‘এখানে মেল কসমেটিক্সের বাজার কেন বাড়ানো যাচ্ছে না মিস্টার রায়? এ বিষয়ে আপনারা কি কোনরকম সার্ভে করেছেন?’
‘করেছি ম্যাডাম। একটা রিপোর্টও এনেছি, চাইলে ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশনও দেখাতে পারি।’
‘রিপোর্টের ফাইলটা দিন। প্রেজেন্টেশন পরে দেখব। আমাকে পেন ড্রাইভ দিয়ে দেবেন, মেল করতে পারেন। আপাতত মুখে একটা–দুটো পয়েন্ট শুনতে পারি? যেগুলো আপনার কাছে প্রায়োরটি বলে মনে হচ্ছে?’
স্বর্ণাভ রায় বললেন, ‘ইস্টার্ন জোনে বিশেষ করে বাঙালি পুরুষের মধ্যে এখনও ফ্যাশন কোনও আলাদা সাবজেক্ট হয়ে ওঠেনি। যেটুকু হয়েছে তা শরীরচর্চার মধ্যেই লিমিটেড। তাও নট ফর বিউটি, ফর হেলথ এন্ড ফিটনেস। বাঙালি পুরুষ সুন্দর হতে চায় না, বেশিদিন বাঁচতে চায়।’
হৈমন্তী সেলস রিপোর্টের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলল, ‘সেটা কেমন?’
স্বর্ণাভ রায় বললেন, ‘একথা ঠিক যে বাঙালি পুরুষের মধ্যে স্যালন বা জিমে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, কিন্ত সেটা একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত। মূলত ইয়ং এজ। কলেজ, ইউনিভার্সিটি অথবা কপোর্রেট পারসন। কমবয়সীরা পয়সা খরচ করে কতই বা কসমেটিকস প্রোডাক্ট কিনবে? শেভিং ক্রিম, পারফিউমের বেশি যাবে না। ফলে একটা জায়গা এসে আমরা আটকে যাচ্ছি। ওড়িশা, আসামের সমস্যাও একই রকম।’
হৈমন্তী মুখ না তুলেই বলল, ‘মিস্টার রায়, এই ইনফর্মেশনটা মনে হয় না কারেক্ট। এখন চল্লিশের ওপর বাঙালি পুরুষরাও ফিটনেস নিয়ে কনসার্নড। ইয়ংদের থেকে বেশি। আপনি বিভিন্ন প্রোডাক্টের অ্যাডে দেখবেন এজেড্ স্টারেরা আসছেন। তাঁদের আনা হচ্ছে, বয়স্কদের অ্যাট্রাক্ট করতে। গোটা দুনিয়ার মতো, এখানেও বয়স বিষয়টা গুলিয়ে গিয়েছে। বুড়ো বলে যে শব্দটা একসময়ে ছিল, সেটা আর এখন নেই। আপনি কাউকে বুড়ো বলা মানে তাঁকে অপমান করা হয়। কোনও বয়েসের মানুষই আর নিজেকে বুড়ো হিসেবে মানতে চান না। বাঙালির মধ্যে এই প্রবণতা বেড়েছে। সবাই নিজেকে কমবয়সী ভাবতে ভালবাসছে। তাদের মতো অ্যাক্ট করতে চাইছে। পাহাড়ে চড়তে পারি, তাই আমি বুড়ো নই এটা যে সত্য নয়, এটা একটা ইলিউশন, এটা বুঝতে চায় না। আমি বুড়ো তাও আমি ফিট, তাও আমি পাহাড়ে উঠতে পারি এই সত্যটা মানতে চায় না। উই হ্যাভ টু বাঙ্ক অন ইট। এই ইলিউশনের ওপর নির্ভর করতে হবে। মে বি ইউ ক্যান কল ইট ইয়ং সিনড্রোম। নিজেকে কমবয়সী ভাববার অসুখ। অসুখও বলতে পারেন আবার ড্রিমও বলতে পারেন।’
স্বর্ণাভ রায় থমকে গেলেন। খুবই অবাক হলেন। এই মহিলা একজন কেমিস্ট। কেমিক্যালস নিয়ে কারবার, মার্কেটিং–এর এত কায়দাকানুন বুঝলেন কী করে! নাকি বেশি ওস্তাদি হয়ে যাচ্ছে?
