ঘরে ঢুকে জানলার পর্দা সরিয়ে দিল হৈমন্তী। দেওয়াল জোড়া কাচের জানলা দিয়ে কলকাতার ঝকেঝকে আকাশ ঘরের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেন হেসে বলল, ‘কেমন আছ হৈমন্তী? কলকাতায় স্বাগতম।’
হৈমন্তী হাসল। মনে মনে বলল, ‘ফাইন। হাউ আর ইউ?’
আকাশ বলল, ‘সবসময় ভাল থাকি না। মাঝেমধ্যে তোমাদের জন্য মন কেমন করে। সেসব সামলে আবার ঠিক হয়ে যাই।’
হৈমন্তী বলল, ‘মন কেমনের কী আছে মাই ডিয়ার? তুমি তো সব জায়গাতেই থাক। নানা রূপে হলেও একই তো আকাশ। কলকাতা, পুনে, লন্ডন যেখানেই থাকি না কেন তোমার সঙ্গে দেখা তো হয়।’
আকাশ বলল, ‘তুমি মেয়েটা যেমন সুন্দর, তোমার কথাগুলোও সুন্দর।’
হৈমন্তী বলল, ‘থ্যাঙ্কু ডার্লিং।’
বাইপাসের ধারের এই হোটেলটা ভাল। শুধু নামকরা বলে নয়, পজিশনটা চমৎকার। কলকাতায় এলে হৈমন্তী এখানে ওঠে। সে ঘর নেয় একবারে ওপরের দিকে। এতো ওপর থেকে কলকাতাকে দেখতে তার অদ্ভুত লাগে। মনে হয়, একটা খুব কাছের শহর কত দূরের হয়ে গেছে! কত স্মৃতি, কত সুখ দুঃখ। ভালবাসা অপমান কত, কতই না প্রতারণা। কলেজে পড়বার সময মনে হতো এমন শহর আর হয়তো। এতো প্রাণ আর কোথায় আছে? সে মহা ভাগ্যবতী, কারণ এই শহরের মেয়ে। পরে ধাক্কা খেতে খেতে মনে হয়েছে, এই বিশ্রী শহর থেকে তাকে পালাতে হবে। যতদূরে পারা যায় পালাতে হবে। এখন বয়স বাড়াবার পর, শহরের ওপর থেকে অভিমান মুছেছে। বুঝেছে, শহর নয়, তাকে ঠকিয়েছে মানুষ। নোংরা মানুষ তাকে নিয়ে খেলেছে। শহর সেই দায় নেবে কেন? তারপরেও মনে হয়, দূরে আছে বলেই ভাল লাগে।
হৈমন্তী জানালার কাছে চলে আসে। কাচে হাত রাখে। কালকাতাকে স্পর্শ করতে চায়। প্রতিবারের মতো আজও অবাক হয়, শহরে এখন এতো সবুজও রয়েছে! এরোপ্লেন থেকে কিন্তু এরকম মনে হয় না। মনে হয়, এক্ষুনি কংক্রিটের জঙ্গলে নেমে পড়তে হবে। শুধু বড় বড় বাড়ির মাথা, রাস্তা, আর পুতুল খেলার গাড়ি। ল্যান্ডিং–এর ওই সময়টুকু হৈমন্তী চোখ বুঁজে থাকে।
হৈমন্তী জানলার সামনে থেকে সরে এল। ঘরের একপাশে রাখা ট্রলি ব্যাগটা টেনে টেবিলে তুলল। হালকা। জিনিসপত্র বেশি নেই তো। কটাদিনের জন্য তো আসা। কত ড্রেস আর লাগবে? ছোটো ব্যাগ আনলেও চলত। কেবিন লাগেদ করে নিয়ে আসা যেত। সেটা সম্ভব হতো না। সেই ব্যাগ কেবিনে অ্যালাও করত না। মাপের জন্য নয়, ভিতরে যা আছে সিকিউরিটি স্ক্যানার আটকে যেত। আজকাল প্লেনে নেলকাটার পর্যন্ত হ্যান্ড ব্যাগে রাখতে দেয় না।
এই হোটেল উঠলে কাজকর্মেরও সুবিধে হয় হৈমন্তীর। ঘরের সঙ্গে মেকশিফট অফিস রয়েছে। সেখানে অনায়াসে তিন–জন মিলে মিটিং করা যায়। নিচে লাউঞ্জে নামতে হয় না। তার পক্ষে ঘরে বসানোও সম্ভব। তাই ফর্মাল অফিসরুমটা জরুরি ছিল। সব হোটেলে এমন পাওয়া যায় না। এই তো গতবারই ড. ভার্গব দুজনকে নিয়ে এসেছিলেন। বটানির লোক। ওরা অ্যারোমাথেরাপি নিয়ে কাজ করেন। সুগন্ধী চিকিৎসা। ওরা অফিসে বসে ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশনও দেন। পেনড্রাইভে গোটা জিনিসটা নিয়ে গিয়েছিল হৈমন্তী। পুনেতে ফিরে শুধু নিজেরা দেখেনি, স্যাম্পেল সহযোগে বিদেশে পাঠিয়েও দিয়েছিল। কোম্পানি উৎসাহ দেখিয়েছে। বিষয়টা নিয়ে এগোতে বলেছে। কসেমেটিকসের সঙ্গে গন্ধ দিয়ে চিকিৎসার বিষয়টা বাজাকর কেমন চলবে সেটাও দেখতে হবে বলে তারা নোটে মন্তব্যও করেছিলে। অ্যারোমাথেরাপি একটা প্রাচীন বিষয়, তারপরেও ড. ভার্গব আর তার টিমের প্রেজেন্টেশনটা ছিল পরিচ্ছন্ন। অনেক কিছু অজানাও ছিল হৈমন্তীদের।
গাছের ফুল, ফল, পাতা, বীজ, বাকলে থাকে একধরনের নির্যাস। ভেপারাইজড অয়েল। এই তেলে কিটোন, কোহল, টারপিন, এস্টারসের মতো অজস্র কেমিকালস্ রয়েছে। একেক ধরনের গাছে একেকরকম। এদের ফাংশনও একেকরকম। তুলসী, কপুর্র, দারুচিনি, লবঙ্গ থেকে হরতিকি, কালমেঘে, নয়নতারা সবই এই চিকিৎসায় কাজে লাগানো হয়। এই পর্যন্ত হৈমন্তীর জানা ছিল। এই চিকিৎসা যে একসময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল তার উদাহরণগুলো জানা ছিল না। তার একটা দুটো শুনে তো ল্যাবরেটরির ছেলেমেয়েরা তো অবাক হয়ে গিয়েছিল। প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্রের অন্যতম ফাউন্ডার ছিলেন হিপোক্রিটাস্। তিনি বলেছিলেল, নিয়মিত এই ধরনের সুগন্ধী তেল মেখে স্নাল করলে নানা রোগ এড়িয়ে থাকা যায়। এথেন্স থেকে প্লেগের মতো মহামারীকে নিমূর্ল করতে হিপোক্রিটাসের এই পরামর্শ নাকি খুব কাজে দিয়েছিল। ক্যাসিয়া, শিবামনের মতো তেল ব্যবহার করা হতো। এমনকী রোমের মানুষ মন খারাপ হলে সুগন্ধী তেল ব্যবহার করতেন। হৈমন্তী এই জায়গাটা ধরেছে। তার ল্যাবরেটরিতে ল্যাভেন্ডার, সেডার উড, সাইপ্রেস নিয়ে কাজ চলছে। দেখা হচ্ছে, সুগন্ধ কী ভাবে আলফা তরঙ্গের মধ্যে দিয়ে মস্তিস্কে প্রভাব ফেলতে পারে।
হৈমন্তীর মোবাইল বেজে উঠল। হৈমন্তী টেবিল থেকে ফোন তুলে নম্বর দেখল। চিনতে পারল না। ল্যান্ডফোনের নম্বর। ফোন কানে নিতে ওপাশের পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘এসে গেছ?’
হৈমন্তী বলল, ‘এসেছি। কিন্তু তুমি তো ফোন করবে না বলেছিলে।’
পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘বাইরে থেকে করছি। বুথ থেকে।’
হৈমন্তী বলল, ‘তোমাদের এখানে এখনো টেলিফোন বুথ রয়েছে!’
পুরুষকণ্ঠ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘দু–একটা আছে। এটা একটা জেরক্সের দোকান। ফঁাকা বলে ঢুকেছি। যাক, ওসব কথা ছাড়, তুমি তৈরি?’
হৈমন্তী বিছানার বসে বলল, ‘তুমি যে লিস্ট দিয়েছো, সবাই আসছে?’
পুরুষকন্ঠ বলল, ‘আসবার তো কথা। তুমিও তো লিস্ট শুনেছো।’
হৈমন্তী বলল, ‘ওই পুলিস অফিসার?’
পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘দুজন আসবে বলে আমি জানি। একজন হাফ পুলিশ।’
হৈমন্তী শার্টের বোতাম খুলতে লাগল।
‘হাফ পুলিশ আবার কী ব্যাপার।’
পুরুষকণ্ঠ বলল,‘ফরেন্সিক না কোথায় যেন কাজ করত।’
হৈমন্তী গা থেকে শার্ট খুলে পাশে ফেলে দিল। বলল, ‘ইন্টারেস্টিং।’
পুরুষকণ্ঠ একটু চুপ করে বলল,‘আর একবার ভেবে দেখ হৈমন্তী, এই সিচ্যুয়েশনে কাজটা করা ঠিক হচ্ছে কী?’
হৈমন্তী সহজ ভাবে বলল,‘কাজ তো আমি করছি না।’
পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘তাহলে কে করছে!’
হৈমন্তী সহজভাবে বলল, ‘কেউ করছে না। নিজে থেকেই হবে। সবথেকে বড় কথা একজন বড় পুলিশ অফিসারের সামনেই ঘটবে। অথচ বোঝা যাবে না। এ সুযোগ আর পাওয়া যাবে?’
পুরুষকণ্ঠ থমকে গেল হতচকিত গলায় বলল,‘মানে কী! কী বলছো এসব!’
হৈমন্তী উঠে দাঁড়াল। হ্যান্ডব্যাগ থেকে চাবি বের করে তালা ঘুরিয়ে বড় ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলল, ‘মানে জানবার কোনো প্রয়োজন তোমার নেই। তুমি শুধু আমাকে বল, ভুল হচ্ছে না তো? লোক একই তো?’
‘তোমাকে ফটো পাঠিয়েছি। তুমি তো নিজের চোখেই দেখতে পাবে।’
হৈমন্তী বলল, ‘ফটো অনেকটা মিললেও, নাম তো মিলছে না।’
‘একই লোকের দুটো নাম থাকতে পারে না?’
হৈমন্তী ব্যাগ থেকে একটা একটা করে পোশাক বের করতে লাগল। একপাশের কাপড়ে মুড়ে রাখা ছোট্ট শিশিটাও বের করল। একবার চোখের সামনে তুলে ধরে টেবিলের ড্রয়ার খুলে সাবধানে রাখল। ফোনটা বাঁ কাঁধে চেপে ধরে বলল, ‘একবার আসবে নাকি? লাঞ্চের আগে একটু আদর নিতাম।’
ওপাশের পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘খেপেছো। তোমার হোটেলের সর্বত্র সিসি টিভির ক্যামেরা রয়েছে।’
হৈমন্তী হেসে বলল, ‘তাহলে তুমি ধরেই নিয়েছো আমি ধরা পড়ব এবং তারপর সিসিটিভির ছবি দেখে পুলিশ তোমাকেও ধরবে? তাই তো?’
পুরুষকণ্ঠ থতমত খেয়ে বলল,‘নানা, তা বলিনি। সাবধান হলে দুজনেরই সুবিধে।’
হৈমন্তী ‘খিলখিল’ আওয়াজে হেসে বলল, ‘আপাতত আমার একটাই সুবিধে সোনা। একজন পুরুষমানুষ এসে আমাকে স্ট্রেস ফ্রি করে দিক। লম্বা ফোর প্লে এবং সেক্স অ্যাক্টের পর ক্লান্ত হয়ে আমি খানিকটা ঘুমোতে চাই।’
পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘ঠাট্টা করছো? ওসবের অনেক সময় পাওয়া যাবে। দিস ইজ নট দ্য প্রপার টাইম। আমি ফোন ছাড়ছি। তোমার সঙ্গে দেখা হবে। টেক কেয়ার।’
পুরুষমানুষটি ফোন রেখে ফোন কাম জেরক্সের দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল। দোকানে বসা অল্প বয়সের ছেলেটি দেখল, ফোন ছেড়ে বেরোনো কাস্টমারেরর গাড়ির নম্বরটা মজার তো! ১২৩৪৫। ছেলেটি হাতের মোবাইল দিয়ে ফট্ করে একটা ফটো তুলে ফেলল। পুরুষটি জানতেও পারল না, ছবিতে সেও রয়ে গেল। দোকানের ছেলেটি মোবাইল থেকে ছবিটা পাঠাল তার বান্ধবী ফুচির কাছে। মিনিটখানেক পরে নম্বর টিপল।
‘ফুচি, দেখলে?’
‘কী দেখব?’
‘গাড়ির ছবি যেটা পাঠালাম। মজার নম্বর না?’
ফুচি গলায় বিরক্ত এনে বলল,‘গাড়ির নম্বর মজার হোক আর দুঃখের হোক, তোমার কী শশা?
শশা বলল, ‘আরে বাবা আমিও একদিন গাড়ি কিনব।’
ফুচি ধমক দিল, ‘চুপ করো। বাবার জেরক্সের দোকানে বসে ফুটানি দিও না। ফোন ছাড় দেখি।’
এই সময়ে বাথরোব গায়ে জড়িয়ে বাথরুমে ঢোকবার জন্য তৈরি হয়েছে হৈমন্তী। সে গুনগুন করে গানও ধরেছে। ভাবটা এমন যেন সে খুবই স্বাভাবিক। আবার ফোন বেজে উঠল। হৈমন্তী ঝুঁকে পড়ে নম্বর দেখে ফোন ধরল।
‘বল পূরবী।’
‘মাডাম, ঠিক করে পৌছেছেন আশা করি।’
‘হ্যাঁ তোমার ওখানে সব ঠিক আছে?’
‘হ্যাঁ ম্যাডাম। দুটো গুড নিউজ আছে।’
‘বল।’
‘ম্যাডাম, আমাদের সেই অ্যারোমাথেরাপিক কাজটা কোম্পানি সম্ভবত পার্শিয়ালি অ্যাপ্রুভ করতে চলেছে। কানাঘুষোয় শুনলাম। আপনি ফিরলে অ্যানাউন্স করা হবে।‘
‘ভেরি গুড। একাজে কৃতিত্ব সবথেকে বেশি তোমার পূরবী। তুমি খুব খেটেছিল।’
‘থ্যাঙ্কু ম্যাডাম। আর নেক্সট গুড নিউজটা হল, আজ সকালে সালফিউরিক অ্যাসিড আর কার্বলিক অ্যাসিডের মিক্সচারের শিশিটা খুঁজে পেয়েছি।’
হৈমন্তী ফোন চেপে ধরে বলল, ‘সেকী! আবার হারিয়েছিলে?’
পূরবী হালকা গলায় বলল, ‘না ম্যাডাম, আমারই ভুল হয়েছিল। অন্য আলমারিতে খুঁজছিলাম।’
হৈমন্তী ভুরু কুঁচকে, চিন্তিত গলায় বলল, ‘খুব সাবাধানে রাখবে। ওই কনসেনট্রেশনটা যেমন দামী তেমন পয়েজনাস। তুমি তো জানো। কয়েক ফোঁটাই যথেষ্ট।’
——————
এই ধারাবাহিকের সব পর্ব একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে