুকুরের মোবাইল বেজে উঠল। প্রতীকের নম্বর। কী হল আবার?
‘কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?’
ওপাশে প্রতীক আগের থেকেও বেশি থমথমে গলায় বলল, ‘একটু সমস্যা হয়েছে।’
মুকুর একটু ভয় পেয়েই বলল, ‘কী সমস্যা ?’
প্রতীক আমতা আমতা করে বলল, ‘কাল আপনার কাজটা যদি অন্য কেটারার করে দেয়, কোনো অসুবিধে...’
মুকুর প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলে, ‘কী বলছেন! আর মাত্র কয়েকঘন্টা বাকি...এই তো বললেন, কোনো চিন্তা না করতে...বললেন সুনন্দর বাড়ির অকেশন... বললেন না? দু’মিনিটও হয়নি।’
প্রতীক কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘বলেছি, কিন্তু...।’
‘কিন্তু কী?’
প্রতীক বলল, ‘বলেছি। আসলে খানিক আগে একটা বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে সুনন্দর...আপনার ফোনটা ছাড়বার পর ও আবার ফোন করে... করে বলে...।’
মুকুর অবাক হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া? ও তো আপনাকে খুবই পছন্দ করে।’
প্রতীক বলল, ‘ঠিক ঝগড়া নয়...কিন্তু সুনন্দ যেভাবে রিঅ্যাক্ট করল।’
মুকুর বলল, ‘আমাকে বলুন কী হয়েছে।’
প্রতীক একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘আপনি কি আমাকে দিয়ে কাজটা করাতে চাইছেন?’
মুকুর উত্তেজিত গলায় বলল, ‘চাইছি মানে! অবশ্যই চাই। আপনি কী বলেছেন কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’
যেমন দুম্ করে ফোন করেছিল, তেমন দুম করেই ফোন রেখে দিল প্রতীক। মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে মুকুর ফোন তুলে সুনন্দকে।
সুনন্দ ফোন তুলে বিরক্ত গলায় বলল, ‘কী হয়েছে?’
মুকুর বলল, ‘আমিই তো জানতে চাইছি কী হয়েছে? প্রতীকের সঙ্গে কী হয়েছে তোমার? ও কাল কাজ করতে চাইছে না কেন?’
সুনন্দ একটু থমকে গিয়ে বলল, ‘ও আমার কাছ থেকে টাকা ধার চাইছে। বিজনেসে ইনভেস্ট করবে।’
মুকুর বলল, ‘এখন! কত অ্যামাউন্ট?’
‘বড় অ্যামাউন্ট।’
মুকুর বলল, ‘তুমি দিচ্ছো?’
সুনন্দ বলল, ‘পাগল হয়েছো। অত টাকা কোথা থেকে দেব? আর কেনই বা দেব? আমি ফোন করে বললাম, দেখিস টাকা দিচ্ছি না বলে, খাবারে বিষ টিষ মিশিয়ে দিস না যেন। ইট ওয়াজে আ জোক। ওর মনে হয়, কথাটা লেগে গেছে।’
মুকুর বলল, ‘ছিছি। বিষ নিয়ে এরকম একটা ঠাট্টা কেউ করে? ছিছি। এটা ওর প্রফেশন। খাবারে বিষ মেশাবে কথাটা ওর কতটা খারাপ লাগতে পারে একবার ভাবলে না?’
সুনন্দ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘দাঁড়াও আমি ফোন করে ম্যানেজ করছি।’
মুকুর বলল, ‘প্লিজ, তোমাকে কিছু করত হবে না। যা বলবার আমি বলেছি। ইস্, কাল নিশ্চয় ওরা আসবে না। বিষ দেবার কথা বললে কেউ নেমন্তন্ন অ্যাটেন্ড করতে আসে?’
—————
প্রচেত গুপ্তের অনাবৃত উপন্যাসের সবকটি পূর্ব প্রকাশিত খণ্ড পাবেন এই লিংকে
প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত (পর্ব ১৫)
সুনন্দ বলল,‘পাগল হয়েছো। অত টাকা কোথা থেকে দেব? আর কেনই বা দেব? আমি ফোন করে বললাম, দেখিস টাকা দিচ্ছি না বলে, খাবারে বিষ টিষ মিশিয়ে দিস না যেন। ইট ওয়াজে আ জোক। ওর মনে হয়, কথাটা লেগে গেছে।’
New Update
Advertisment