স্বর্ণাভ রায় ‘বন উই দ্য’ কোম্পানির ইস্টার্ন জোনের হেড। সাত বছর হল কাজ করছেন। তাঁর অধীনে আটান্নজনের টিম রয়েছে। ত্রিপুরা, অরুণাচল, মেঘালয়ে আরও কয়েকজনকে নেওয়া হবে। পুনের অফিস থেকে তাঁর কাছে কানাঘুষোয় খবর এসেছিল, নতুন একজন তাঁদের কাজের ব্যাপারে নাক গলাতে আসছে। খোদ হেড কোয়ার্টার থেকে নাকি অর্ডার এসেছে। সবাই ভেবেছিল, সেলস বা মার্কেটিং এক্সপার্ট কেউ আসবে। তার বদলে একজন কেমিস্টকে দায়িত্ব দেওয়া হল! হৈমন্তী সেনের রূপ এবং পার্সোনালিটির খবর এই কোম্পানির সকলেরই জানা। আগে এঁর সঙ্গে দেখাও হয়েছে। কলকাতা, ডিব্রুগড়, ভুবনেশ্বরের মিটিঙে হয়েছে। পুনেতে পার্টি। যতবার দেখা হয়েছে চোখ ধাঁধানো রূপে মুগ্ধ হতে হয়েছে। হৈমন্তী সেনকে নিয়ে পুরুষদের মধ্যে যেমন কানাঘুষো হয়, মহিলারাও বাদ যান না। বাইরে যাই করুন, কাজের জায়গায় এই সুন্দরীর কোনও প্রগলভতা বা বেচাল ভাব নেই। অফিস পার্টিতে সবসময় ফরম্যাল পরেন। শাড়ি ব্লাউজ, কোট প্যান্ট যা ই হোক না কেন, পোশাক গলা পর্যন্ত ঢাকা থাকে। হাতের কব্জিও দেখা যাবে না। এতে বেশি আকর্ষণীয়, বেশি রহস্যময়ী লাগে। অবশ্যই সেই সঙ্গে অভিজাত। যেটুকু ভদ্রতা, তার বেশি হাসি নেই মুখে। কেউ গায়ে পড়লে সহজ ভাবে তাকে বুঝিয়ে দেন, আর এগোলে বিপদে পড়তে হবে। সবার সামনে চড়ও মেরে দিতে পারে। অথচ মহিলাকে ঘিরে নানাধরনের গসিপ রয়েছে। দুটো বিয়ে, দশটা প্রেম। এখন একা থাকেন, অথচ নতুন পুরুষমানুষ ছাড়া নাকি রাতে শুতে পারেন না। বাড়িতে বা বন্ধুদের সঙ্গে উদ্দাম। পুরুষরা জলভাতের বিষয়। অথচ অফিসের কাজের ব্যাপারে অতি দক্ষ।
দূর থেকে দেখা হলেও হৈমন্তী সেনের সঙ্গে এভাবে সরাসরি যোগাযোগ আগে কখনও হয়নি স্বর্ণাভ রায়ের। খানিক আগে টেলিফোন করেছিলেন।
‘মিস্টার রায়, আমি হৈমন্তী সেন বলছি।’
‘বলুন মিসেস সেন।’
‘মিসেস সেন।’ শুনে একটু থমকে ছিল হৈমন্তী। একটু অর্ডার করবার ঢঙে বলল, ‘সরি, ইট ইজ অফিসিয়াল কল। আপনাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আপনার জোনের সেলস রিপোর্টটা সঙ্গে আনবেন। পার্টিকুলারলি মেল কসমেটিকস্–এর সেল রিপোর্ট।’
কথা শুনেই স্বর্ণাভ বুঝতে পারে, সম্বোধনে ভুল হয়ে গিয়েছে।
‘ম্যাডাম, কখন যাব? কোথায় যাব?’
হৈমন্তী বলেছিল, ‘কোথায থাকেন আপনি?’
‘যাদবপুরে ম্যাডাম।’
‘তাহলে তো কোনও সমস্যা নেই, আপনি এক ঘন্টার মধ্যে চলে আসুন। আমার হোটেলের ঠিকানাটা নোট করে নিতে পারেন।’
মুম্বাইতে বসকে হৈমন্তী বলে এসেছিল, কলকাতা থেকে ফিরে নতুন দায়িত্বে হাত দেবে। কোম্পানি কেন পূর্ব ভারতে পুরুষ প্রসাধনে বাজার বাড়াতে পারছে না জানবার চে্ষ্টা করবে। খানিক আগে কিছু একটা ভেবে মত বদলাল। এটা কি কোনও অ্যালিবাই তৈরি হচ্ছে? হৈমন্তী জানে। মুকুরের সঙ্গে কথা শেষ করে মোবাইলের অফিস ডিরেক্টরি খুলে স্বনার্ভ রায়কে ফোন করে আসতে বলল।
একই সঙ্গে রিসেপশনে ফোন করে বলল, ‘একতলার লাউঞ্জের পাশে আপনাদের যে অফিসরুমটা আছে সেটা এক ঘন্টার জন্য আমার নামে বুকিং করুন।’
‘ইয়েস ম্যাম।’
হৈমন্তী বলল,‘আর শুনুন স্বর্ণাভ রায় ছাড়া আর কাউকে আমার ভিজিটর হিসেবে অ্যালাও করবেন না। মিস্টার রায়কে অফিসে বসাবেন, চা কফি যেটা উনি চাইবেন সার্ভ করবেন।’
সেই মত স্বর্ণাভ এসেছেন। কথা চলছে। মিটিঙের যাবতীয় কথা হৈমন্তী মোবাইলে রেকর্ড করছে। স্বর্ণাভ রায়কে জানিয়েই করছে। অফিসে এই একটা ঝামেলা। কিছু কিছু কাজের রেকর্ড রাখতে হয়।
হৈমন্তী বলল, ‘এখানে প্রোডাক্ট অ্যাডভ্যার্টাইজমেন্ট কী করে হয়?’
স্বর্ণাভ বলল, ‘আমার তো আলাদা করে কিছু করি না। মুম্বাই থেকে এজেন্সি যা পাঠায়।’
স্বর্ণাভ ফাইল থেকে কতগুলো স্টিল ফটো বের করল। হৈমন্তী হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে ফেলল। সবই কমবয়সীদের ফটো। হিরোর মতো মাসকিউলিন চেহারা। খালি গায়ে আন্ডারগার্মেন্টস পরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাইভেট পার্টসের আকার বিশ্রী ভাবে স্পষ্ট। ফটোর একপাশে ডিওডোরেন্টের সবুজ শিশি। পিছন থেকে দুই তরুণী কামনাভরা চোখে তাকিয়ে আছে হিরোর দিকে। ওপরে ইংরেজিতে যে ক্যাপশন লেখা আছে তার গোদা বাংলা করলে দাঁড়ায়, এই ডিওডোরেন্ট মাখলে সুন্দরীরা কাছে যাবার জন্য ঝাঁপাঝাঁপি করবে।
হৈমন্তী বিরক্ত গলায় বলল,‘এই অ্যাডের মানে কী মিস্টার রায়? পৃথিবীর কোন তরুণী ডিওডোরেন্টে গন্ধে পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে? এ বিষয়ে আপনার কাছে কোনও ডেটা আছে?’
স্বর্ণাভ রায় মাথা নামিয়ে চুপ করে রইল। হৈমন্তী তার বস হলেও মহিলা। এই আলোচনা করা মুশকিল। হৈমন্তী রাগের গলায় বলল, ‘রাবিশ। বাঙালি বায়ারের সঙ্গে এসব যায় না। জুড়ি গাড়ি করে ময়দানে বেড়াতে যাওয়া বাঙালী বাবুর ছবি চাই। হাতে ছড়ি, পায়ে নাগরা। পকেটে গোঁজা ধুতির কোঁচা। পাশে আতরের শিশির ছবি দিতে হবে। বলতে হবে, পূর্বপুরুষের মত নিজেকে অভিজাত কর। তবে না বাঙালি নিজেকে রিলেট করবে। যাক, এটা আপনার বিষয় নয়। আমি মুম্বাই ফিরে অ্যাড এজেন্সির কথা বলব। এখন এই পর্যন্ত থাক। আমি আবার আসব। আপনাদের খবর দিয়ে আসব।’
স্বর্ণাভ রায় ফাইল গোছাতে গোছাতে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলেন।
‘ম্যাডাম, এখানে কতদিন আছেন?’
হৈমন্তী হালকা ভাবে বললেন, ‘আছি কদিন।’
‘ম্যাডাম, কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা বলি।’
হৈমন্তী মুখ না তুলে বলল, ‘বলুন।’
স্বর্ণাভ রায় গদগদ মুখ করে বললেন, ‘আমাদের ডিভিশন থেকে আপনাকে যদি একদিন লাঞ্চ বা ডিনারের আমন্ত্রণ জানাই...আপনি রাজি হবেন?’
হৈমন্তী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না। এবার সময় নেই। ভাল থাকবেন।’
হৈমন্তী নিজের ঘরে এসে সামান্য লাঞ্চের অর্ডার দিল। বেশিটাই সালাদ। রিসেপশনে ফোন করে জানাতে চাইল, কেউ এসেছিল কিনা। রিসেপনের মেয়েটি মিষ্টি গলায় জানাল, ‘একজন ম্যাম।’
হৈমন্তী সহজ ভাবে বলল, ‘হু ইজ হি?’
মেয়েটি বলল,‘ হি নয় ম্যাম, একজন লেডি এসেছিলেন। নাম বলেননি।’
মহিলা! কে এসেছিল? হৈমন্তী রিসিভার নামিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে ছোটো শিশিটা বের করল। চোখের সামনে তুলে দেখল। ঘন তরল রঙ সবুজ। সালফিউরিক অ্যাসিড আর কার্বলিক অ্যাসিডের নির্যাস কনসেনট্রেটেড অবস্থায় রয়েছে। বিষ হিসেবে নিজেদের পৃথক শক্তির থেকে কয়েক শো গুণ বেশি ক্ষমতা পেয়েছে সে। ঘন হয়েছে। কিন্তু এই বিষের রঙ কি সবুজ হয়? হোটেলেরক বড় জানলা দিয়ে আসা আলোয় ভুল দেখছে? সাবধানে কাজ করতে হবে। খুব সাবধানে। এই কাজ আরও অনেক পদ্ধতিতে হতে পারত, কিন্তু হৈমন্তীর মনে হয়েছিল, এটাই সবথেকে ইন্টারেস্টিং এবং চ্যালেঞ্জিং। হৈমন্তী সেন ইন্টারেস্টিং এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ পছন্দ করে।
সুন্দরী নিজের মনেই হাসল।
—————
এই উপন্যাসের সব পর্ব একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে